ভুবনেশ্বর থেকে কলকাতা ফিরছিলাম। বিমানে ঘণ্টাখানেকের পথ। বিমানের মধ্যে পাবলিক অ্যাড্রেস সিস্টেমে নানা ঘোষণার মধ্যে একটা ছিল, ‘‘ভোট আপনার গণতান্ত্রিক অধিকার। নিজের ভোট নিজে দিন।’’
এত দিন বিমানে এমন ঘোষণা কখনও শুনিনি। কে জানে, কিছু দিন পরে হয়তো দেখব, রাজনৈতিক দলগুলোও বিমানে ভোটের প্রচার করছে। যে বিষয়টা অনুভব করলাম, তা হল, ভোটপ্রচারের ধরন এখন অনেক পাল্টে গিয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলো খবরের কাগজ, ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে বিজ্ঞাপন দিচ্ছে। টিভিতে প্রচার করছে। সমাজমাধ্যমে প্রচারের ঝড় তুলছে। অডিয়ো-ভিডিয়ো সবই আছে সেখানে। হোর্ডিং, ফ্লেক্স, ঝুলন্ত পোস্টারে ছেয়ে গিয়েছে শহর। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, ভোট চলছে। কিন্তু ভোটের কলকাতা এখন অনেক ‘রংহীন’। আমাদের ছোটবেলায় শহরের প্রায় প্রতি বাড়ির পাঁচিল থেকে দেওয়াল রঙিন হয়ে উঠত ভোটের রঙে। নানা রং। নানা ছবি। নানা কার্টুন। নানা হরফ। নানা গ্রাফিতি। সে এক ‘রংদার’ সময়। শহরের সেই ‘রংবাজি’ এখন আর নেই। খুব মিস্ করি।
উত্তর কলকাতার রাজবল্লভপাড়ায় আমি জন্মলগ্ন থেকে বেড়ে উঠেছি। স্কুলেও পড়েছি এখানে। চারদিকে বিখ্যাত সব এলাকা। বাগবাজার। কুমোরটুলি। হাতিবাগান। বিবেকানন্দ রোড। গ্রে স্ট্রিট। সব জায়গাতেই ছিল ফুটপাথের উপর গাড়িবারান্দা-সমেত বড় লোকেদের বড়় বড় বাড়ি। সেই সব বাড়ির পাঁচিল স্টোন চিপ দিয়ে খরখরে করা হত। যাতে দেওয়ালে পোস্টার লাগানো না যায়। ওই দেওয়ালে কিছু লিখতে যাওয়া অত্যন্ত কষ্টসাধ্য ছিল। তবু ভোটের সময়ে সেই সব পাঁচিলে পোস্টার লাগানো হত। দেওয়ালে ভোটপ্রচারের লেখাও দেখতাম। তবে সব দেওয়ালেই কিন্তু লেখা থাকত, ‘বিজ্ঞাপন লাগাবেন না’!
ছোটবেলায় ভোট এলে সারা কলকাতা ভরে উঠত প্রচার-পোস্টারে। দেওয়াল লিখনে। আমাদের পাড়ার জগৎ মুখার্জি পার্কের পাশে এখনও একটা গাড়িবারান্দা-সহ বাড়ি আছে। তাদের সঙ্গে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পারিবারিক যোগ ছিল। ওই বাড়ির নীচেই চা, পান-সহ নানা রকমের দোকান। সঙ্গে আড্ডা দেওয়ার বেঞ্চ পাতা। যার নাম ‘মস্কোর মোড়’। তৎকালীন রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত সব দলের লোকেরাই একসঙ্গে আড্ডা দিতেন সেখানে। বাম, কংগ্রেস এবং প্রথম পর্বের নকশালপন্থারীও। থাকতেন সেই সময়কার নামী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বেরাও। ছোটবেলা থেকে ছবি আঁকতাম বলে ওঁদের অনেকেই আমায় চিনতেন। আমাকে দিয়ে পোস্টারে ছবি আঁকাতেন। যদিও আমি কোনও রাজনৈতিক দলের সঙ্গে কোনও ভাবে যুক্ত ছিলাম না। এখনও নই। অসংখ্য পোস্টারের ছবি এঁকে দিয়েছি ওঁদের। ছোট বয়স। স্কুলে পড়ি। তখন থেকেই এঁকেছি লেনিন, কার্ল মার্কস, মহাত্মা গান্ধী, ইন্দিরা গান্ধী… সকলের ছবি। দেওয়ালে এঁকেছি। দেওয়াল লিখেওছি। গ্রাফিতিও করেছি।
সেই সময় পার্টি অফিসগুলোর ভিতরেও পোস্টার লেখার কাজ হত। দিনরাত ধরে। লেখা এবং আঁকা শেখানোর অনেক লোক থাকতেন। ভাল ‘স্ক্রিপ্ট রাইটিং’ নয়, মোটামুটি একটা তালমাত্রা রেখে পোস্টারগুলো লেখা হত। সেই সময় যাঁরা পোস্টার আঁকার ‘আর্টিস্ট’ ছিলেন, তাঁদের লেখার ধরন মন দিয়ে দেখতাম। কোথা থেকে শুরু করে কোথায় গিয়ে শেষ করলেন, কী ভাবে দেওয়ালের ‘স্পেস’ ব্যবহার করলেন, তা-ও শিখতাম। একটা উদাহরণ দিই। শ্যামবাজার এভি স্কুলে পড়তাম আমি। স্কুলের বিশাল পাঁচিলে একটা অসাধারণ ‘লেটারিং’ দেখেছিলাম এক বার। আমি নিশ্চিত, ওটা করেছিলেন অসাধারণ কোনও শিল্পী। এবং গোটাটা রাতের অন্ধকারেই করেছিলেন। তখন নকশাল আমল। অনেক বিধিনিষেধ! আগের দিন বিকেলে যখন স্কুল থেকে ফিরেছি, দেওয়াল ফাঁকা ছিল। এখনও লেখাটা মনে আছে— ‘ভোট বয়কট করুন’। এক একটা হরফ প্রায় ছ’ফুট লম্বা। সেই অনুপাতে চওড়াও। আমি তো দেখছিলাম দূর থেকে। সামনে দাঁড়িয়ে অত্ত বড় দেওয়ালে ও ভাবে প্রত্যেকটা হরফ নিজের হাতে লেখা, তার সামঞ্জস্য বজায় রাখা, খুব শক্ত কাজ!
এমন অসংখ্য দেওয়াল লিখন দেখেছি। পোস্টার দেখেছি। সেই সময় বহু পোস্টার লেখা হত খবরের কাগজের উপরে। রঙিন কালিতে বড় বড় হরফে ভোটপ্রচারের লেখা। তার পরে বাড়ির দেওয়ালে সেগুলো সাঁটানো হত। বড় বড় থামও বাদ যেত না। তখন তো আর এখনকার মতো বড় বড় হোর্ডিং ছিল না। ফিনোলেক্স, ডিজিটাল প্রিন্ট বা এলইডি লাইটের সমাহারও ছিল না। সে এক রঙিন সময়!
তখন আমার স্কুলজীবনের শেষের দিক। নকশাল আমলও প্রায় শেষের দিকে। পাড়ার দেওয়ালগুলো দখল করতে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের একটাই কৌশল ছিল। আগের বারের ভোটের দেওয়াল লিখনে উপর কলিচুন লাগিয়ে পুরনো লেখা মুছে ফেলা। তার পরে দেওয়ালের মাঝ বরাবর লেখা হত ‘সাইট ফর’। ওই লেখার দু’পাশে দেওয়াল জুড়ে যতটা জায়গা, ততখানি তির চিহ্ন দেওয়া। নকশালদের পর নব কংগ্রেস এল। তাদেরও কৌশলও একই। ঠিক সেই সময়েই আমার শিল্পগুরু বিকাশ ভট্টাচার্যের একটা অসাধারণ পেন্টিং প্রদর্শিত হয়েছিল বিড়লা অ্যাকাডেমিতে। বিকাশবাবু তো অসাধারণ নাগরিক শিল্পী ছিলেন। তো সেই ছবিটির ক্যাপশনই ছিল ‘সাইট ফর’। ছবিতে দেখা যাচ্ছে, দেওয়াল আগলে রেখেছে কিছু মৃত অস্পষ্ট মানুষ। আর দেওয়াল ছ্যাঁদা করে ঢুকে গিয়েছে বুলেট। অসামান্য ছবি। অসামান্য বক্তব্যও ছিল ওই ছবিতে।
ইন্দিরা গান্ধী যখন নিহত হলেন, তখন আমি আনন্দবাজার সংস্থায় কাজ করি। ৩১ অক্টোবর, ১৯৮৪। এমনিতেই আমি তাড়াতাড়ি অফিসে ঢুকে পড়তাম। সে দিন ‘সানডে’র সম্পাদক এম জে আকবর আর্ট ডিপার্টমেন্টে এসে বললেন, ‘‘সুব্রত, তুমি এখনই একটা ইন্দিরা গান্ধীর ছবি এঁকে দাও।’’ আমি তখনও জানতাম না, এমন একটা ঘটনা ঘটে গিয়েছে। সঙ্গে সঙ্গেই আঁকতে বসলাম। মিনিট দশেকের মধ্যেই ব্রাউন প্যাস্টেলে ইন্দিরার একটা পোট্রেট করে দেখালাম। উনি মুগ্ধ হয়েছিলেন। মাস কয়েকের মধ্যে দেশে ভোট ঘোষণা হল। প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী ইন্দিরা-তনয় রাজীব। আমার আঁকা ইন্দিরার ওই ছবি দেখে সারা ভারত জুড়ে অসংখ্য শিল্পী ভোটপ্রচারের জন্য সেই ছবিই এঁকেছিলেন।
এখন আমাদের এখানে রাস্তাঘাটে ভোটের পোস্টারগুলো অন্য রকম হয়ে গিয়েছে। আসলে ছাপার প্রযুক্তিটাই পাল্টে গিয়েছে। তবে এটা দেখতে খারাপ লাগে না। গ্রামাঞ্চলে এখনও কাঁচা লেখা দেখা যায়। কাঁচা হাতের কাজ। বহু মজার পোস্টারও দেখেছি। সেগুলো একটা অন্য ধারার। ভোটপ্রচারে গ্রাফিতিও মিস্ করি। এই যে দেওয়ালে ছবি আঁকা, স্টেনসিলের কাজ করা— এগুলো তো গ্রাফিতি। সে সব আর এখন হয় না। সেই টিন কেটে, জুড়ে, দেওয়ালে লাগিয়ে রং মাখিয়ে, তার পর সরিয়ে নেওয়া— তার পরে দেওয়ালে একটা আস্ত লেনিনের মুখ! সে সব আর এখন কোথায়! গত মাসে ভুবনেশ্বর গিয়েছিলাম একটা চিত্র প্রদর্শনীতে। সেখান থেকে গিয়েছিলাম পুরী। জগন্নাথ দর্শনে। যতটা সড়কপথে গেলাম-এলাম, ওড়িশার কোথাও কোনও দেওয়াল লিখনই নজরে এল না। ব্যানার-পোস্টারও নয়। শুধু কয়েকটা মোদীর হোর্ডিং দেখলাম। বিশালকার। ওড়িয়া ভাষায় কী লেখা ছিল বুঝতে পারিনি। ভোটপ্রচারই হবে। আমাদের কলকাতা শহরে তো এই সবই এখন গিজগিজ করছে। ওড়িশায় আরও একটা জিনিস দেখলাম। সেখানকার বড় বড় বাড়ির দেওয়ালে ছবি আঁকা। আমার ধারণা, আর্ট কলেজের জুনিয়র আর্টিস্টদের দিয়েই ওই সব ছবি আঁকানো হয়েছে। সেই সব শিল্প বাড়ির দেওয়ালেই প্রদর্শিত হচ্ছে। নান্দনিক এই বিষয়টা আমার কিন্তু বেশ লেগেছে!
এই লেখা লিখতে গিয়ে এক জনের কথা খুব মনে পড়ছে। ব্রজগোপাল মান্না। প্রচুর ছবি এঁকেছেন। জিসি লাহাতে ওঁর ছবি বিক্রি হত। আনন্দবাজারেও আসতেন মাঝেমাঝে। আমাদের বাড়িতে এসে আমার সঙ্গে অনেক কথা বলতেন। শেষ বয়সে খুব চাপে পড়ে গিয়েছিলেন। আমায় দুঃখ করে সে সব বলতেন। তখন বাম আমল। ভোটের সময় ওঁকে দিয়ে অসংখ্য পোস্টার আঁকানো হত। কিন্তু উনি একটা সময়ের পরে মনঃকষ্টে ভুগতেন। নিজের ছবি আঁকা হচ্ছে না! শুধু পোস্টার। শুধু রাজনৈতিক চাপ। দিনরাত পোস্টার এঁকে যেতে হচ্ছে! আচমকা ভদ্রলোক মারা গেলেন। খুব খারাপ লেগেছিল ওঁর মৃত্যুটা। ওই কাজ করে তো পয়সা পেতেন না। মনের খিদেও মিটছিল না।
আমি যখন এই সব কাজ করেছি, তখন অনেক ছোট। স্কুলে পড়ি। আর্ট কলেজেও ঢুকিনি। কর্মস্থলেও নয়। তাই বিনে পয়সার ব্যাপারটা গায়ে মাখিনি। বড় হওয়ার পর ও সব কাজ করার প্রস্তাব এলে বলেছি, রাজনীতির বিষয়ে আমার অভিজ্ঞতা নেই। ও সব করতে গেলে রাজনীতি করতে হয়। আমি তা পারব না। কাজ করে পয়সা পাওয়াটাও গণতান্ত্রিক অধিকার। ভোট দেওয়ার মতোই। শিল্পীরা সেই অর্থে রাজনীতির কাছে খুব একটা মর্যাদা পান কি?
(লেখক চিত্রশিল্পী। মতামত নিজস্ব)