‘বল্লভপুরের রূপকথা’য় আমি ছিলাম রাজা। রায়-রায়ান ভূপতি ভুঁইয়া। সে রাজার যে কী হাল ছিল, তা দর্শকেরা বিলক্ষণ জানেন। কিন্তু আনন্দবাজার অনলাইনের তরফে আমাকে লিখতে বলা হল, আমি যদি রাজনীতির বল্লভপুরের রাজা হতাম! প্রথমটায় শুনে খুব অবাক হয়েছিলাম। তার পরে বেশ মজাও পেলাম অবশ্য। সেই মজাটাকেই আলতো করে মিশিয়েছি এক অন্য ভাবনায়।
কিন্তু রাজনীতির বল্লভপুরের রাজা হওয়ার আগে সেখানকার রাজনীতিটা তো আমাকে বুঝতে হবে। সেটা ঠিক কেমন? এখানেই আমার মনে তৈরি হল এক বিভ্রান্তি!
বাদল সরকার তো তাঁর নাটকে সরাসরি তেমন কোনও রাজনৈতিক ইঙ্গিত রাখেননি। রাজনীতি আসলে অতি বাস্তব একটা বিষয়। বল্লভপুর সেখানে রূপকথার মতো। বল্লভপুরের মধ্যে তা-ও রূপকথা আর বাস্তব মেশানো একটা আমেজ আছে। কিন্তু রাজনীতিতে তার ছিটেফোঁটাও নেই। তাই রাজা হয়ে আমি প্রথম কোন কাজটি করব, সেটা আগেই ঠিক করে ফেলি। যে মানুষগুলি রাজনীতিতে বাস করেন, আমি রাজা হলে তাঁদের প্রত্যেককে বল্লভপুরের মানুষের মতো বানিয়ে ফেলতে চাইতাম। সেটাই হত রাজা হিসাবে আমার প্রথম কাজ।
এখানে বাদলবাবুর নাটক প্রসঙ্গে দু’একটা কথা লিখতে চাই। ‘বল্লভপুরের রূপকথা’র পরবর্তী সময়ে উনি রাজনৈতিক নাটক করেছেন। তবে সেই সময়কার নাটকের সঙ্গে ‘বল্লভপুরের রূপকথা’র কোনও মিল নেই। যদিও ওঁর চিন্তায়, মননে একটা রাজনীতি সব সময়েই ছিল। বল্লভপুরও আলাদা কিছু নয়। সে কারণেই বলতে চাই, রাজনীতির বল্লভপুরে রাজনৈতিক মানুষেরা আপনা থেকেই ভাল হতেন। আমাকে কিছু করতেই হত না। যেমন বল্লভপুরে কোনও খারাপ মানুষ থাকতেন না, তেমনই রাজনীতির বল্লভপুরেও সকলে ভাল হতেন। সেটাই তো বাদলবাবুর দর্শন। তবে ভাল-মন্দ সংক্রান্ত কোনও বিতর্কে আমি অন্তত যেতে চাইছি না এখন। এতদিনকার দেখাশোনায় আমি এটা বুঝেছি যে, রাজনীতি আসলে মানুষকে বিভিন্ন ভাবেই খুবই নিচু মনের করে দেয়। কিন্তু বল্লভপুরে কোনও ধর্মের বাছবিচার নেই। সেখানে কোনও জাতপাতের ভেদাভেদ নেই। হতে পারে সেখানে সবাই গরিব, এমনকি, রাজাও। কিন্তু প্রত্যেক মানুষই খুব সুখী। ভাল। তাঁরা একে অপরকে সাহায্য করেন। আমাদের বাস্তবের সঙ্গে বল্লভপুরের লোকজনের কোনও মিল নেই। রাজা হয়ে আমি চাইব ওই মিলটা তৈরি করতে। বল্লভপুরকে এমন রাজনীতির দেশ বানাব, যেখানে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন একটা স্পষ্ট রাজনৈতিক ভাষ্য থাকবে। আর তার সঙ্গেই আলতো করে মিশিয়ে দেব একটু একটু রূপকথা।
সেই রূপকথা কেমন হবে?
সেটা এখনও আমি ঠিক ঠাহর করে উঠতে পারিনি। তবে এটা নিশ্চিত, ওই রূপকথায় কোনও খারাপ মানুষ থাকবেন না। আমরা এই যে কথায় কথায় ‘রাজনীতি’, ‘রাজনৈতিক’-এর মতো শব্দ ব্যবহার করি, সেটা খুবই সদর্থক ভাবে প্রয়োগের চেষ্টা করবে বল্লভপুরের এই রাজা। ইদানীং দেখছি, এক জন নেতা বা রাজনীতিক যে ভাবে সকলের সামনে নিজেকে উপস্থাপিত করেন, যেন তিনি এক জন ‘মসিহা’। কোথাও যেন তিনি ‘লার্জার দ্যান লাইফ’ হয়ে উঠতে চান। ছোটবেলায় আমরা হিরোদের দেখতাম এ ভাবে। তাঁদের ছোঁয়া যেত না। তাঁরা সাধারণের আয়ত্তের বাইরে থাকতেন। এখন রাজনীতির মানুষেরা কেন জানি না ওই জায়গাটা নিয়ে নিয়েছেন। এবং সেটা ধরেও রাখতে চাইছেন। ভোটের প্রচারে যখন দেখি, হুডখোলা জিপে চড়ে মানুষের স্রোতের ভিতর দিয়ে হাত নাড়তে নাড়তে যাচ্ছেন নেতা, তখন আমার মনে হয়, মানুষের থেকে আসলে তাঁরা কত দূরে সরে যাচ্ছেন। অথচ তাঁদের কাজ তো মানুষের মাঝে থাকা। মানুষকে ভাল রাখা। নাগরিককে সুখে এবং শান্তিতে থাকতে দেওয়ার পরিবেশ তৈরি করা। এই যে ওঁরা মানুষকে ছুঁয়ে দেখছেন বা পাশে গিয়ে দাঁড়াচ্ছেন, আমার মনে হয় এর গোটাটাই প্রচারের অঙ্গ। আমরা যেমন সিনেমা রিলিজ়ের দু’তিন মাস আগে থেকেই প্রচার শুরু করি, নেতারাও এখন সে ভাবেই নিজেদের প্রচার করে বেড়ান।
কিন্তু ‘বল্লভপুরের রূপকথা’ তো শুধু একটা সিনেমা নয়। একটা রূপকথার বাস্তব। যেখানে রাজা তাঁর প্রজাদের সঙ্গে এক বাটিতে মুড়ি খান। যেখানে রাজা ধার নেন তাঁর গ্রামের মানুষের কাছ থেকে। যেখানে রাজা তিনি কোন জাতের, তা জাহির করেন না। প্রয়োজনও বোধ করেন না। রাজনীতির বল্লভপুরেও সেটা হোক!
আমি তা-ই চাই।
আমরা যখন ‘বল্লভপুরের রূপকথা’ নিয়ে মানুষের কাছে পৌঁছেছিলাম, তখন কোভিডকাল সদ্য শেষ হয়েছে। চার দিকে মানুষ খুব খারাপ রয়েছেন। আর্থিক সঙ্কট। কিন্তু তাঁরা ভাল থাকতে চাইছেন। বল্লভপুরের রাজা তখন বোঝাতে চাইলেন, দেশে আর্থিক সঙ্কটটাই বড় কথা নয়। আসলে দেশের মানুষের ভাল থাকা নির্ভর করে একে অপরের প্রতি ভরসার উপর। একে অপরের প্রতি ভালবাসার উপর। রাজা বোঝালেন, শ্রেণিবিভেদ, ধর্মীয় বিভেদ আমাদের ভাল করে না। খারাপ করে। রাজনীতির বল্লভপুরেও এ সবের অন্যথা হবে না। রাজা এ ভাবেই ভাবাবেন।
