আবৃত্তিচর্চা করব কেন? সবাই কি আমরা পেশাদার আবৃত্তিকার হব? তা নয়। আবৃত্তিচর্চা আমাদের বাচনভঙ্গিকে সুন্দর করে, আমাদের কথাকে সুন্দর করে মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়। একজন ডাক্তার যদি আপনার সঙ্গে ভাল করে কথা বলেন, আপনার কি ভাল লাগবে না? হয়তো, মুহূর্তের জন্যও আপনার মনে হবে, ওই সব অসুখ-টসুখ সব মিথ্যে। আমার একজন ছাত্র ছিলেন—উকিল। তিনি বলতেন আবৃত্তিচর্চা তাঁর পেশায় সাহায্য করে। আবৃত্তিচর্চা স্মৃতি বাড়ায়। আর সেই সঙ্গে বাড়ায় আত্মবিশ্বাস।
একটা গল্প দিয়ে শুরু করা যাক। গল্পটা আমরা সবাই কম-বেশি জানি। বাল্মীকির গল্প। রত্নাকরের তখন রূপান্তর ঘটেছে বাল্মীকিতে। তমসা নদীর ধারে একটি গাছে দেখলেন একজোড়া ক্রৌঞ্চ, বাংলায় যাকে বলে কোঁচবক। আরও দেখলেন, মিথুনাবদ্ধ ক্রৌঞ্চ দুটিকে বধ করতে উদ্যত হয়েছে এক ব্যাধ। বাল্মীকির মুখ থেকে উচ্চারিত হল সেই আদি শ্লোক, ‘‘মা নিষাদ প্রতিষ্ঠাং তমোগম : শাশ্বতী সমা :। যদক্রৌঞ্চমিথুনাদেকমবধি নাম মোহিতম।।’’ সেই কি আমাদের প্রথম কবিতা? আবৃত্তির জন্মক্ষণ? হয়তো বা। কিংবা আবৃত্তির জন্ম আরও আগে। বৈদিক ঋষিরা তো বেদমন্ত্র আবৃত্তিই করতেন। সে আবৃত্তির নির্দিষ্ট ছন্দ ছিল, স্বরের নির্দিষ্ট ওঠাপড়া ছিল। কিংবা আরও আগে হয়তো লেখা হয়েছিল অন্য কোনও কবিতা—যার খবর আমরা জানি না। যে দিন থেকে কবিতার জন্ম, সে দিন থেকে আবৃত্তিরও জন্ম। যখন লেখা ছিল না, তখনও কণ্ঠ থেকে শ্রুতিতে, শ্রুতি থেকে স্মৃতিতে ছড়িয়ে যেত ছন্দোবদ্ধ শব্দেরা।
লিখিত রূপেও চাপা পড়েনি কবিতার এই কণ্ঠাশ্রয়ী রূপ। চারণকবিদের কথা আমরা জানি। আমাদের গ্রামে গ্রামে ছিলেন কথকঠাকুরেরা। পথের পাঁচালীর হরিহরের কথা মনে পড়ে? কাশীর ঘাটে তার কথকতা টেনে আনত মানুষকে। বাবার কথকতায় আবিষ্ট হত কিশোর অপুও। আমাদের রাজসভায় ছিলেন সভাকবির দল। সিরাজদৌল্লার সভাতেও দেখা পাওয়া গেছে তাদের। রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের সভার কাব্যপাঠের আসর ছিল রীতিমতো বিখ্যাত। এ সবই আবৃত্তির মধ্যে পড়ে। এখনকার আবৃত্তিশিল্পের আগের চেহারা।
বাংলা আবৃত্তিতে আধুনিক ধারাটি ঢুকল ইংরেজের হাত ধরে। ডিরোজিওর ভাবগর্ভ কাব্যপাঠ মুগ্ধ করেছিল, অনুপ্রাণিত করেছিল তখনকার ছাত্রদের। শিক্ষিত বাঙালিরা তখন কথার মধ্যে লাগসই উদ্ধৃতি আবৃত্তি করতেন। মধুসূদন দত্ত কবিতা আবৃত্তি করতে ভালবাসতেন। এখানকার বিভিন্ন কলেজে আবৃত্তিচর্চার রেওয়াজ ছিল সেই হিন্দু কলেজের আমল থেকে। তখনকার কয়েক জন আবৃত্তিকারের নাম মনে পড়ছে—মলিনা দেবী, সন্তোষ সিংহ, জয়নারায়ণ মুখোপাধ্যায়, প্রভাবতী দেবী। গত শতাব্দীর শুরুতে তৈরি হল ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউট। শিশির কুমার ভাদুড়ি ছিলেন এই প্রতিষ্ঠানের প্রথম দিকের সদস্য। বাংলা ও ইংরেজি আবৃত্তি তাঁর মুখে সবসময় শোনা যেত। সংস্কৃত ভাষায় খুব ভাল আবৃত্তি করতেন সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়। আকাশবাণী প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে আবৃত্তিতে পেশাদারিত্বের ছোঁয়া পড়ে। গণনাট্য সংঘ, গণতান্ত্রিক লেখক সংস্থা আবৃত্তিকে একটি গণসংস্কৃতির মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করেন।
কবিরা অনেকেই ভাল আবৃত্তিকার ছিলেন। সুকান্ত ভট্টাচার্য অনেক তাৎক্ষণিক স্বরচিত কবিতা আবৃত্তি করে শ্রোতাকে উদ্বুদ্ধ করতেন। স্বাধীনতা আন্দোলনের পটভূমিতে একই কাজ করতেন নজরুল ইসলাম। ১৯৪১ সালের ২২ শ্রাবণ রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় লিখেছিলেন ‘রবি-হারা’। সেই কবিতার আবৃত্তি ছড়িয়ে পড়েছিল বেতার তরঙ্গে। আর রবীন্দ্রনাথ? তিনি যে কত ভাল আবৃত্তি করতেন তা তাঁর আবৃত্তির রেকর্ড শুনলেই বোঝা যায়। ছোটদের কবিতা আবৃত্তির আগে দু’চার কথা বলে তৈরি করেছেন গল্প বলার আমেজ। ‘বীরপুরুষ’-এর আগে বলে নিয়েছেন কয়েক লাইন—অনেকটা প্রদীপ ধরানোর আগে সলতে পাকানোর মতো। তাতে অনেক বেশি প্রাণসঞ্চার হয়েছে কবিতাটিতে। একবার তিনি জোড়াসাঁকোর বাড়িতে বিচিত্রার আসরে পাখোয়াজ ব্যবহার করেছিলেন কবিতা আবৃত্তির সঙ্গে। আবৃত্তি সম্পর্কে তাঁর লেখা একটি গদ্যাংশ উদ্ধৃত করতে চাইছি। তিনি লিখেছিলেন, ‘‘কবিতা আবৃত্তিতে ভাল আবৃত্তিকারকের সম্বন্ধে শ্রোতার মনে একটা বিশেষ মোহ উৎপন্ন করে। সেই কবিতার ভাবটি তাহার পাঠককে মহিমা দান করে—সেটা যেন তাহার নম্বর, তাহার মুখশ্রী, তাহার চরিত্রের সঙ্গে জড়িত হইয়া দেখা দেয়, ফুল যেমন গাছের শাখায়, তেমনই কবিতাটিও আবৃত্তিকারদের মনে ফুটিয়া উঠিয়া তাহাকে বিশেষ সম্পদ দান করে।’’
এ সব তো গেল আবৃত্তিচর্চার গোড়ার কথা। এ বার কণ্ঠস্বর নিয়ে একটু বলি। আবৃত্তির জন্য সবসময় গম্ভীর ভরাট স্বর বা মিষ্টি স্বর দরকার—এ ধারণাটি ঠিক নয়। এগুলো বাড়তি সুবিধে। আসলে যার গলার যেমন চরিত্র, তেমনটা ধরে রাখাই ভাল। কেউ কেউ খুব গম্ভীর ভাবে নিম্নগ্রামে কথা বলেন। এ ধরনের গলাকে বলে ব্যাসটোন। দেবব্রত বিশ্বাসের গলাটি এ ধরনের। মাঝামাঝি স্কেলে বা মধ্যগ্রামে উচ্চারিত গলা ছিল হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের। এ ধরনের গলার পোশাকি নাম ব্যারিটোন। আর মান্না দে গান গাইতেন উচ্চগ্রামে—তাঁর কণ্ঠস্বরকে বলে টেনর। মহিলাকণ্ঠ হলে নামগুলো পাল্টে যায়। তখন নিচুস্বরকে বলে কনট্রালটো, মধ্যগ্রামকে বলে মোজোসোপ্রানো আর উচ্চগ্রামকে বলে সোপ্রানো। সঙ্গীতশিল্পীরা যার যেমন গলা সেই গলাতেই গাইবেন। আবৃত্তির জন্যও সেটাই দরকার। কণ্ঠস্বরকে কৃত্রিম ভাবে বদলানোর দরকার নেই। আবৃত্তির জন্য দরকার স্বাভাবিক, শিক্ষিত, সক্ষম ও সচল স্বর।
আজ এই পর্যন্ত। পরের দিন স্বরক্ষেপণ ও কণ্ঠস্বর নিয়ে আলোচনা করা যাবে।
আবৃত্তির ক্লাস নিয়ে কোনও প্রশ্ন আছে আপনার? সরাসরি জেনে নিন ব্রততী বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে। bratatiblog@gmail.com-এ
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy