প্রতীকী ছবি
সুকুমার রায়ের ‘আবোল তাবোলে’ গোঁফ চুরির ভয়ে মেজাজ বিগড়েছিল হেড অফিসের বড় বাবুর। আর এখন দুনিয়া ত্রস্ত তথ্য (ডেটা) চুরির ভয়ে! মোদী সরকারের দাবি, এই আশঙ্কাতেই বহু চিনা অ্যাপে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে তারা। কড়াকড়ির দেওয়াল তোলা হচ্ছে বিদ্যুৎ, টেলিকম-সহ বিভিন্ন শিল্পে চিনা যন্ত্র আমদানিতে। অথচ ঘটনাক্রমেই স্পষ্ট যে, চিনের সঙ্গে আদায়-কাঁচকলায় সম্পর্কের সুযোগে ভারতের বিপুল বাজার ধরতে বহু গুণ উৎসাহে ঝাঁপাচ্ছে মার্কিন তথ্যপ্রযুক্তি বহুজাতিকগুলি। ‘তথ্য হাতানো’ থেকে শুরু করে একচেটিয়া বাজার দখলের চেষ্টা— প্রায় সব ক্ষেত্রেই আমেরিকা, ইউরোপ-সহ সারা বিশ্বে পাহাড়প্রমাণ অভিযোগের মুখে যারা!
ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব পাবলিক ফিনান্স অ্যান্ড পলিসির অধ্যাপক এন আর ভানুমূর্তির কথায়, “তথ্যের নিরাপত্তা-সহ সংশ্লিষ্ট সমস্ত বিষয়ে সঠিক নজরদারির জন্য দক্ষ নিয়ন্ত্রক থাকা জরুরি। স্পষ্ট হওয়া উচিত নিয়ম। যাতে সেখানে ফাঁকি দিয়ে কোনও সংস্থাই পার না-পায়। তা সে যে দেশেরই হোক।”
কিন্তু প্রশ্ন উঠছে, দেশের তথ্য বাইরে পাচার ঘিরে ছুতমার্গ এখন কি শুধু ‘শত্রু’ পড়শি মুলুকের ক্ষেত্রে? যে দাপটে মার্কিন তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থাগুলি তথ্যের পাহাড় সার্ভারে জমা করে, ব্যবহার করে নিজেদের প্রয়োজনে, তা কি অজানা? প্রত্যেকের পছন্দ আর খোঁজের (সার্চ) যে খুঁটিনাটি গুগলের ভাঁড়ারে রোজ জমা পড়ে, যতখানি তথ্য হাতে থাকলে তাদের ম্যাপ নিখুঁত দেখিয়ে দিতে পারে পাড়ার ছোট মিষ্টির দোকানের ঠিকানা, তা-ও ভিন্ দেশের সার্ভারে জমা পড়া কি ভারতের নিরাপত্তার পক্ষে ঝুঁকি নয়? প্রত্যেক ক্রেতা সম্পর্কে কত নিখুঁত তথ্য জানলে, তবে মাস শেষের মুখে কারও পছন্দের ব্র্যান্ডের শ্যাম্পুতেই বিশেষ অফার দিতে পারে অ্যামাজ়ন বা ওয়ালমার্টের ফ্লিপকার্ট? চিনা বহুজাতিক আলিবাবার লগ্নি থাকা বিগ বাস্কেটের সঙ্গে এ ক্ষেত্রে তাদের ফারাক কোথায়? কার কেমন পোস্টে কে কত বার বেশি ‘লাইক’ করে, সেই তথ্য ফেসবুকের কণ্ঠস্থ। প্রত্যেকের পছন্দ এমন হাতের ডগায় বলেই তো অনলাইন বিজ্ঞাপনের প্রায় ৮০% চারমূর্তির দখলে— ফেসবুক, গুগল, অ্যামাজ়ন এবং মাইক্রোসফট-লিঙ্কডইনের যুগলবন্দি।
বিতর্কের মুখে
• মাইক্রোসফটের পরে একচেটিয়া বাজার দখলের অভিযোগের তির দীর্ঘ দিন ধরেই অ্যামাজ়ন, ফেসবুক, অ্যাপল, গুগলের দিকে। ইউরোপ, এমনকি খাস আমেরিকাতেও!
• এই প্রতিটি সংস্থার বিরুদ্ধেই অভিযোগ, ব্যবহারকারীদের বিপুল পরিমাণে তথ্য (ডেটা) নিজেদের ভাঁড়ারে তুলে রাখার। পছন্দ মেপে বিজ্ঞাপন (টার্গেটেড অ্যাড) থেকে শুরু করে পণ্য বিক্রি পর্যন্ত বিভিন্ন ক্ষেত্রে যা ব্যবহার করে তারা।
• এই সমস্ত তথ্যপ্রযুক্তি দৈত্যদের দাপটে রাশ টানতে কড়া আইনের প্রয়োজনিয়তার কথা বলেছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন।
মার্কিন কংগ্রেস এবং নিয়ন্ত্রকের তদন্তেরও আতসকাচে তারা।
সরকারের যদিও দাবি, তাদের রোষ শুধু চিনা সংস্থার উপরে নয়। দেশের তথ্য বাইরে যাওয়া রুখতে সংসদে তথ্যের সুরক্ষা বিল এনেছে তারা। যা খতিয়ে দেখছে সংসদীয় স্থায়ী কমিটি। কিন্তু ইউরোপ, এমনকি খোদ মার্কিন মুলুকের নিয়ন্ত্রক যে ভাবে তথ্যপ্রযুক্তি বহুজাতিকগুলিকে কাঠগড়ায় তোলে, তার উপযুক্ত পরিকাঠামো এ দেশে কোথায়?
চিনের সঙ্গে সম্পর্কে চিড় চওড়া হতেই অনলাইন পণ্য-পরিষেবার বাজার ধরতে বিপুল উৎসাহে ঝাঁপিয়েছে ডোনাল্ড ট্রাম্পের দেশের সংস্থাগুলি। মুকেশ অম্বানীর জিয়ো প্ল্যাটফর্মে লগ্নি করছে গুগল। ভারতে ৫-৭ বছরে ৭৫ হাজার কোটি টাকা ঢালবে তারা। এ দেশে তাদের পেমেন্ট অ্যাপকে জনপ্রিয় করতে মরিয়া ফেসবুক। নতুন ১০টি পণ্য মজুত কেন্দ্র তৈরির কথা জানিয়েছে অ্যামাজ়ন। ফ্লিপকার্টে লগ্নি বাড়িয়ে অনলাইন খুচরো ও পাইকারি বাজারের জমি ধরতে চাইছে ওয়ালমার্টও।
দিল্লি স্কুল অব ইকনমিক্সের অধ্যাপক দিব্যেন্দু মাইতি বলছেন, “চিনা পণ্যে ভারতের বাজার ভেসে যাওয়ার ভয় হয়তো অসঙ্গত নয়। তবে ভারতীয় পণ্যের জন্য অন্তত এপ্রিল পর্যন্ত দরজা হাট বেশি ছিল পড়শি মুলুকেই (বিস্তারিত সঙ্গের সারণিতে)।” তাঁর মতে, ‘আত্মনির্ভর ভারত’ নির্মাণে ছোট ব্যবসায় জোর দেওয়ার কথা বলছেন খোদ প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু ইতিহাস সাক্ষী, দর থেকে বিক্রিবাটার শর্ত পর্যন্ত প্রায় সব বিষয়ে এই সব রিটেল-দৈত্যদের সামনে হাঁটু গেড়ে বসতে বাধ্য হয় বহু বড় সংস্থাও। তাই অ্যামাজ়ন, ওয়ালমার্টের সঙ্গে দর কষাকষিতে এঁটে উঠে তাদের প্ল্যাটফর্মে ওই সব ছোট সংস্থা কতটা নিজের শর্তে ব্যবসা করতে পারবে, সেই সংশয় থাকছেই।
সংশ্লিষ্ট মহল বলছে, সীমান্তে খবরদারির সাজা চিন অবশ্যই পাক। কিন্তু সেই সুযোগে আত্মনির্ভর শেষে আমেরিকা-নির্ভর হয়ে উঠবে না তো?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy