Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
Mutual Fund

কখন কোনটা

এটা ভাল না ওটা? খাবার, পোশাক থেকে বেড়াতে যাওয়ার জায়গা, এমন দ্বন্দ্ব পায়ে পায়ে। লগ্নির দুনিয়ায় তেমনই এক দ্বন্দ্ব— শেয়ার না ফান্ড? ফান্ড না শেয়ার? ভুল পছন্দের মাসুল গুনতে হবে না, যদি দু’টোই খতিয়ে দেখে সিদ্ধান্ত নেন। খুঁটিনাটি জানালেন অদিতি নন্দীএটা ভাল না ওটা? খাবার, পোশাক থেকে বেড়াতে যাওয়ার জায়গা, এমন দ্বন্দ্ব পায়ে পায়ে। লগ্নির দুনিয়ায় তেমনই এক দ্বন্দ্ব— শেয়ার না ফান্ড? ফান্ড না শেয়ার?

শেষ আপডেট: ১৫ অক্টোবর ২০২০ ০৫:১৩
Share: Save:

আগে বলা হত সঞ্চয়। এখন লগ্নি। কেন? ফারাকটা কোথায়? একটা সময় পর্যন্ত বেশির ভাগ মানুষের উদ্বৃত্ত অর্থের গন্তব্য ছিল ব্যাঙ্কের মেয়াদি আমানত বা পোস্ট অফিসের সরকারি প্রকল্প। সুদ ছিল ভালই। জমানো অর্থ নির্দিষ্ট সময়ে দ্বিগুণ হত। তাতেই তুষ্ট থাকতেন সকলে। বলা হত সঞ্চয়।

নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি থেকে এই প্রবণতা বদলাতে থাকে। অনেকেই টাকা ঢালতে শুরু করেন শেয়ার, মিউচুয়াল ফান্ড, ঋণপত্রে। আর গত দশকের গোড়ায় এই অভ্যাস জাঁকিয়ে বসে। মানুষের অংশগ্রহণ ক্রমে বাড়তে থাকে বাণিজ্যিক সংস্থার পুঁজিতে। চলে আসে পুরোদস্তুর বিনিয়োগের সংস্কৃতি।

কেন এই আলোচনা

একটা সময়ে টাকা জমানোর সুয়োরানি ছিল ‘ফিক্সড রিটার্ন ইন্সট্রুমেন্ট’। সুদ মিলত ১২%-১৪%। অধিকাংশ মানুষের ধারণা ছিল, শেয়ার বাজার মানেই ফাটকা। সেখানে পা রাখা মানে ঘরের টাকা উবে যাওয়া। পরে দুনিয়ার সঙ্গে তাল মিলিয়ে ভারতেও সুদ কমতে শুরু করল। আর এখন তো ব্যাঙ্কের মেয়াদি আমানতে ৬%-৬.৫% পাওয়াটাই বিরাট ব্যাপার। সুদ কমছে স্বল্প সঞ্চয়েও।

ফলে খানিকটা বাধ্য হয়েই শেয়ার বাজারে টাকা রাখতে শুরু করলেন মানুষ। বুঝতে পারলেন, আসল বিষয়টা হল ঝুঁকি নেওয়ার ক্ষমতা। যেখানে ঝুঁকি কম সেখানে রিটার্নও কম। যে বিনিয়োগে ঝুঁকি আছে, তাতে রিটার্নও ভাল হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। তাই ঝুঁকির মধ্যে ভারসাম্য রেখে তৈরি করতে হবে লগ্নির পোর্টফোলিয়ো।

বিনিয়োগের ঝুঁকির সাত-সতেরো জানার জন্য দরকার বিস্তর পড়াশোনা, তথ্য ঘাঁটাঘাঁটি। কিন্তু সেই সময় ক’জনের আছে? এখানেই গুরুত্ব বাড়ল মিউচুয়াল ফান্ডের। ঝুঁকি সেখানেও আছে। তবে ফান্ডে রয়েছেন ফান্ড ম্যানেজার। তাঁরাই তথ্য বিশ্লেষণ করে কাজটা করে দিচ্ছেন।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আপনি কখন কী ভাবে বিনিয়োগ করবেন? সরাসরি শেয়ারে, নাকি ফান্ড মারফত? ফান্ড ম্যানেজার যে কাজ করে দেন, সেটা কি সাধারণ মানুষের পক্ষে করা সম্ভব? আজ সেটাই জানার চেষ্টা করব। তার জন্য আগে বুঝে নেব ফান্ডের রকমফের। কারণ, এক-এক ফান্ডের গঠন এবং উদ্দেশ্য এক-এক রকম।

