ফাইভ-জি, ফোর-জি’র থেকে ১০০ গুণ বেশি দ্রুত। ছবি- শাটারস্টক।
শুরু হয়েছিল মিনিট পিছু তিরিশ টাকার উপর খরচ দিয়ে। কাকে টু-জি বলে তা নিয়ে কেউ মাথা ঘামাত না। একটা গাবদা অ্যান্টেনা লাগানো ফোন। পকেটে রাখাটাই ছিল যন্ত্রণার। চার্জ থাকত কয়েক ঘণ্টার। তার পর ব্যবহারের খরচ ক্রমশ কমতে থাকল। কমে ১৬ টাকা, তার পর ৮ টাকা মিনিট পিছু কল চার্জ পেরিয়ে এখন এ ফোন আম জনতার। আর এ বার পালা ফাইভ-জি’র।
আমরা ক’জন মাথায় রাখি যে প্রথম প্রজন্মের মোবাইল ফোন এসেছিল ১৯৭৯ সালে যাতে শুধুই কথা বলা যেত? ৮০-র দশকের মাঝামাঝি ফিনল্যান্ডে প্রথম টু-জি ফোন বাজারে আসে। ডিজিটাল। শুধু কথা বলা নয়, তাতে এসএমএস-ও করা যেত। ভারতে মোবাইল ফোনের শুরু এই টু-জি-র হাত ধরেই।
মনে আছে প্রথম মোবাইল ফোন হাতে পাওয়ার কথা। তখন ৮ টাকা মিনিট। ইনকামিং ফ্রি। তাই ল্যান্ড লাইনে ফোন করেই কেটে দেওয়াটা রেওয়াজ ছিল। বাইরে কাজে গেলে, অফিসে ফোন করেই ছেড়ে দিতাম। অফিস থেকে ফোন আসত। আর তার পর দ্রুত কাজের কথা বলে নেওয়া। বেশি কথা বলার উপায় ছিল না। কারণ, সেই সময়ের গাবদা ফোনে চার্জ থাকত না এখনকার মতো। একে তো ওই খরচ, তায় ব্যাটারির চাপ। এই সময়েই মনে আছে লোকে পকেটে আর একটা ব্যাটারি নিয়ে ঘোরা শুরু করেছিল চার্জ শেষ হওয়ার ঝামেলা এড়াতে। আর তখন দেখনদারি ছিল কার কত ছোট ফোন তাতে। মনে আছে, ২০০০ সালে প্রথম আসে নোকিয়ার হাতের তেলোয় হারিয়ে যাওয়া মোবাইল ফোন! আর তার পরপরই ফ্লিপফোন। তাই নিয়ে কী উত্তেজনা আর আলোচনা!
মোবাইল ফোনের বিবর্তন। ফাইল ছবি।
এর পরের অধ্যায়ে এল ‘টু পয়েন্ট ফাইভ-জি’ আর তারই উন্নততর সংস্করণ ‘এজ’। ব্ল্যাকবেরি। হাতের ফোন থেকেই ইমেল করার সুবিধা। এরই মধ্যে লোক ভুলতে শুরু করেছে প্রথম মোবাইলের আকর্ষণ। ফোন থেকেই গাবদা মেল অনায়াসেই করা যাচ্ছে। কিন্তু তখনও মোবাইল ফোন সময় কাটানোর সঙ্গী হয়ে ওঠেনি।
এল থ্রি-জি। বদলে গেল জীবনটাই। তুলনামূলক ভাবে অনেক দ্রুত চালাচালি হতে থাকল তথ্য। মোবাইলেই ইন্টারনেট দেখার উন্নত সুযোগ। সাধারণ মোবাইলেই ইমেল-সহ গোটা দুনিয়া হাতের মুঠোয়। উল্টো দিকের মানুষটাকে ফোনে দেখার সুযোগ। শুধু তাই নয়। ফোনকে ব্যবহার করেই কম্পিউটার থেকে ইন্টারনেট ব্যবহার করা বা হটস্পট তৈরির সুযোগ। আর এখন তো ফোর-জি’র কল্যাণে আরও উন্নত ব্যবস্থা।
আসলে মোবাইল ফোনের এই উন্নতি ক্রমাগত কিন্তু আমাদের হাতের মুঠোর মধ্যেই আরও বেশি করে এনে দিচ্ছে যোগাযোগের নানান সুযোগ। শুধু কথা বলা থেকে আজকের মোবাইল সর্বস্ব জীবনে হাতের মুঠোয় এসে গিয়েছে আদিম কম্পিউটারের থেকেও অনেক বেশি ক্ষমতা। কিন্তু চাই তো আরও বেশি। তাই এ বার পালা ফাইভ-জি’র!
রিলায়্যান্সের হাত ধরে ভারতে আসছে ফাইভ-জি। কিন্তু তা নিয়ে এত হইচই কেন? এই পরিসরে ফাইভ-জি’র অর্থনীতি নিয়ে আলোচনা করার জায়গা নেই। রিলায়্যান্স কার সঙ্গে জুটি বাঁধল তাও আমরা জানি। ভারতের মতো দেশে এর সুযোগ কতটা, তাও এই আলোচনার পরিসরের বাইরেই থাক। শুধু তুলনার হিসাবে বুঝে নেওয়ার চেষ্টা করব ফাইভ-জি’র বৈশিষ্ট।
এই প্রজন্মের প্রযুক্তি নিয়ে উত্তেজনার কারণ হল তথ্য আদানপ্রদানের অবিশ্বাস্য দ্রুততা। আজকের প্রযুক্তি ফোনের বোতাম টিপে টিভি দেখা যায়, ফ্রিজ চালানো যায়। আরও যা যা করা যায় এই প্রযুক্তিতে তার সবই করা যায় তো বটেই, এবং তা করা যায় আরও দ্রুততায়। শুধু তাই নয়, এই প্রযুক্তিতে একই অঞ্চলে যত যন্ত্রের মধ্যের যোগাযোগ করা সম্ভব বর্তমান প্রযুক্তিতে তার একটা ভগ্নাংশ সম্ভব। আর তাই এটা নিয়ে অনেক বেশি উত্তেজিত শিল্পমহল।
দেখে নেওয়া যাক ব্যাপারটা কী! শুরু করা যাক বিশ্বে কার কার হাতে এই প্রযুক্তি আছে সেখান থেকেই। বিশ্বের ন’টি সংস্থার হাতে রয়েছে এই প্রযুক্তি। আর সেগুলি হল—
দেশ ধরে প্রযুক্তির অধিকার দেখলে দেখব এই মুহূর্তে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চিন আর দক্ষিণ কোরিয়ার হাতে রয়েছে এই ফাইভ-জি’র চাবিকাঠি। ২০১৬ সালের জুলাই মাসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল কমিউনিকেশন কমিশন সেই দেশে কী ভাবে এই নেটওয়ার্ক কাজ করবে তার নিয়ম বেঁধে দেয়। আর তার পরই শুরু হয় মার্কিন দেশে ফাইভ-জি’র যাত্রা। অন্য দেশেও মোটামুটি এই নিয়মই অনুকরণ করছে। কিন্তু তা অন্য প্রসঙ্গ।
ফাইভ-জি কেন?
আমাদের দৈনন্দিন মোবাইল ব্যবহারের দিক থেকেই ভাবি। ধরুন, আপনার একটা সিনেমা ফোর-জি’তে ডাউনলোড করতে সময় লাগে সাত মিনিট। ফাইভ-জি’তে তা করবেন ছয় থেকে সাত সেকেন্ডে। অন্তত প্রযুক্তিবিদদের দাবি এটাই। কিন্তু শুধু বিনোদনের কথা ভেবেই কি এত উত্তেজনা? অবশ্যই নয়।
শুধু কথা বলা থেকে আজকের মোবাইল সর্বস্ব জীবনে হাতের মুঠোয় এসে গিয়েছে আদিম কম্পিউটারের থেকেও অনেক বেশি ক্ষমতা। ফাইল চিত্র।
এখনই ফোনে ফ্যান থেকে এসি সবই চালানো যায়। এমনকি বাড়িতে না থাকলেও। কিন্তু ভাবুন আপনার হাতে মোবাইল। তাই দিয়ে কিছু একটা বন্ধ করতে হবে। এবং সঙ্গে সঙ্গে। পারবেন না। কারণ বর্তমান প্রযুক্তিতে আপনার ফোন থেকে সিগন্যাল পৌঁছতে যা সময় লাগবে তাতে হয়ত দেরি হয়ে যাবে।
এবার ধরুন কোনও কারখানায় কয়েক হাজার যন্ত্রের মধ্যে সারাক্ষণ যোগাযোগ রাখা দরকার। ক্রেতার চাহিদা থেকে উৎপাদন, সব। কিন্তু তা করতে গেলে যে দ্রুততায় তথ্য আদানপ্রদান করতে হবে এবং একসঙ্গে যত যন্ত্রকে এক সুতোয় জড়িয়ে রাখতে হবে তা বর্তমান প্রযুক্তিতে সেই দ্রুততায় করা যায় না। ফাইভ-জি’তে এর থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে বলে দাবি। তথ্যে চোখ রাখা যাক।
আরও পড়ুন: মূল্যবৃদ্ধির থেকেও কম সুদ জমায়, বাড়ছে চিন্তা
ফাইভ-জি, ফোর-জি’র থেকে ১০০ গুণ বেশি দ্রুত। আর সেই কারণেই, উদাহরণ হিসাবে বলা যাক, সিনেমা ডাউনলোড করতে ১০০ ভাগ সময় কম লাগবে। ফোর-জি’তে যদি ১০০ এমবিপিএস গতিতে তথ্য নামানো যায়, ফাইভ-জি’তে তা করা যাবে ১০ হাজার এমবিপিএস গতিতে।
তথ্যপ্রযুক্তির জগতে একটা কথা চালু আছে। ল্যাটেন্সি। সহজ করে বুঝলে— আপনি একটা তথ্য পাঠালেন, তা কত দ্রুত গন্তব্যে পৌঁছে যাচ্ছে তা দিয়ে মাপা হয় ল্যাটেন্সি। ফাইভ-জি’তে এই সময় নাকি পাঁচ মিলিসেকেন্ডেরও কম। ফোর-জি’তে যা ৫০ মিলিসেকেন্ডের মতো। অর্থাৎ আমরা যদি কোনও কিছু হঠাৎ থামাতে চাই বা চালাতে চাই মোবাইল ফোন ব্যবহার করে, তা হলে ফাইভ-জি দিয়ে তা ফোর-জি’র থেকে ১০ ভাগ কম সময়ে করে ফেলতে পারব।
আপনি একটা তথ্য পাঠালেন, তা কত দ্রুত গন্তব্যে পৌঁছে যাচ্ছে তা দিয়ে মাপা হয় ল্যাটেন্সি। ফাইভ-জি’তে এই সময় নাকি পাঁচ মিলিসেকেন্ডেরও কম। ফাইল চিত্র।
যেহেতু ফাইভ-জি দিয়ে আমরা অনেক বেশি তথ্য, অনেক বেশি যন্ত্রে, ফোর-জি’র তুলনায় অনেক কম সময়ে একই সঙ্গে করে ফেলতে পারি তাই এই প্রযুক্তি নিয়ে সবাই এত উত্তেজিত। আমরা নিজেরাই দেখেছি টু-জি’তে মোবাইল ফোন দিয়ে যা করতে পারতাম, ফোর-জি দিয়ে তার থেকে অনেক বেশি কিছু করতে পারি। আর বিভিন্ন সংস্থা এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে নানান পরিষেবা আমাদের কাছে হাজির করেছে-- এমনকি ব্যাঙ্কিংয়ের মতো পরিষেবাও আজ আক্ষরিক অর্থেই আমাদের হাতের মুঠোয়।
কিন্তু! হ্যাঁ, একটা কিন্তু থেকেই যাচ্ছে। বিশ্বের মোবাইল পরিষেবা সংস্থাগুলি জিএসএমএ-র সদস্য। খানিকটা বণিকসভার মতো। এই জিএসএমএ-র দাবি, ২০২৫ সালের মধ্যে গোটা বিশ্বের এক তৃতীয়াংশ এই নতুন পরিষেবা ব্যবহার করবে। আমরা একটু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তথ্যে চোখ রেখে এই ‘কিন্তু’টা বুঝে নিই।
আরও পড়ুন: মাত্রা ছাড়াচ্ছে ক্ষতির অঙ্ক, অশনি সঙ্কেত বিমান শিল্পে
এই মুহূর্তে মার্কিন দেশের ৫০টি শহরে ফাইভ-জি প্রযুক্তি চালু হয়েছে। প্রশ্ন, প্রযুক্তির যে দাবি করা হচ্ছে, তা কতটা মিলছে এই সব শহরে? এই বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে করা শহরভিত্তিক এক সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে :
সিগন্যাল শক্তির এই সমীক্ষা থেকে দেখা যাচ্ছে, দাবি আর বাস্তবের মধ্যে ফারাক এখনও অনেক। হয়ত তা প্রযুক্তির প্রাথমিক সমস্যা। কিন্তু ভাবুন তো, এই প্রযুক্তি আমাদের কী দিতে পারে এই প্রাথমিক সমস্যা কাটিয়ে উঠলে! কতটা, তা আমরা ইতিমধ্যেই প্রত্যক্ষ করেছি। এবং, ফাইভ-জি কিন্তু থ্রি-জি-র মতোই বৈপ্লবিক হতে চলেছে, যা দাবি তা ঘটলে। কিন্তু আর্থসামাজিক অভিঘাত কী হবে তা অন্য আলোচনার বিষয়।
গ্রাফিক-শৌভিক দেবনাথ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy