অনেককেই একটা কথা বলতে শুনি। এমন নয় যে, ইদানীং শুনছি। বেশ কিছু বছর ধরেই কথাটা চলছে। কেউ কারও উদ্দেশে বললেন, ‘‘বেশি নাটক কোরো না তো!’’ বা, ‘‘ওই দেখ, নাটক করছে!’’ খুব আটপৌরে ভাবেই বলেন তাঁরা। একেবারেই হালকা চালে ব্যবহার। কোনও কিছুকে গুরুত্ব না-দিতেই এই কথার চল।
‘নাটক’ শব্দটাকে নিয়ে এমন নানা কিছু বলা হয়। কিন্তু আমি যে ভাবে নাটককে দেখি, সেটা তো ও ভাবে নয়। আমি নাটককে ‘আর্ট’ হিসাবে মনে করি। নাটকের চর্চা করি। ওটা আমার কাছে জীবনযাপন। আমার যাপনেই তো নাটক রয়েছে। আমি যে অর্থে ‘নাটক’ শব্দের ব্যবহার করি, ওঁরা কিন্তু সেই অর্থে করেন না। আমি জীবনের কোনও কিছুই খুব হালকা ভাবে করতে পারি না। সেই অর্থে, আমি আসলে ‘নাটক’ করতে পারি না।
আনন্দবাজার অনলাইনের জন্য এই লেখাটা লিখতে বসার আগে একটা নাটকের সংলাপ মুখস্থ করছিলাম। খুব কঠিন সংলাপ। লিখে রেখেছি। প্রথমে দেখে দেখে পড়েছি অনেক বার। মাঝে না-দেখে বলার চেষ্টা করেছি। আবার দেখেছি। এ ভাবেই এগোচ্ছিলাম। কারণ, বার বার সংলাপ বলতে থাকলে, মাথার ভিতরে একটা দৃশ্যপট তৈরি হয়। প্রতি বার বলতে গেলে সেই দৃশ্যে বদল হতে থাকে। পাল্টাতে থাকে। এ ভাবেই নাটকের এক একটা দৃশ্য মাথার ভিতর তৈরি হয়। এটা কিন্তু দৈনন্দিনের অনুশীলন। একই সঙ্গে নিজের পুরোটো ঢেলে দেওয়া। এবং ত্যাগ। ইংরেজিতে যাকে আমরা ‘রেগুলার প্র্যাকটিস’, ‘ডেডিকেশন’ এবং ‘স্যাক্রিফাইস’ বলি। এ সবের সঙ্গে আরও নানা কিছু থাকে। আমি আমার তিন বছর বয়স থেকে এটার মধ্যে আছি। এখন আমি পঞ্চাশ ছুঁইছুঁই। টাকাপয়সার লোভ মিটে গিয়েছে। বুঝে নিয়েছি, বেঁচে থাকতে কতটা কী প্রয়োজন। এখন আমার আকাঙ্ক্ষা— বাকি জীবনটা যেন মস্তিষ্ক, শরীর আর মন সজাগ থাকে। এক জন অভিনেতার মূল জায়গাটা তো ‘এমপ্যাথি’। সচেতন ভাবেই ‘সিমপ্যাথি’ লিখলাম না। ‘এমপ্যাথি’ বলতে বোঝাতে চাইছি অন্য কারও সঙ্গে একই তারে বেঁধে থাকা। এটা করতে গিয়ে সব সময় নিজেকে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্যে দিয়ে নিয়ে যেতে হয়। ধরুন, আমি যখন অলস হয়ে যাই, বদমাইশ হয়ে যাই, লোভী হয়ে যাই, তখন আমার অভিনেতা সত্তা নষ্ট হয়ে যাবে, এই ভেবে নিজেকে বকতে থাকি। নিজেকে আবার তৈরি করি। নিজেকে নিয়ে ফের ভাবনায় ডুব দিই। মানুষ তো। এ সব পরিস্থিতি তো তৈরি হয়ই।
আমি যেমন থিয়েটার করি, আমার যাপনে যেমন নাটক আছে, তেমনই তো অনেকের জীবনে রাজনীতি আছে। তাঁরা ওটাতেই যাপন করেন। রাজনীতির জন্য প্রচণ্ড লড়াই করেন। এমন প্রচুর রাজনীতিক আছেন, যাঁদের রাজনৈতিক মূল্যবোধ রয়েছে। অনেকে আবার বলেন, হালকা চালেই, এখনকার রাজনীতিকদের কোনও মূল্যবোধ নেই। আমি তা মনে করি না। অনেকেই তো প্রাণপণ চেষ্টা করে যাচ্ছেন। তাঁদের জন্য এই ভোট পর্ব একটা ‘পারফরম্যান্স’। একটা ‘টেস্ট’। আমি সংলাপ অনুশীলন করছিলাম একটু আগে। আমার জন্য, মানে এক জন অভিনেতার জন্য মঞ্চ এবং একটা শো যেমন ‘টেস্ট’, তেমনই রাজনীতিকদের জন্য ভোট। আমি তো মঞ্চ বা ক্যামেরার সামনে পরীক্ষা দিতে যাই। আমি পারলাম? না কি পারলাম না? দর্শক কী ভাবছেন? রুশ নাট্যব্যক্তিত্ব স্তানিশ্লাভ্স্কি যে ‘সুপার অবজেকটিভ’-এর কথা বলেছেন, এক জন অভিনেতার কাছে তো সেটা হল তাঁর দর্শক কী ভাবছেন। রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের কাছে ভোটটাই তাঁদের ‘সুপার অবজেকটিভ’ হওয়া কথা। ভোটার কী ভাবছেন? জনতা কী ভাবছে? ফল কী হবে? তিনি তো সেটার জন্যই সারা বছর কাজ করেন। যাঁর সারা বছরে অনুশীলনে কোনও খামতি নেই, যিনি ক্রিকেটের পরিভাষায় ভাল মতো ‘শ্যাডো প্রাকটিস’ করেছেন, যত মন দিয়ে কাজ করেছেন, তিনি তত বেশি এই ভোট পর্বে উপকৃত হবেন। অবশ্য এখানে একটা কথা লেখা খুবই জরুরি— যদি স্বচ্ছ ভোট হয়।
খুব ছোট পরিসরে আমার পক্ষে যেটা করা সম্ভব, সেটা আমি করি। কে কী অন্যায় করেছেন, সে পর্যায়ে যাই-ই না। আমি মনে করি, প্রত্যেকটি মানুষই আলাদা। এ সব তো থাকবেই। আমি নিজে কী করতে পারি, আমার বেঁচে থাকাটা কী ভাবে অর্থবহ হয়, আমার সঙ্গে যাঁরা আছেন তাঁদের সঙ্গে যাতে ন্যায় করতে পারি— এ সবই চেষ্টা করি। আমি তো বিশ্ব উষ্ণায়ন ঠেকাতে পারব না একা। আমি তো বে-রোজগারি ঠিক করে দিতে পারব না। এ সব আমার আয়ত্তের বাইরে। আমার পক্ষে যা যা করা সম্ভব, প্রতি দিন সেগুলো করার চেষ্টা করি। সেটা আমার একা বাঁচাতে, সেটা আমার সঙ্ঘবদ্ধ ভাবে বাঁচাতেও। বাবা একটা কথা শিখিয়েছিলেন ছোটবেলায়। সেটা খুব গুরুত্বপূর্ণ— ‘স্টপ পাসিং দ্য বাক’ (অন্যের ঘাড়ে দোষ চাপানো বন্ধ করো)। বাবা বলেন, ‘‘তুমি যা করেছ, তার জন্য তুমি এবং একমাত্র তুমিই দায়ী।” এই যে আমরা বলি না, বাসটা দেরি করল বলে মহলাকক্ষে পৌঁছতে দেরি হল। ট্রেনটা বড্ড ঝোলাল বলে নাটকের মাঝখানে ঢুকতে হল থিয়েটার হলে। এ সব তো অজুহাত। আমরা নানা কারণেই দিয়ে থাকি। এই অজুহাত দেওয়ার বিষয়টাকে বাবা আমার ভিতর থেকে সরিয়ে দিয়েছেন। আমি জীবনের সব ক্ষেত্রে বিশ্বাস করে চলি, যা দোষ সব আমার। অন্য কারও নয়। এমনিতেই আমাদের একটা প্রবণতা রয়েছে অন্যকে দোষারোপ করার। এর কোনও শেষ নেই কিন্তু। উত্তর পাওয়া যাবে না। যেমন, আমার নাটকের দলে কোনও সমস্যা হলে তার উত্তর আমি দেব। আমার দলে কোনও মেয়ে যদি হেনস্থার শিকার হয় জবাব তো আমি দেব। কারণ, আমি তো দায়ী। দলে কেউ ভুল করলে আমিই বকব। এক জন অভিনেতার যাপনে এটা আছে। রাজনীতিকদেরও আছে নিশ্চয়ই।
আমি আজকাল রাজনীতির খবর দেখি না। খুব কষ্ট হয় মাঝেমাঝে। এড়িয়ে যাই। এটা ভাল বললে ভাল। মন্দ বললে মন্দ। কিন্তু আমার সব খবর ভাল লাগে না। আমার উপর গভীর প্রভাব ফেলে। অবশ্যই নেতিবাচক। ওই সময়টায় আমি আমার পজ়িটিভ ভাবনা দিয়ে পৃথিবীকে যেটুকু দিতে পারি, সেটা দেওয়ার চেষ্টা করি। যার একটা দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব থাকবে। আমি রাজনীতি বুঝি না। যে কাজটা ছোটবেলা থেকে শিখেছি, সেটাই শেখানোর চেষ্টা করি। সেটাই করার চেষ্টা করি। অভিনেতার শরীর-মন-মাথা কী ভাবে তৈরি করতে হয়, সেটা চেষ্টা করি শেখানোর। অনেকেই দলে আসে। কেউ চলে যায়। কেউ থেকে যায়। অনেকে তো দীর্ঘ দিন থেকে যায়। আমি রাজনীতি বুঝি না। বরং বলা ভাল, জানি না। যেমন ডাক্তারি জানি না। হঠাৎ করে ডাক্তারি করলে সেটা তো ‘হাফ বেক্ড’ হবে। রাজনীতিক হলেও তা-ই। ওটা পারব না। আমি ‘ফুল বেক্ড অভিনেতা’। নাটক সংক্রান্ত যা কিছু সব পারি। পারব। নিজের সমস্তটা দিয়েই পারার চেষ্টা করব।
তা বলে যাঁরা রাজনীতি করছেন, তাঁরা কি খারাপ? মোটেও নয়। তাঁদেরও তো আমার মতো ভাবনা থেকেই আসা। আমি নাটকে। ওঁরা রাজনীতিতে। মুড়ি-মিছরি একদর করে দেওয়াটা খুবই খারাপ। রাজনীতিতে এখন কিছু হচ্ছে না, এটা বললে তো সমাজের সব স্তর নিয়েই প্রশ্ন তুলতে হয়। এবং তার গোটাটাই নেতিবাচক হবে। চাই না।
ভোট ব্যাপারটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। সাধারণ মানুষের কাছে তো বটেই। ভোট প্রসঙ্গে গুরুত্ব দিয়েই বলা উচিত। চটুল ভাবে যাঁরা বলেন, ‘‘নাটক করছে’’, তাঁরা আসলে কোনও যাপনেরই খোঁজ রাখেন না। এটা জনপ্রতিনিধি ঠিক করার বিষয়। এটা আমার অধিকার। কাকে আমার প্রতিনিধি হিসাবে গণতন্ত্রে জায়গা দেব, সেটা তো আমারই অধিকার হওয়া উচিত। তাই চটুল ভাবে ‘নাটক’ নয়, বিষয়টাকে গুরুত্ব দিয়ে দেখুন। তাতে সবারই মঙ্গল।
(লেখক অভিনেতা। মতামত নিজস্ব)