ব্যাহত হতে পারে জিপিএস ব্যবস্থা, রেডিয়ো যোগাযোগ, মোবাইল পরিষেবাও। -ফাইল .ছবি।
যেমন পূর্বাভাস ছিল কলকাতার বিজ্ঞানীদের, ঠিক তেমনটাই ঘটল।
প্রায় সাড়ে ৯ কোটি মাইল দূরের সূর্য থেকে ছুটে এসে পৃথিবীর উপর হামলা চালাল ভয়ঙ্কর শক্তিশালী হানাদাররা। ভারতীয় সময় বৃহস্পতিবার দুপুরে। এই হানাদারি চলবে শনি ও রবিবারও। পূর্বাভাস বলছে, সৌরঝলকের সঙ্গে রবিবার পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্রের উপর আছড়ে পড়তে পারে সূর্যের ‘মাংস’ (‘প্লাজমা)’ উপরে নিয়ে আসা আরও এক ধরনের সৌর হানাদার ‘করোনাল মাস ইজেকশান (সিএমই)’-ও।
এই ঘটনায় ঝনঝন করে কেঁপে উঠবে পৃথিবীর চার পাশে থাকা চৌম্বক ক্ষেত্র। দুই মেরুতে আরও ঘনঘন আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠতে দেখা যাবে মেরুজ্যোতি। এই হানাদারদের জন্য কিছু ক্ষণের জন্য হলেও বিপর্যস্ত হয়ে পড়তে পারে গোটা ভারতীয় উপমহাদেশ, দক্ষিণ মেরু, উত্তর আমেরিকা, ইউরোপ ও উত্তর মেরুর যাবতীয় রেডিয়ো যোগাযোগ ব্যবস্থা। ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে বিশ্বের একাংশের বিদ্যুৎ সংযোগ ব্যবস্থাও। ব্যাহত হতে পারে জিপিএস-মোবাইল-বিদ্যুৎ পরিষেবাও।
সৌরপদার্থবিজ্ঞানের পরিভাষায় এই হানাদারদের নাম 'সৌরঝলক' (‘সোলার ফ্লেয়ার’)। যা সূর্য থেকে সঙ্গে নিয়ে বেরয় প্রাণের পক্ষে অত্যন্ত বিপজ্জনক শক্তিশালী প্রচুর কণা। যাদের নাম সৌরকণা (‘সোলার পার্টিকল’)। আমরা যাকে সৌরঝড় (‘সোলার স্টর্ম’) বলে জানি, তার অন্যতম কারণ এই সৌরঝলক।
হামলা চলবে শনিবার রাত পর্যন্ত
এই সৌর হানাদারদের হামলা চলবে ভারতীয় সময় রবিবার সকাল পর্যন্ত। পৃথিবীকে চার পাশ থেকে ঘিরে রেখেছে যে অত্যন্ত শক্তিশালী চৌম্বক ক্ষেত্র, তার উপর। তাতে ঝনঝন করে কেঁপে উঠবে পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্র। সৌরকণাদের ঢুকতে পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্র বাধা দিতে চাইবে। তাতে সৌরঝলকের সঙ্গে থাকা সৌরকণাদের সঙ্গে ‘সংঘর্ষ’ই দৃশ্যমান হবে পৃথিবীর দুই মেরুতে উজ্জ্বলতর মেরুজ্যোতি (‘অরোরা’)-র মাধ্যমে। বিশেষজ্ঞদের পূর্বাভাস, এই সৌরঝড়ের সঙ্গী হতে পারে সূর্যের ‘মাংস’ (বায়ুমণ্ডলের অত্যন্ত উত্তপ্ত ‘প্লাজমা’) উপড়ে আনা আর এক হানাদারও। যার নাম- করোনাল মাস ইজেকশান।
Spectacular eruption from the Sun today, 18 years after the famous Halloween storms on October 28, 2003: https://t.co/obKmSnVbk2 pic.twitter.com/LiuWPUSo3d
— SOHO_Mission (@MissionSoho) October 28, 2021
ব্যাহত হতে পারে ভারত-সহ বিশ্বের রেডিয়ো, টেলি যোগাযোগ ব্যবস্থা
বিশেষজ্ঞদের প্রবল আশঙ্কা, যার ফলে, কিছু ক্ষণের জন্য হলেও বিপর্যস্ত হয়ে পড়তে পারে গোটা ভারতীয় উপমহাদেশ, দক্ষিণ মেরু, উত্তর আমেরিকা, ইউরোপ ও উত্তর মেরুর যাবতীয় রেডিয়ো যোগাযোগ ব্যবস্থা। ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে বিশ্বের একাংশের বিদ্যুৎ সংযোগ ব্যবস্থাও। ক্ষয়ক্ষতির ধাক্কা সইতে হতে পারে পৃথিবীর বিভিন্ন কক্ষপথে থাকা কৃত্রিম উপগ্রহগুলির অত্যন্ত প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশগুলিকে। যার জেরে ব্যাঘাত ঘটতে পারে উপগ্রহের মাধ্যমে জিপিএস ব্যবস্থা, ভূপর্যবেক্ষণ, এমনকি মোবাইল যোগাযোগ ব্যবস্থাও।
কৃতিত্ব আইসার কলকাতার বিজ্ঞানীদের
বঙ্গোপসাগরের সাইক্লোন কোন সময়ের মধ্যে আছড়ে পড়তে পারে, পশ্চিমবঙ্গের সমুদ্রোপকূলে এখন যেমন তার নিখুঁত পূর্বাভাস দেওয়া সম্ভব হয়, তেমনই এ বার কলকাতার বাঙালি বিজ্ঞানীদের পূর্বাভাস মিলিয়ে দিল প্রায় সাড়ে ৯ কোটি মাইল দূরের সূর্যের ঠিক কোন অংশ থেকে বেরিয়ে পৃথিবীর দিকে ছুটে আসতে পারে ভয়ঙ্কর সৌরঝলক আর তা কতটা ভয়াবহ হতে পারে, শক্তির নিরিখে তা কতটা বিপজ্জনক হতে পারে। পূর্বাভাসটি দিয়েছিলেন মোহনপুরের ‘ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চ (আইসার কলকাতা)’-এর সৌরপদার্থবিজ্ঞানী অধ্যাপক দিব্যেন্দু নন্দী ও তাঁর গবেষক ছাত্রশুভদীপ সিন্হা। মাত্র দিন চারেক আগে।
যা মিলতে শুরু করেছে ভারতীয় সময় বৃহস্পতিবার দুপুর থেকেই। সূর্য থেকে ছুটে আসতে শুরু করেছে একের পর এক ভয়ঙ্কর সৌরঝলক।
কী কী ক্ষতির আশঙ্কা এই হামলায়?
যা আছড়ে পড়ার ফলে ইতিমধ্যেই ভারতীয় সময় বৃহস্পতিবার গভীর রাতে আমেরিকার একাংশে এক ঘণ্টার জন্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে রেডিয়ো যোগাযোগ ব্যবস্থা। কলকাতার বাঙালি বিজ্ঞানীদের পূর্বাভাস যদি একেবারে নিখুঁত প্রমাণিত হয় শেষ পর্যন্ত, তা হলে ভারতীয় সময় শনিবার গভীর রাতের মধ্যে পৃথিবীর দিকে ধেয়ে আসতে চলেছে আরও একটি শক্তিশালী সৌরঝড়। আছড়ে পড়তে চলেছে সূর্যের ‘মাংস’ (সূর্যের বায়ুমণ্ডলের ‘প্লাজমা’) উপড়ে আনা সিএমই-ও।
আর ‘‘তা হলে উত্তর আমেরিকা তো বটেই, গোটা ভারতীয় উপমহাদেশ, দক্ষিণ মেরু, ইউরোপ ও উত্তর মেরুর যাবতীয় রেডিয়ো যোগাযোগ ব্যবস্থাও পড়বে বিপদের মুখে। ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে বিশ্বের একাংশের বিদ্যুৎ সংযোগ ব্যবস্থাও। ক্ষয়ক্ষতির ধাক্কা সইতে হতে পারে পৃথিবীর বিভিন্ন কক্ষপথে থাকা কৃত্রিম উপগ্রহগুলির অত্যন্ত প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশগুলিকেও’’, ‘আনন্দবাজার অনলাইন’-কে শুক্রবার বলেছেন দিব্যেন্দু।
//CESSI PREDICTION UPDATE//28 OCTOBER 2021// On 25 October we predicted that solar active region #AR12887 is likely to produce C/M/X class flares with M/X flare potential. Observations confirm our predictions. Event history from @LockheedMartin Solar & Astrophysics lab
— Center of Excellence in Space Sciences India (@cessi_iiserkol) October 28, 2021
+ https://t.co/CbVcqg0t8R pic.twitter.com/wrxWvk0LYO
কী ছিল পূর্বাভাস?
শুভদীপ ও দিব্যেন্দু জানাচ্ছেন, তাঁদের পূর্বাভাস ছিল এই সৌরঝলকগুলি বেরিয়ে আসবে সূর্যের দক্ষিণ মেরুর দিকের বিশেষ একটি অংশ থেকে। গত বছরের মাঝামাঝি থেকে ১১ বছরের নতুন সৌরচক্র (‘সোলার সাইক্ল’) শুরু হওয়ার পর সূর্যের ওই অংশে তৈরি হয়েছে নতুন একটি 'সৌরকলঙ্ক' (‘সানস্পট’)। সৌরপদার্থবিজ্ঞানের পরিভাষায় যার নাম- ‘এআর-২৮৮৭’। সৌরকলঙ্কের উপরে সূর্যের বায়ুমণ্ডল (‘সোলার করোনা’)-এর নীচের স্তর ক্রোমোস্ফিয়ার ও তার উপরের স্তরগুলি থেকেই বেরিয়ে আসে বিভিন্ন শক্তির সৌরঝলক।
শুভদীপ ও দিব্যেন্দুর কথায়, ‘‘আমাদের পূর্বাভাস ছিল ‘এআর-২৮৮৭’ সৌরকলঙ্কটি থেকে বেরিয়ে আসবে খুব শক্তিশালী ‘এক্স’ শ্রেণির সৌরঝলক। তার সঙ্গে বেরিয়ে আসবে মাঝারি পাল্লার শক্তির ‘এম’ শ্রেণির সৌরঝলক। বেরিয়ে আসবে অল্প শক্তির ‘সি’ শ্রেণির সৌরঝলকও। সেটাই হয়েছে। ভারতীয় সময় বৃহস্পতিবার গভীর রাতে যে ক'টি সৌরঝলক পৃথিবীর শক্তিশালী চৌম্বক ক্ষেত্রের উপর আছড়ে পড়েছে, তার মধ্যে একটি ছিল খুব শক্তিশালী। ‘এক্স-ওয়ান’ শ্রেণির সৌরঝলক। সঙ্গে ছিল দু’টি মাঝারি পাল্লার শক্তির ‘এম’ শ্রেণির সৌরঝলক। একটি ‘এম’ শ্রেণির সৌরঝলক আছড়ে পড়েছে ভারতীয় সময় বৃহস্পতিবার গভীর রাতে, ভারত মহাসাগরের উপর পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্রে। ‘এম’ শ্রেণির দ্বিতীয় সৌরঝলকটি আছড়ে পড়েছে আফ্রিকার উপর। আর খুব শক্তিশালী ‘এক্স-ওয়ান’ শ্রেণির সৌরঝলকটি আছড়ে পড়েছে দক্ষিণ আমেরিকার উপর। বৃহস্পতিবার রাতেই।’’
শুভদীপ ও দিব্যেন্দু ‘আনন্দবাজার অনলাইন’-কে জানাচ্ছেন, ভারতীয় সময় রবিবার সকাল পর্যন্ত আরও কয়েকটি সৌরঝলক এসে আছড়ে পড়তে পারে পৃথিবীর উপর। এর মধ্য়ে সবচেয়ে শক্তিশালী সৌরঝলক থেকে একটি সৌরঝড় বেরিয়ে পড়ে পৃথিবীর দিকে ছুটতে শুরু করেছে। তাঁদের পূর্বাভাস বলছে, সেই সৌরঝড়ই শনিবার রাতে আছড়ে পড়বে পৃথিবীর বুকে।
Very impressed. So while most eyes were on the NE region this model said wait a minute. Region 2887 is the one to watch. Hard to argue with the result. Look forward to further predictions.
— Jim Hughes windweather sun and stratosphere (@JimWindweather) October 28, 2021
পূর্বাভাস মিলল কোথায় কোথায়?
বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, এই পূর্বাভাস অন্তত দু’টি জায়গায় মিলে গিয়েছে। এক, সূর্যের ঠিক কোন অংশ থেকে বেরিয়ে আসতে পারে শক্তিশালী সৌরঝলক মোটামুটি কোন সময়ের মধ্যে তা অন্তত দিন তিন-চার আগেই বলে দেওয়া সম্ভব হয়েছে। দুই, শক্তির নিরিখে এই সৌরঝলকগুলি হবে কোন কোন শ্রেণির তাও সঠিক ভাবে বলে দেওয়া গিয়েছে। আর তা মিলেও গিয়েছে।
আগামী দিনে কী কী সুবিধা হবে?
এর ফলে, আগামী দিনে আরও নিখুঁত ভাবে সূর্য থেকে ছুটে আসা হানাদারদের মতিগতি অনেক আগেভাগে বোঝা যাবে। তার ফলে সেগুলি থেকে পৃথিবী ও তার কক্ষপথে থাকা উপগ্রহগুলির যন্ত্রাংশগুলিকে বাঁচানোর জন্য পর্যাপ্ত সময়ও পাওয়া যাবে।
ছবি সৌজন্যে- ‘সেসি’,আইসার কলকাতা ও নাসার সোলার ডায়নামিক অবজারভেটরি।