মিউচুয়াল ফান্ড

গঠনের দিক দিয়ে দেখতে গেলে মিউচুয়াল ফান্ড মূলত চার রকম।

• ইকুইটি ফান্ড: ফান্ডের মোট পুঁজির ন্যূনতম ৬০% শেয়ারে থাকতেই হবে। ঝুঁকিতে ভারসাম্য আনার জন্য বাকি টাকা ঋণপত্রেও বিনিয়োগ হয়।

• ডেট ফান্ড: শেয়ারে বিনিয়োগ ৬০ শতাংশের নীচে নামলেই তা হবে ডেট ফান্ড। তাতে বিনিয়োগ করে মুনাফা হলে তা আর ইকুইটি নয়, ঋণপত্রের আয়কর হারের আওতায় পড়বে।

• হাইব্রিড ফান্ড: ইকুইটি ও ঋণপত্রের মিশেলে তৈরি ভারসাম্যযুক্ত ফান্ড। আয়করের নিরিখে হাইব্রিড ফান্ড বলে আলাদা কিছু নেই। সব হাইব্রিড ফান্ডই আসলে হয় ইকুইটি, না হয় ডেট ফান্ড।

• মানি মার্কেট ফান্ড: এদের কাজ মানি মার্কেটে সুদে পুঁজি খাটানো। এখানেও ঝুঁকি অনুযায়ী দু’ধরনের ফান্ড। একটি মূলত সরকারি ঋণপত্রে টাকা খাটায়। অন্যটি বেসরকারি ঋণপত্রে। মানি মার্কেট ফান্ডের মধ্যে ঝুঁকি সবচেয়ে কম লিকুইড ফান্ডে।

ফান্ড যখন শেয়ার নির্ভর

শেয়ার মূলধনের নিরিখে ইকুইটি ফান্ডেরও রকমফের আছে—

• লার্জ ক্যাপ ফান্ড: শেয়ার মূলধনের তালিকার সবচেয়ে বড় ১০০টি সংস্থার শেয়ারে লগ্নি করে। ঝুঁকি ইকুইটি বিভাগে সবচেয়ে কম। সে জন্য এই ধরনের ফান্ডের ম্যানেজারেরা ৮০% পর্যন্ত মূলধন শেয়ারে রেখে থাকেন। বড়জোর ২০% ঢালেন ঋণপত্রে।

• মিড ক্যাপ ফান্ড: এরা শেয়ার মূলধনের তালিকার উপরের দিকের ১০১ থেকে ২৫০তম সংস্থায় বিনিয়োগ করে। ঝুঁকিতে ভারসাম্য আনতে ৬৫% পর্যন্ত শেয়ারে রাখা হয়। বাকি ৩৫% ঋণপত্রে।

• স্মল ক্যাপ ফান্ড: তালিকার ২৫০-এর তলায় যারা, তাদেরই ‘স্মল ক্যাপ’ ধরা যেতে পারে। বাজারে এই ধরনের শেয়ার অগুনতি। ঝুঁকি অনেক বেশি। রিটার্নের সম্ভাবনাও তা-ই। তবে রিটার্ন ভাল, খারাপ— দুই-ই হতে পারে। এই ধরনের ফান্ডে ভারসাম্য বাড়াতে ফান্ড ম্যানেজারেরা পুঁজির অন্তত ৩৫% ঋণপত্রে রাখেন।

• মাল্টি ক্যাপ: এত দিন পর্যন্ত মাল্টি ক্যাপ ফান্ড বলতে ইকুইটি ফান্ডের জগাখিচুড়িকে বোঝাত। সম্প্রতি শেয়ার বাজার নিয়ন্ত্রক সেবি জানিয়েছে, ‘মাল্টি ক্যাপ’ নামটি শুধু সেই ফান্ডেই ব্যবহার করা যাবে, যেখানে ২৫% করে লার্জ, মিড এবং স্মল ক্যাপ সংস্থার শেয়ার থাকবে।

করের নিরিখে

আয়করের বিধি অনুযায়ী ফান্ডগুলির দু’ভাগ। ইকুইটি বনাম ডেট এবং ট্যাক্স সেভিং বনাম নন-ট্যাক্স সেভিং।

• ইকুইটি বনাম ডেট: ইকুইটি ফান্ডে লগ্নি করলে শেয়ারে বিনিয়োগের নিয়মে করের হিসেব হয়। লগ্নির পরে সেই ফান্ড অন্তত এক বছর রেখে বিক্রি করলে দীর্ঘমেয়াদি মূলধনী লাভের সুবিধা মেেল। বছরে ১ লক্ষ টাকার বেশি মুনাফা হলে দীর্ঘমেয়াদি মূলধনী লাভকর ১০%। এক বছরের কম সময়ে ফান্ডের ইউনিট েবচে মুনাফা হলে দিতে হয় ১৫% স্বল্পমেয়াদি মূলধনী লাভকর। ঋণপত্র নির্ভর ফান্ড অন্তত তিন বছর রাখলে দীর্ঘমেয়াদি মূলধনী লাভকর প্রযোজ্য। তার আগে তুলে নিয়ে মুনাফা হলে তা সাধারণ আয়করের আওতায় পড়বে।

• ট্যাক্স সেভিং বনাম নন-ট্যাক্স সেভিং: শুধু ইকুইটি লিঙ্কড সেভিংস স্কিমে (ইএলএসএস) ৮০সি ধারায় আয়কর ছাড়ের সুযোগ আছে। ফান্ডের অন্য সমস্ত প্রকল্প আয়করের আওতাভুক্ত। ইএলএসএস আদতে ইকুইটি স্কিম। ৮০% ইকুইটি থাকে। তিন বছরের আগে তা বিক্রি হয় না।

তফাত লগ্নিতে

বিনিয়োগের ধরন অনুযায়ী ইকুইটি ফান্ড দু’রকম। অ্যাক্টিভ এবং প্যাসিভ।

• অ্যাক্টিভ ফান্ড: ফান্ড ম্যানেজার নিয়মিত ফান্ডটি পর্যবেক্ষণ ও শেয়ার কেনাবেচা করেন।

• প্যাসিভ ফান্ড: শেয়ার বাছাইয়ে ফান্ড ম্যানেজারের বিশেষ ভূমিকা নেই। সূচক অনুযায়ী তালিকা ধরে শেয়ার কেনা হয়। যেমন ইনডেক্স ফান্ড, এক্সচেঞ্জ ট্রেডেড ফান্ড (ইটিএফ)।

এ বার শেয়ার

লগ্নির দুনিয়ায় শেয়ার বাজার মানেই সরাসরি ঝুঁকির মুখোমুখি হওয়া। বাজারে গিয়ে খুঁটিয়ে দেখে, দাম পরখ করে যেমন যত্নে জিনিসপত্র বেছে কেনেন, শেয়ার কেনার ক্ষেত্রেও তেমনটাই করার নিয়ম। সংস্থা ছোট, মাঝারি না বড়, ব্যবসা কী রকম, পরিচালন ব্যবস্থা কতটা দক্ষ, মুনাফায় হচ্ছে কি না, কোনও সমস্যা আছে নাকি ইত্যাদি বিচার করে সেই বাছাবাছি করেন লগ্নিকারী। টাকা ঢালার আগে যাচাই করতে হয় নিজের ঝুঁকি নেওয়ার ক্ষমতা।

কৌশল জরুরি

ফান্ডের ধরন জানলে, কোন প্রয়োজনে কোন ফান্ড কেনা উচিত তা কিছুটা পরিষ্কার হয়। সে ক্ষেত্রে সরাসরি শেয়ারে নাকি ফান্ডে বিনিয়োগ করব, সেই সিদ্ধান্তও নিতে সুবিধা হবে। সেই কৌশলের ব্যাপারেই কিছু পরামর্শ:

• লগ্নির পুরো অর্থ শেয়ারে খাটানো ঠিক নয়। লার্জ ক্যাপ শেয়ারে যদিও বা ৮০% পর্যন্ত রাখা যায়, মিড ক্যাপ বা স্মল ক্যাপে ৬০-৬৫ শতাংশের বেশি নয়। বাকি টাকা নির্ভরযোগ্য ঋণপত্রে বিনিয়োগ করা যেতে পারে।

• শেয়ারে সরাসরি লগ্নিতে বেশ কিছু শেয়ার মিলিয়ে ঝুঁকির ভারসাম্য বজায় রাখা জরুরি। যত দিন বিনিয়োগ থাকবে, তত দিন শেয়ার নিয়মিত পর্যবেক্ষণ এবং দরকারে কেনাবেচা করে পরিবর্তন করা উচিত।

• যে কোনও সময়ে তুলতে হবে, এমন পুঁজি লিকুইড ফান্ডে রাখা ভাল।

• যাঁরা সূচকের ভিত্তিতে রিটার্নকে নিরাপদ মনে করছেন তাঁদের জন্য রয়েছে ইনডেক্স ফান্ড এবং ইটিএফ।

• স্মল ক্যাপ ফান্ডে রিটার্নের সম্ভাবনা বেশি। রয়েছে উঁচু ঝুঁকিও। সেই রিটার্ন ও ঝুঁকির ভারসাম্য নির্ভর করে ফান্ড ম্যানেজারের দক্ষতার উপর।

• ৮০সি ধারায় করছাড়ের সুবিধা পেতে চাইলে ইএলএসএসে বিনিয়োগ করা উচিত। তবে তা অন্তত তিন বছর ধরে রাখতে হয়।

• দীর্ঘমেয়াদে বেশি রিটার্ন পেতে এবং লাভে কম করের সুবিধা নিতে লার্জ ক্যাপ শেয়ার বা ফান্ডের বিকল্প নেই।

শেয়ার বনাম ফান্ড

• ফান্ডের রক্ষণবেক্ষণের (ফান্ড ম্যানেজমেন্ট) খরচ বেশি। সংশ্লিষ্ট মোট তহবিলের (অ্যাসেট আন্ডার ম্যানেজমেন্ট বা এইউএম) সর্বাধিক ২.৫%। শেয়ারে সেই খরচ কম।

• শেয়ারে লগ্নি নিজের হাতে। ফান্ডের ক্ষেত্রে ফান্ড ম্যানেজারের সিদ্ধান্ত।

• নিজস্ব ডিম্যাট অ্যাকাউন্ট লগ্নি করা শেয়ারের তালিকা দেখায়। কিন্তু মিউচুয়াল ফান্ড কর্তৃপক্ষ তা প্রকাশ করেন নির্দিষ্ট সময় অন্তর।

• শেয়ারের দরের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মিউচুয়াল ফান্ডের নেট অ্যাসেট ভ্যালু (ন্যাভ) ওঠানামা করে।

• ইনিশিয়াল পাবলিক অফারের (আইপিও) মাধ্যমে নতুন শেয়ারে আবেদন করা যায়। এ ক্ষেত্রে মূল দামে (ফেস ভ্যালু) প্রিমিয়াম চার্জ করা হতে পারে। নিউ ফান্ড অফারের (এনএফও) মাধ্যমে শুধু মাত্র ফেস ভ্যালুতেই ফান্ডের ইউনিট ইসু হয়।

এসআইপি আকর্ষণীয়

স্বল্প সঞ্চয় প্রকল্পের সার্থক বিকল্প সিস্টেমেটিক ইনভেস্টমেন্ট প্ল্যান (এসআইপি)। ব্যাঙ্ক থেকে নিয়মিত টাকা কাটিয়ে এসআইপি করা যায়।

• দিনে, সপ্তাহে, মাসে, তিন বা ছ’মাস অন্তর টাকা কাটানো সম্ভব। ভাল রিটার্নের সম্ভাবনা বেশি।

• ওপেন এন্ডেড বা বাজারে লগ্নির জন্য খোলা আছে এমন যে কোনও ফান্ডেই এসআইপি করা যায়।

• এসআইপির ঠিক উল্টো, অর্থাৎ নিয়মিত টাকা তুলে নেওয়ার পদ্ধতিও রয়েছে। নাম সিস্টেমেটিক উইথড্রয়াল প্ল্যান (এসডব্লিউপি)।

• একটি ফান্ডের ইউনিট বেচে নিয়মিত অন্য ফান্ডে এসআইপি করার নাম সিস্টেমেটিক ট্রান্সফার প্ল্যান।

শেয়ারেও কি এসআইপি সম্ভব? কেউ কেউ সন্তান বা পরিবারের ভবিষ্যতের কথা ভেবে এসআইপি পদ্ধতিতেই একটু একটু করে লার্জ ক্যাপ শেয়ার কিনে বিপুল লাভ করেছেন। পরিভাষায় এর নাম ভ্যালু অ্যাভারেজিং ইনভেস্টমেন্ট প্ল্যান। এখন প্রশ্ন, কে শেয়ার কিনবেন আর কে ফান্ড? যদি নিয়মিত খুঁটিয়ে পর্যবেক্ষণের ধৈর্য থাকে, খুঁতখুঁতে হন, তা হলে শেয়ারই আপনার জন্য ঠিক। আর যদি তা না-হয়, তা হলে ফান্ডের দিকে হাত বাড়ান। সিদ্ধান্ত রেটিংযুক্ত ফান্ডের ফান্ড ম্যানেজারের কাঁধে।

লেখক বিনিয়োগ বিশেষজ্ঞ (মতামত ব্যক্তিগত)

অন্য বিষয়গুলি:

Mutual Fund Share Market SIP Investment
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy