জর্জ হ্যারিসনের সঙ্গে বব ডিলান।
উনিশশো একাত্তর সাল। বাংলাদেশ জুড়ে পাকিস্তানী সেনা আর আল বদর রাজাকারদের তাণ্ডব। অসহায় মানুষগুলো পূর্ব পাকিস্তানের সীমানা পেরিয়ে আশ্রয় নিচ্ছেন ভারতের বিভিন্ন জায়গায়। তাদের সংখ্যা প্রায় এক কোটি। নিরীহ, নিরস্ত্র জনগণের ওপর নির্বিচারে পাকিস্তানি বাহিনীর গণহত্যার খবর ছড়িয়ে পড়ছে বিশ্বব্যাপী। কিন্তু মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের বিষয়টি নিয়ে কোনও হেলদোল নেই যুক্তরাষ্ট্রের। চীনও রহস্যময়। কিন্তু জীবন বাজী রেখে লড়ছেন মুক্তিযাদ্ধারা।
যুক্তরাষ্ট্র সেই সময় পরোক্ষে পাকিস্তানের নারকীয় গণহত্যার পক্ষে অবস্থান নিলেও জর্জ হ্যারিসন, বব ডিলানরা রুখে দাঁড়িয়েছিলেন নিজ রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে। ছিলেন রবিশঙ্করও। বাংলাদেশের মুক্তিকামী মানুষের পক্ষে তাঁরা কণ্ঠে তুলে নিয়েছিলেন গানের অস্ত্র। বব ডিলান তাই বাংলাদেশের রক্তের বন্ধু। সেই কনসার্টের প্রতিটি মানুষ আমাদের রক্তের স্বজন- জন্মকালের স্বজন।
রবিশঙ্কর বাংলায় ‘জয় বাংলা’-সহ বেশ কিছু গান বাঁধেন। এ সময়ে অ্যাপেল রেকর্ড থেকে একটি গানের অ্যালবামও প্রকাশ করান। কিন্তু সঙ্কটের ভয়াবহতার পরিপ্রেক্ষিতে এই রেকর্ড বিক্রির পর সামান্য অর্থ আসে। মুক্তিযুদ্ধকালের মে মাসে তিনি সিদ্ধান্তে আসেন বড় আয়োজনের, তিনি তার বন্ধু জর্জ হ্যারিসনের সঙ্গে একটা চ্যারিটি কনসার্টের আয়োজনের ভাবনা ভাগ করেন। হ্যারিসনও রাজি।
কনসার্টের টিকিট।
সারাটা জীবন গান লিখে আর গান গেয়ে বৃহস্পতিবার সাহিত্যে নোবেল পেলেন ৭৫ বছর বয়সী মার্কিন গায়ক বব ডিলান। পাকিস্তানি বর্বরতা থেকে মুক্তিপ্রত্যাশী বাংলার মানুষদের জন্য কিছু করার তীব্র তাগিদ থেকেই তখনকার সময়ের যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের মানুষের সাহায্যার্থে ম্যাডিসন স্কোয়ার গার্ডেনে আয়োজন করেছিলেন ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’। বিটলসের পোস্টারে জর্জ হ্যারিসন, বব ডিলান ও পণ্ডিত রবিশঙ্কর-সহ অনেকেই সেদিন বাদ্যযন্ত্রকে হাতিয়ার করেছিলেন মানবতার জন্য। এলেন গিন্সবার্গ যেমন যশোর রোডে হেঁটেছেন, তেমনই বহু দূরের ম্যাডিসন স্কোয়ারে শব্দযন্ত্র আর কণ্ঠকে হাতিয়ার করে হয়েছিল আরেক মুক্তিযুদ্ধ।
এই কনসার্ট হতে প্রায় আড়াই লক্ষ মার্কিন ডলার সংগ্রহ হয়েছিল। যার পুরোটাই ইউনিসেফের তত্ত্বাবধানে বাংলাদেশের জন্য দিয়ে দেওয়া হয়। পরে সিডি ও ডিভিডি হতে প্রাপ্ত অর্থও ইউনিসেফের ফান্ডে জমা করা হয়।
জর্জ হ্যারিসন ও রবিশঙ্কর যে কনসার্ট ফর বাংলাদেশ আয়োজন করেছিলেন, সেই আয়োজনের মধ্য দিয়েই সারা দুনিয়ায় পাকিস্তানিদের বর্বরতা প্রকাশিত হয়। বাংলাদেশের গণহত্যার কথা, নারীর প্রতি অত্যাচারের বিষয়টি সামনে আসে সবার। আয়োজনের পরিকল্পনায় ছিলেন পণ্ডিত রবিশঙ্কর। তখন তিনি থাকতেন ক্যালিফোর্নিয়ার হলিউডে। ভারতে বাংলাদেশের উদ্বাস্তু মানুষের জন্য কেঁদে উঠেছিলো তার সেতার।
বাংলাদেশের একটি কাগজে হ্যারিসন স্মৃতিচারণা করে বলেছিলেন, জন লেননই তাঁকে বিটলসের ভাবমূর্তি কাজে লাগানোর কথা জোর দিয়ে বলেন...। পরবর্তী কয়েক সপ্তাহে হ্যারিসন কাটিয়ে দেন সংগীতজ্ঞদের তালিকা বানাতে। নিউইয়র্কের ম্যাডিসন স্কোয়্যার গার্ডেনে ১৯৭১ সালের ১ অগস্ট কনসার্টের তারিখ।
তাঁরা এ সময়ে বিশ্বব্যাপী নামী শিল্পীদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। সাড়া দিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম সারির সঙ্গীতশিল্পীদের একজন বব ডিলান কনসার্টে অংশগ্রহনে সম্মতি জানান। প্রাক্তন বিটলস সদস্য রিঙ্গো স্টার-সহ বিলি প্রেস্টন ও লিওন রাসেল ও বিশ্বের সেরা গিটারিস্ট ব্রিটিশ গায়ক এরিক ক্ল্যাপটন। জার্মান বাদ্যকার ক্লাউস ভুরম্যান, মার্কিন ড্রামার জিম কেল্টনার, জিম হর্নসের নেতৃত্বে ‘হলিউড হর্নস’ দল, গিটারিস্ট জেসি এড ডেভিস, ডন প্রেস্টন, কার্ল রেডল ও অনেক শিল্পী। আর কনসার্টের প্রথমেই পণ্ডিত রবিশঙ্করের সঙ্গে অংশ নেন ওস্তাদ আলী আকবর খান এবং আল্লাহ রাখা।
এই অনুষ্ঠানেই বব ডিলানের গিটারে বাজল বাংলাদেশের মুক্তির গান। কনসার্টে ডিলান একে একে গেয়েছিলেন পাঁচটি গান ‘আ হার্ড রেইনস আ-গনা ফল’, ‘ব্লোয়িং ইন দ্য উইন্ড’, ‘ইট টেকস আ লট টু লাফ’, ‘লাভ মাইনাস জিরো’ এবং ‘জাস্ট লাইক আ ‘ওম্যান’।‘ব্লোয়িং ইন দ্য উইন্ড’ এর গুঞ্জন প্রতিবাদী করে তুলেছিল সারা পৃথিবীর মুক্তিকামী মানুষকে।
বব ডিলান ও জর্জ হ্যারিসন তখন মঞ্চে।
কনসার্টের শুরুতে পণ্ডিত রবিশঙ্কর বলেন, “আমরা কোনও রাজনীতি করতে আসিনি। আমরা শিল্পী। আমরা শুধু এই অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে একটি বার্তা পৌঁছে দিতে সমবেত হয়েছি। আমরা চাই আমাদের সঙ্গীত বাংলাদেশের মানুষদের তীব্র বেদনা ও মনোযন্ত্রণা অনুভব করতে আপনাদের সাহায্য করুক।”
৪০ হাজার দর্শকের সামনে কনসার্টে সেই সময়ে শিল্পীদের জন্য কিছুটা হলেও মানসিক চাপ তৈরি হলেও বাংলাদেশের প্রতি ভালবাসা সেই চাপ ভুলিয়ে দিয়েছিল।
এই কনসার্ট নিয়ে মার্কিনী তরুণদের ছিল তুমুল আগ্রহ। আসনের জন্য দর্শকরা ম্যাডিসনে মঞ্চের কাছে কয়েক দিন আগে থেকেই প্রতিক্ষায় ছিলেন। দর্শকেরা বোঝেন, শিল্পীরা সকলের কাছে আহ্বান করছেন বাংলাদেশের মানুষের পাশে থাকতে, রুখে দাঁড়াতে। এই আহ্বান বিশ্বজুড়ে সাড়া ফেলে দিয়েছিল।
পাকিস্তানিদের হাত থেকে এই ভূখণ্ডের আকাঙ্খার বাস্তবায়নে কনসার্টটির প্রভাব ছিল অপরীসিম। রবিশঙ্কর পরে এর অভাবনীয় সাফল্য সম্পর্কে বলেছিলেন, “এক দিনের মধ্যে, গোটা বিশ্ব বাংলাদেশের নাম জেনেছিল। এটা ছিল এক অসাধারণ আয়োজন।”
যুক্তরাষ্ট্রের পশ্চিমের অঙ্গরাজ্য মিনেসোটার এক খনি শহরে জন্ম ডিলানের। বাবা আব্রাহাম জিমারম্যান। বব ডিলানের আসল নাম ছিল রবার্ট অ্যালেন জিমারম্যান। সবাই ছেলেটিকে চিনত জিম নামে।
দেখুন ভিডিও
সঙ্গীতের প্রতি জিমের টান শুরু হয় ১১ বছর বয়সে পিয়ানো বাজানোর মধ্য দিয়ে। ১৯৬০ সালের শুরুতে জিম হাইস্কুল শেষ করে মিনেসোটা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। এই বিশ্ববিদ্যালয়েই প্রথম গানের দল গড়ে তোলেন জিম, আর নিজেকে পরিচয় দিতে শুরু করেন বব ডিলান নামে। ওই সময়েই ডিলান অ্যাকুয়েস্টিক গিটার বাজিয়ে গাইতে শুরু করেন।
বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে গানের টানেই ডিলান চলে আসেন নিউ জার্সিতে। তখন থেকেই ব্যতিক্রমী গায়কী আর হৃদয়গ্রাহী গানের কথায় সঙ্গীতাঙ্গনে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার শুরু। ষাটের দশকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গীতাঙ্গনে ডিলান ছিলেন এক অবিসংবাদিত নাম।
গানের মধ্য দিয়ে দ্রোহ আর মানুষের অনুভূতি ফুটিয়ে তোলার জন্য ডিলান বিশ্বজুড়ে অনেক পুরস্কার ও সম্মানে ভূষিত হয়েছেন। নোবেলের আগে সম্প্রতি মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা তাঁকে সম্মানিত করেছেন সর্বোচ্চ বেসামরিক পদক ‘প্রেসিডেন্টশিয়াল মেডেল অব ফ্রিডম’ দিয়ে।
আরও পড়ুন: জীবনের জয়-গানে... সাহিত্যে নোবেল ডিলানকে
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy