Poila Baisakh 2024

শুধু বাঙালিরাই ‘কাঁকড়া’র জাত নয়! পয়লা বৈশাখের আড্ডায় একমত টলিপাড়ার পাঁচ অভিনেতা

আনন্দবাজার অনলাইনের আমন্ত্রণে পয়লা বৈশাখের আড্ডায় একঝাঁক টলি তারকা। কথায়, গানে উঠে এল স্মৃতিমেদুরতা এবং বিশেষ দিনটিকে নিয়ে তাঁদের আবেগের কথা।

Advertisement
আনন্দবাজার অনলাইন সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৪ এপ্রিল ২০২৪ ০৭:০০
Eminent Bengali actors share their views on Poila Baisakh

আনন্দবাজার অনলাইনের পয়লা বৈশাখের আড্ডায় (বাঁ দিক থেকে) অনুষা, শন, অপরাজিতা, দেবোত্তম এবং ঈপ্সিতা। — নিজস্ব চিত্র।

রবিবার পয়লা বৈশাখ। তার আগে আনন্দবাজার অনলাইনের বৈশাখী আড্ডার আয়োজন। বিশেষ দিনটিকে ঘিরে নিজেদের মনের কথা জানালেন তারকারা। উপস্থিত ছিলেন অপরাজিতা আঢ্য, শন বন্দ্যোপাধ্যায়, দেবোত্তম মজুমদার, ঈপ্সিতা মুখোপাধ্যায় এবং অনুষা বিশ্বনাথন।

Advertisement

নববর্ষের বিশেষ আড্ডার লোকেশন ছিল লীনা গঙ্গোপাধ্যায়ের ক্যাফে ‘নোয়া’। সময় মতো একে একে হাজির হলেন সবাই। ক্যামেরা চালু হওয়ার আগেই অপরাজিতা তাঁর দক্ষিণী ইন্ডাস্ট্রিতে কাজের সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিলেন। ঈপ্সিতা ও অনুষা তত ক্ষণে একে অপরের ছবি তুলতে ব্যস্ত। নতুন ধারাবাহিকের শুটিং ফ্লোর থেকে শন আসবেন। তাঁর অপেক্ষা শুরু হতে না হতেই হাজির তিনি। শুরু হল আড্ডা।

দেবোত্তম যে ভাল গান গাইতে পারেন, সে কথা ইন্ডাস্ট্রির অনেকেই জানেন। তাঁর গানই যেন অনুষ্ঠানের মূল সুর বেঁধে দিল। দেবোত্তম গেয়ে শোনালেন, ‘তুমি ডাক দিয়েছ কোন সকালে’ রবীন্দ্রসঙ্গীতটি।

আড্ডার শুরুতেই আনন্দবাজার অনলাইনের তরফে অতিথিদের কাছে প্রশ্ন রাখা হয়, সমাজমাধ্যম এবং ব্যস্ত জীবনের মাঝে বাংলা নববর্ষের কি আলাদা কোনও গুরুত্ব রয়েছে? অপরাজিতা কিন্তু বিশ্বাস করেন, সমাজমাধ্যমের যুগে যে কোনও উৎসবেরই আলাদা গুরুত্ব রয়েছেন। তাঁর কথায়, ‘‘মানুষকে দেখানোর জন্যই হোক বা অন্য কোনও কারণে, বছরের বিশেষ দিনগুলোর গুরত্ব হারিয়ে যায়নি। কিন্তু সমাজমাধ্যমের চাপে দিনগুলোর তাৎপর্য এবং মাধুর্য যেন হারিয়ে গিয়েছে।’’ পয়লা বৈশাখের দিন ছেলেবেলাকে মিস্‌ করেন অপরাজিতা। তাঁর কথায়, ‘‘বড়মার হাতের লুচি এবং মুগের ডালের কথা খুব মনে পড়ে। বাবা-মাকে মিস্‌ করি। আর বন্ধুদের সঙ্গে হালখাতা।’’ কথাপ্রসঙ্গেই কে ক’টা মিষ্টির প্যাকেট পেল এবং অধুনা লুপ্তপ্রায় বাংলা ক্যালেন্ডারের কথা উল্লেখ করলেন তিনি।

Image of Sean Banerje and Aparajita Auddy

আড্ডার ফাঁকে শনের সঙ্গে অপরাজিতা। — নিজস্ব চিত্র।

শনের ছাত্রজীবন কেটেছে কলকাতার বাইরে বোর্ডিং স্কুলে। তাই পয়লা বৈশাখের থেকে তিনি সব সময়েই দূরে ছিলেন। তবে দিদার (সুপ্রিয়া দেবী) মুখে দিনটার বিশেষত্ব শুনতেন শন। বললেন, ‘‘নববর্ষ উপভোগ করতে পারিনি। কিন্তু বাড়িতে অনেক কিছু হত।” দৈনন্দিন জীবনে শাড়ি পরতে পছন্দ করেন ঈপ্সিতা। নববর্ষের দিনেও তার ব্যতিক্রম ঘটবে না। অভিনেত্রী বললেন, ‘‘শুটিং না থাকলে বাড়িতে পরিবারের সঙ্গে সময় কাটে। কিন্তু ছেলেবেলায় মামার বাড়িতে চড়কের মেলায় যেতাম। সেই স্মৃতিগুলো ফিরে ফিরে আসে।’’

পয়লা বৈশাখের গুরুত্ব ছেলেবেলায় বুঝতেন না দেবত্তম। তবে বাবার কাছ থেকে তাঁর সহজ শিক্ষা ছিল, ‘‘আজ যে দোকানেই আমরা যাব, সেখানেই কোল্ড ড্রিঙ্ক আর মিষ্টি খাওয়াবে।’’ রবিবার বাংলা বছরের প্রথম দিনে শুটিংয়ে ব্যস্ত থাকবেন অনুষা। ছেলেবেলার স্মৃতি রোমন্থন করে বললেন, ‘‘পয়লা বৈশাখে নতুন পোশাক এবং স্কুলের বন্ধুদের সঙ্গে মজা করতাম।’’ এখন সেই দিনগুলোই মিস করেন বলে জানালেন তিনি।

নববর্ষ মানে শুধুই যে বাঙালির স্মৃতিমেদুরতা, সে কথা মানতে নারাজ অপরাজিতা। তাঁর মতে, এখনও কিছু মানুষের কাছে বছরের বিশেষ দিনগুলো নিয়ে উন্মাদনা বেঁচে রয়েছে। কথাপ্রসঙ্গেই অপরাজিতা বললেন, ‘‘এ বছর আমি তো লাল পাড় সাদা শাড়ি পরব। দীর্ঘ দিন পর আমরা বন্ধুরা দেখা করছি।’’ জানালেন, শৈশবে পাড়ার প্যান্ডেলে সবাই মিলে অনুষ্ঠানের কথা। বললেন, ‘‘কালবৈশাখী আসত। ঝড়ে প্যান্ডেল উড়ে যেত। আমরা মঞ্চে নাচতাম। আর যে সব ছেলেরা আমাদের পছন্দ করত, তারা ভিজে ভিজে অনুষ্ঠান দেখত।’’ অপরাজিতার কথা শুনে তখন আড্ডায় হাসির রোল উঠল।

আড্ডায় উঠে এল বাংলা ভাষা নিয়ে নান মত। বাঙালি বড্ড বেশি আবেগপ্রবণ বা স্মৃতিমেদুরতায় ভোগে বলে মানলেন না অনুষা। তরুণ প্রজন্মের প্রতিনিধি হিসেবে তাঁর যুক্তি, ‘‘স্মৃতিমেদুরতা মানে তো ভালবাসা। সারা বিশ্বে ভাষার প্রতি ভালবাসা থাকে। তার মানেই স্মৃতি। তাই আবেগ থাকলে তো ক্ষতি নেই।’’ বাংলা ভাষা এখন নাকি কোণঠাসা? ঈপ্সিতা বললেন, ‘‘কাজের ভাষা হিসেবে সারা ভারতে ইংরিজি ভাষার গুরুত্ব বেশি। অনেক বাঙালিই ভাষাকে হেয় করেন। সেটা ঠিক নয়।’’ দেবোত্তমের যুক্তি, ‘‘একাধিক ভাষা শিখতে তো দোষ নেই! কিন্তু শিকড়ের ভাষাকে অবজ্ঞা করাটা দুঃখজনক।’’ যেমন অপরাজিতা তাঁর অভিজ্ঞতা প্রসঙ্গেই বললেন, ‘‘তামিলনাড়ুতে গিয়ে দেখেছি যে, মাতৃভাষার প্রতি ওঁদের আলাদা একটা সম্মান রয়েছে। আমি ছোট থেকেই বাংলা মাধ্যমে পড়েছি। শুরুতে আমারও ইংরেজি বলতে অসুবিধা হত। পরবর্তী কালে কাজের জন্য আমাকেও শিখতে হয়েছে।’’ তবে কলকাতায় যদি কেউ তাঁর সঙ্গে অহেতুক ইংরেজিতে কথা বলেন, তাঁকে কিন্তু অপরাজিতা বলেন, ‘‘দাদা, ইংরেজি ভাল বুঝতে পারি না। বাংলায় বলুন।’’

image of Anusha Ipshita Mukherjee and Debottam Majumder

আড্ডার ফাঁকে নিজস্বী তুলতে ব্যস্ত অনুষা, ঈপ্সিতা ও দেবোত্তম। — নিজস্ব চিত্র।

এক সময় বাংলায় বেশি ক্ষণ কথা বলতে পারতেন না শন। তাঁর কথায়, ‘‘অনেক বছর ধরে আমার কিন্তু তার জন্য একটু অপরাধবোধ কাজ করত। এখনও চেষ্টা করছি, যাতে আরও ভাল বাংলা বলতে পারি।’’ এই বছর নববর্ষে আলাদা করে সাজগোজের সময় থাকবে না শনের। নতুন ধারাবাহিকের আউটডোরে বারাণসীতে থাকবেন তিনি। অপরাজিতা শোনালেন শনের শৈশবের কথা। বললেন, ‘‘সুপ্রিয়া আন্টি ওকে নিয়ে শুটিং ফ্লোরে আসতেন। খুব আদর করতাম। তখন ওর চুল খুব লাল ছিল। এখন কী করে এত কালো হয়ে গেল, জানি না।’’ জানা গেল, ‘জননী’ ধারাবাহিকের সেটেই সুপ্রিয়া দেবীর কোলে শনকে প্রথম দেখেছিলেন অপরাজিতা। অনুষা প্রসঙ্গেই অপরাজিতা বললেন, ‘‘আমি তো অনুষাকেও আঙুল খেতে দেখেছি!’’ শুনে লজ্জায় রাঙা হলেন অনুষা। অন্য দিকে, দিদার অনুপ্রেরণাতেই যে তাঁর অভিনয়ে আসা, সে কথাও স্পষ্ট করলেন শন।

শন ছাড়া বাকিরা এই মুহূর্তে ‘জল থই থই ভালবাসা’ ধারাবাহিকে একসঙ্গে অভিনয় করছেন। আড্ডায় উঠে এল শুটিং ফ্লোরের গল্প। অপরাজিতা জানালেন, সমবয়সি ছাড়াও ছোটরাও তাঁর সঙ্গে সহজেই বন্ধুত্ব করে নেন। অপরাজিতার কথায়, ‘‘সৌমিত্র জেঠু বলতেন যে, ‘সব সময় ছোটদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করবি। না হলে পিছিয়ে পড়বি’।’’ সেই সূত্রেই অনুষা এবং ঈপ্সিতার সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্ব এখন নিবিড়। অনুষার কথায়, ‘‘আমরা তো এখন একসঙ্গে পার্টিও করি।’’ শন যেমন মনে করালেন, তিনি আর অনুষা একই ছবির মাধ্যমে ইন্ডাস্ট্রিতে পা রেখেছিলেন। সেই ছবির নাম ‘দুর্গা সহায়’।

আলোচনার শেষ লগ্নে উঠে এল এই সময়ের গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন, বাঙালি কি ‘বেঁচে’ আছে? অনুষা এ রকম কোনও নেতিবাচক মন্তব্য সমর্থন করতে নারাজ। শন বললেন, ‘‘কাশ্মীর হোক বা লন্ডন, ঘুরতে গিয়ে আমি বাঙালি খুঁজে পেয়েছি। তাই বাঙালি আছে।’’ বাঙালিয়ানাকে বাঁচিয়ে রাখতে বাংলাদেশের অবদানকেও বাড়তি প্রাধান্য দিলেন অনুষা। ঈপ্সিতার কথায়, ‘‘রবীন্দ্রনাথ এখনও আমাদের মধ্যে রয়েছেন এবং থাকবেন। আর তাঁর অস্তিত্ব মানে তো বাঙালিও রয়েছে।’’ অন্য দিকে, বাঙালির চেহারা বা তার পোশাকের বিবর্তনের দিকটি ধরিয়ে দিতে চাইলেন দেবোত্তম। তিনি বললেন, ‘‘বাঙালিকে হয়তো আমরা চিনতে পারি না। কিন্তু ভীষণ ভাবে রয়েছে। যে কোনও উৎসব আমরা সমান গুরুত্ব দিয়ে পালন করি। সকলকে আপন করে নেওয়ার গুণও বাঙালির সব থেকে বেশি।’’

বাঙালি কি সত্যিই কাঁকড়ার জাত? বয়োজ্যেষ্ঠ হিসাবে সকলের মনের কথাটা যেন উঠে এল অপরাজিতার বক্তব্যে। তিনি যেমন মেনে নিলেন বাঙালি কাঁকড়ার জাত, তেমনই বিপরীত যুক্তিও খাড়া করলেন। জোর গলায় বললেন, ‘‘পৃথিবীর সব জাতিই কাঁকড়ার জাত। আমাদের জনসংখ্যা বেশি বলে হয়তো সমস্যাগুলো বেশি প্রকট হয়। এর বেশি কিছুই নয়।’’

দোষ-গুণ নিয়েই বাঙালি। হারিয়ে যাওয়া সময়কে বুকে আগলেই বাঙালি। কঠিন সময়েও বাঙালিয়ানাকে বাঁচিয়ে রাখার শপথ নিয়েই যে বাঙালি আগামী দিনে এগিয়ে যাবে, অতিথিদের বক্তব্যের সূত্র ধরে সেই বার্তাই উঠে এল।

আরও পড়ুন
Advertisement