বাস্তবের রাজনীতিতে মানুষ ইদানীং বড্ড বেশি লোভের শিকার হচ্ছে। লোভে পড়ে কত কিছু করছে তারা। আমি রাজনীতির বল্লভপুরের রাজা হলে কখনও লোভ করতাম না। বাদলবাবু ‘বল্লভপুরের রূপকথা’য় পুঁজিপতিদের উত্থানের কাহিনি তুলে ধরেছিলেন। ‘বল্লভপুরের রূপকথা’য় দেখা যায়, রাজা যে টাকায় রাজবাড়ি বিক্রি করতে চেয়েছিলেন, তার চেয়ে অনেক বেশি টাকায় হালদারসাহেব তা কিনতে চেয়েছিলেন। কিন্তু রাজা বলেছিলেন, ‘‘না, আমার অত টাকার প্রয়োজন নেই। যেটুকু প্রয়োজন সেটুকুই দরকার।’’ হালদারসাহেব যখন জানতে পারলেন ওই বাড়িতে ভূত আছে, তখন তিনি আরও টাকার প্রস্তাব দিলেন। পুঁজির কথন এমন জায়গায় গিয়ে পৌঁছল যে, ভূত পর্যন্ত কিনতে রাজি হয়ে গেলেন ওই ব্যবসায়ী। কারণ, ওটা তাঁকে ‘স্টেটাস’ দেবে। ওটা তাঁকে তাঁর বন্ধুর কাছে বড় করে তুলবে। অনন্য করে তুলবে অনেক বেশি। এ এক অন্য লোভ। রাজনীতির বল্লভপুরের বাসিন্দারা লোভ জিনিসটা যাতে সংবরণ করতে পারেন, রাজা হিসাবে আমি সেই চেষ্টাই করব।
একটা কথা বলি? ‘বল্লভপুরের রূপকথা’য় হালদারসাহেব কিন্তু মানুষ হিসাবে খারাপ ছিলেন না। কোনও জিনিসের প্রতি তাঁর আকুলতার মধ্যে একটা সততা ছিল। আসলে বন্ধুর সঙ্গে প্রতিযোগিতার কারণেই ওই দর বাড়ানোর চেষ্টা। সবটাই লোকদেখানো। এখন তো গোটা সমাজটাই সেই লোকদেখানো ভঙ্গিমায় চলছে। সমাজে নিজের অর্থনৈতিক অবস্থানকে অন্যকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখানো। সেটাকেই বাদলবাবু খুবই মজার ছলে তুলে ধরেছিলেন ‘বল্লভপুরের রূপকথা’য়। কিন্তু বাস্তবে যেটা আমরা এখন দেখি, সেটা খুব একটা মজার নয়। এখনও বহু গ্রামে বিদ্যুৎ পৌঁছয়নি। দেশের অনেক জায়গাতেই মানুষ ঠিক ভাবে খেতে পায় না। পানীয় জল নেই। বেঙ্গালুরুর মতো বড় শহরেও জলের বড্ড আকাল! এ সব দেখে আমার মনে হয়, ওই হালদারবাবুদের দৃষ্টিভঙ্গি বোধ হয় অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য। ওঁরা অনেক কম ক্ষতিকর। আমি চাইব, আমার রাজনীতির বল্লভপুরে যাঁরা বাস করবেন, যাঁরা সেখানে আসবেন, তাঁরাও ওই রকমই হোন। অর্থনৈতিক ভাবে তাঁর অবস্থান যা-ই হোক না কেন, সেটা যেন অন্য কাউকে দুঃখ না দেয়। অন্য কাউকে কষ্ট না দেয়। সেটা যেন নিছকই তাঁর খেটে খাওয়া, তাঁর কাজ, তাঁর কঠোর পরিশ্রমের প্রতিবিম্ব ছাড়া আর কিছুই না হয়।
এখন যদি সত্যিই বল্লভপুরের মতো একটা জায়গায় আমরা থাকতাম, কী ভাল যে হত! সেখানকার মানুষগুলো সরল হত অনেক। অনেক সহজ। তাঁদের কথাবার্তা, চালচলন অনেক বেশি স্বাভাবিক হত। রূপকথার মতো শোনালেও বাস্তবে সেটাই অনেক বেশি কার্যকর হত। অনেক ভাল হত। আসলে রাজা ভাল হলে প্রজাও ভাল হয়।
রাজনীতির বল্লভপুরে আমি ভাল রাজা হতাম। আমি ভাল প্রজা তৈরি করতাম।
(লেখক অভিনেতা। মতামত নিজস্ব)