দাবদাহ থেকে বাঁচতে ছোট পর্দার শিল্পীরা কী কী সাবধানতা অবলম্বন করছেন? গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
এপ্রিলের মাঝেই শহর কলকাতার তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছুঁয়েছে। রাজ্যের বেশ কিছু জেলায় পাল্লা দিয়ে বাড়ছে গরমের দাপট। সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস ওঠার উপক্রম। কিন্তু টেলিপাড়ায় কর্মব্যস্ততা তুঙ্গে। গরমের কথা মাথায় রেখে ছবি বা ওয়েব সিরিজ়ের কাজ বন্ধ রাখলেও জোরকদমে চলছে ধারাবাহিকের শুটিং। কারণ, মাথায় রাখতে হবে সম্প্রচারের লক্ষ্যমাত্রা। প্রখর দাবদাহে টেলি অভিনেতারা কী ভাবে শুটিং করছেন? গরমকে হার মানাতে কী কী পদক্ষেপ করছেন তাঁরা? খোঁজ নিল আনন্দবাজার অনলাইন।
দীর্ঘ দিন ধরেই ‘জগদ্ধাত্রী’ সিরিয়াল টিআরপি তালিকায় উপরের দিকে রয়েছে। তাই অভিনেতাদের দায়িত্বও বেশি বলে জানালেন অঙ্কিতা মল্লিক অর্থাৎ পর্দার ‘জ্যাস’। আউটডোর শট সেরেই বললেন, ‘‘গরমে নাজেহাল অবস্থা। আমাদের পরিচালক এই মাত্র ইউনিটকে ঠান্ডা হালকা পানীয় দিলেন।’’ ঠাকুরপুকুরের বলাকা স্টুডিয়োয় এই সিরিয়ালের শুটিং চলছে। বাড়ি থেকে কলটাইমের জন্য বেরোনোর সময় অঙ্কিতা সঙ্গে রাখছেন গ্লুকোজ়ের জল। তাঁর কথায়, ‘‘বাড়িতে মা হালকা খাবার তৈরি করে দিচ্ছেন। সেটাই সঙ্গে করে নিয়ে আসছি। ফ্লোরে যতটা গরম এড়িয়ে থাকা যায়, আমরা সেটাই চেষ্টা করছি।’’ টেলিপাড়ার সব শুটিং ফ্লোর এখন শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত। কিন্তু বার বার আসা-যাওয়া করতে করতে অনেকেই সর্দিতে ভুগছেন বলে জানালেন অঙ্কিতা। তাঁর কথায়, ‘‘শুরু থেকেই আমার ঠান্ডা-গরমে গলা ধরার একটা সমস্যা রয়েছে। যাতে গলা না বসে যায়, তাই একটু সাবধানতা অবলম্বন করছি।’’
টেলিপাড়ায় গড়ে দিনে চোদ্দো ঘণ্টা শুটিং হয়। এপিসোড ব্যাঙ্কিংয়ের বাড়তি চাপ মাথায় রেখেই কাজ করতে হয় কলাকুশলীদের। টালিগঞ্জের ইন্দ্রপুরী স্টুডিয়োয় চলছে ‘সোহাগ চাঁদ’ ধারাবাহিকের শুটিং। চাঁদ অর্থাৎ অভিষেক বীর শর্মা যেমন জানালেন, নির্মাতারা গরমের কথা মাথায় রেখেই এক দিনে বেশি শুটিং করে রাখছেন। আবার সুবিধা মতো বিকেলের দিকেও শিল্পীদের কলটাইম দেওয়া হচ্ছে। অভিষেক বললেন, ‘‘ফ্লোর আর বাড়ির খাবার মিশিয়েই খাই। তবে এখন একদম হালকা খাবার খাচ্ছি। খিদে পেলে ফ্লোরে ডাবের জল আর টক দই খাচ্ছি।’’
দাসানি ২ স্টুডিয়োতে চলছে ‘গীতা এলএলবি’ ধারাবাহিকের শুটিং। নামভূমিকায় অভিনয় করছেন হিয়া মুখোপাধ্যায়। তাঁর অভিনীত চরিত্রটি একজন আইনজীবীর। তাই একটু বিপাকে অভিনেত্রী। হিয়া বললেন, ‘‘গরমে কালো কোট ঘামে বার বার ভিজে যাচ্ছে। কিন্তু উপায় নেই। বাড়তি কোটও রাখা হয়েছে। প্রযোজনে বদলে নিচ্ছি।’’ তাঁদের ফ্লোরে আউটডোর শুট থাকলে দ্রুত প্যাকআপ হয়ে যায়, জানালেন হিয়া। গরম থেকে বাঁচতে শুটিং ফ্লোরে প্রচুর পরিমাণে জল খাওয়ার চেষ্টা করছেন তিনি। বললেন, ‘‘গলার কথা ভেবে ঠান্ডা জলে গ্লুকোজ় দিয়ে নয়, সাধারণ জলেই কাজ সারছি। খিদে পেলে মূলত ফলের উপরেই রয়েছি।’’ এই ধারাবাহিকেরই বর্ষীয়ান অভিনেত্রী বাসন্তী চট্টোপাধ্যায় সম্প্রতি গুরুতর অসুস্থ হয়ে দীর্ঘ দিন হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। চলতি সপ্তাহেই তাঁর ধারাবাহিকের শুটিংয়ে ফেরার কথা। কী ভাবে প্রস্তুতি নিচ্ছেন তিনি? বললেন, ‘‘আমি বলে দিয়েছি, এই গরমে খুব বেশি চলাফেরা করতে পারব না। শুটিংয়ের মাঝে আমাকে যেন একটু শোয়ার ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়, সেটাও বলেছি। ওরা রাজি হয়েছে।’’
এই গরমে যে প্রতিদিন শুটিং করা শিল্পীদের পক্ষে একটু কঠিন, সে কথা মেনে নিলেন ‘জল থই থই ভালোবাসা’ ও ‘কার কাছে কই মনের কথা’ সিরিয়ালের অন্যতম প্রযোজক লীনা গঙ্গোপাধ্যায়। তিনি বললেন, ‘‘শুটিং হয় এসি ফ্লোরে। তবে আউটডোরে শিল্পীদের গ্লুকোজ়ের জল দেওয়া হয়। এই মুহূর্তে আমরা চেষ্টা করছি, দিনের বেলায় আউটডোর শুট না করতে।’’ তবে গরম বাড়লে শুটিং বন্ধ রাখার কোনও পরিকল্পনা নেই লীনার। তাঁর কথায়, ‘‘এমন অনেক টেকনিশিয়ান রয়েছেন, যাঁদের বাড়িতে হয়তো এসি নেই। সে ক্ষেত্রে তো শুটিং ফ্লোরেই বেশি আরাম। তা ছাড়া আমাদের সাত দিন সম্প্রচার। শুটিং বন্ধ করলে তো এপিসোডই দিতে পারব না।’’
টেকনিশিয়ানস স্টুডিয়োয় ‘রাম কৃষ্ণা’ ধারাবাহিকের শুটিং চলছে। চরম আবহাওয়ার মধ্যেই শুটিংয়ে মানিয়ে নিচ্ছেন ‘কৃষ্ণা’র চরিত্রাভিনেতা নন্দিনী দত্ত। স্পষ্ট বললেন, ‘‘শুটিং ফ্লোরই তো এখন আমাদের পরিবার। দর্শকের জন্যই তো আজ এখানে রয়েছি। তাই তাঁদের কথা ভেবেই আমরা কাজ করছি।’’ প্রোডাকশন টিমের সদস্যেরা যে এই গরমে তাঁদের বাড়তি খেয়াল রাখছেন, সে কথাও জানালেন নন্দিনী। কম সময়ে যেন আউটডোর শুটিং শেষ করা যায়, সেটাও খেয়াল রাখা হচ্ছে। স্টুডিয়ো থেকে তাঁর বাড়ি কাছে। তাই বাড়ি থেকেই প্রতিদিন খাবার আসে নন্দিনীর জন্য। ইদানীং নিজের ডায়েট মাথায় রেখে সহজপাচ্য খাবারই খাচ্ছেন তিনি। নন্দিনী বললেন, ‘‘ডিহাইড্রেশনের থেকে বাঁচতে ডাবের জল, শসা, টক দই বেশি করে খাচ্ছি।’’
স্টুডিয়োপাড়ায় শুটিংয়ের ফাঁকে ফ্লোরের বাইরে শিল্পীদের আড্ডা চোখে পড়ে। কিন্তু খোঁজ নিয়ে জানা গেল, সেই আড্ডার স্থান এখন ফ্লোর বা মেকআপ রুমেই সীমাবদ্ধ। ইন্ডাস্ট্রির এক কলাকুশলীর কথায়, ‘‘বাইরে বেরোতে পারলে তো আড্ডা-গল্প হবে। তা ছাড়া এই গরমে কাজ করে ইউনিটের প্রত্যেকেই ক্লান্ত হয়ে পড়ছেন। তাই বিরতিতে সকলেই একটু বিশ্রাম নিতে চাইছেন।’’ ফ্লোরে ফ্লোরে খোঁজ নিয়ে জানা গেল, নিতান্ত স্টুডিয়োর বাইরে আউটডোর থাকলে সেখানেও বড় স্ট্যান্ড ফ্যান এবং পর্যাপ্ত ছাতার ব্যবস্থা রাখা হচ্ছে।
ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রা নিয়ে টলিপাড়ার ফেডারেশনও চিন্তিত। বৃহস্পতিবার তারা এই বিষয়ে একপ্রস্ত মিটিং করেছে। আনন্দবাজার অনলাইনের তরফে সংগঠনের সভাপতি স্বরূপ বিশ্বাসের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘‘শুটিং বন্ধ না করে কলাকুশলীরাও যাতে সুস্থ থাকেন, তার জন্য আমরা বেশ কিছু প্রস্তাবনা নিয়ে ইম্পা এবং অন্য নির্মাতাদের কাছে চিঠি দেব। আশা করছি, কোনও সমস্যা হবে না।’’