আমি তখন রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র রাজনীতি করি। টানা তিন বারের ছাত্র সংসদের সভাপতি। ইংরেজি বিভাগের সকলে সে বার ফেল করল। একসঙ্গে এত জন কী ভাবে ফেল করতে পারে? সেই প্রশ্ন তুলে সটান দলবল নিয়ে বিটি রোডে বসে পড়েছিলাম। বাস-গাড়ি-ঘোড়া আটকে সে এক বিতিকিচ্ছিরি ব্যাপার।
শেষমেশ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বিষয়টা খতিয়ে দেখার আশ্বাস দিয়েছিলেন। আমরাও আন্দোলন তুলে নিয়েছিলাম। আসলে ওই বয়সে ওই প্রতিক্রিয়াটা খুব স্বতঃস্ফূর্ত ছিল। এখন এই বয়সে এসে ওই রকম ঘটনায় আমার প্রতিক্রিয়া হয়তো অনেক মন্থর হত। এখন হলে ভাবতাম, রাস্তায় বসে পড়লে তার ফল কী হবে? কী কী সমস্যা হতে পারে? কারা বিপাকে পড়তে পারেন, ইত্যাদি। আসলে তরুণ বয়সে যা খুব উদ্যমের সঙ্গে করা যায়, বয়স হলে সেটাই অনেক ধীর হয়ে যায়। যে কোনও কাজের ক্ষেত্রেই বয়স একটা অত্যন্ত জরুরি বিষয়। সেটা রাজনীতি হোক বা নাটক, গান হোক বা খেলাধুলো— জীবনের সব ক্ষেত্রেই নবীনদের এক আলাদা গুরুত্ব থাকে।
সেই কারণেই সিপিএমের এ বারের প্রার্থিতালিকা আমার খুব পছন্দের হয়েছে। এই যে এত তরুণ এবং ঝকঝকে মুখ, এটা খুব আশাপ্রদ। যে কোনও দলের জন্যই এই নবীন মুখ জরুরি। তবে সিপিএম বড্ড দেরি করে ফেলল। এটা একটু আগে হলে ভাল হত। ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনের আগে একসঙ্গে অনেক নবীন মুখ প্রথম দেখেছিলাম বামেদের প্রার্থিতালিকায়। তার পর এ বার। মনে আছে, ২০১১ সালে সিপিএম প্রার্থী করেছিল শতরূপ ঘোষকে। নতুন এবং ঝকঝকে মুখ। কসবা বিধানসভায় দাঁড়িয়েছিলেন। সেই সময় সিপিএমে আলাদা করে তরুণ প্রার্থী কেউ ছিলেন না। একমাত্র উনি। বাকি সকলেই রাজনৈতিক ভাবে খুবই বিদগ্ধ এবং প্রবীণ। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য শতরূপের হয়ে প্রচারও করেছিলেন। ছবিটা এখনও মনে ধরে রেখেছি! আহা! অনেকে ঋতব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথা বলবেন হয়তো। কিন্তু উনি আমাদের থেকে বয়সে কিছুটা বড়। শতরূপ একেবারেই আমার বয়সি। বহু দিন ধরে চিনি। তাই সেই সময় খুব ভাল লেগেছিল এটা দেখে যে, সমবয়সি এক জনকে প্রার্থী করা হয়েছে! এই যে এ বার দীপ্সিতা ধর, সৃজন ভট্টাচার্য, সায়ন বন্দ্যোপাধ্যায়, সব্যসাচী চট্টোপাধ্যায়দের প্রার্থী করেছে সিপিএম, এটাও ভাল লেগেছে।
শুধু সিপিএম নয়, যে কোনও রাজনৈতিক দলের ক্ষেত্রেই এই নবীন মুখ অত্যন্ত জরুরি। এই যে তৃণমূল দেবাংশু ভট্টাচার্যকে তমলুকে প্রার্থী করেছে, এটাও আমার ভাল লেগেছে। দীপ্সিতা, সৃজন, সায়ন, দেবাংশু— এঁরা সকলেই প্রতিশ্রুতিমান। একই সঙ্গে শিক্ষিতও। আমার মনে হয়, যে কোনও দলেরই এই নবীন প্রতিভা তুলে আনা উচিত। দলমত নির্বিশেষেই বলছি। এটা রাজনীতির জন্য শুভ লক্ষণ। তরুণদের মধ্যে কাজ করার একটা স্পৃহা থাকে। একটা বাড়তি দায়িত্ববোধ। একটা লড়াকু মনোভাব। সেটাই তো হওয়া উচিত। আমি মনে করি, বয়স দিয়েই সবটা বিচার করা উচিত। বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে শারীরিক ক্ষমতাও তো কমতে থাকে আমাদের। কাজের পরিসরে আপস করতে হয়। এটা সব পেশাতেই সত্যি।
একটা উদাহরণ দিই। আমি অনেক জায়গাতেই রিয়্যালিটি শোয়ে বিচারক হিসাবে যাই। সেখানে দেখেছি, একদম ছোট যারা, কোনও কিছু না ভেবেই তারা পারফর্ম করে। সামনে কে আছে, কেন আছে, সে সব না ভেবেই। কিন্তু একটু বড় যারা, তারা কিন্তু বিচারকের উপস্থিতিকে উপেক্ষা করতে পারে না। ফলে পারফরম্যান্সে তার প্রভাব পড়ে। আসলে বয়স বাড়লে বোধশক্তি বাড়ে। ভয়ডরগুলো কাজ করতে থাকে। ঠিক-ভুলের বিচার করতে গিয়ে তাই কাজটা করে উঠতে চাইলেও শেষমেশ আর করে ওঠা যায় না অনেক সময়ে।
আমি নিজে একটা সময়ে প্রত্যক্ষ রাজনীতি করেছি। একটা দলের জেলা কমিটির সদস্যও ছিলাম। আমার কাকা একটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে যুক্ত। রাজনীতি করার সুবাদে ওঁর কাছে অনেক ধরনের সুযোগ এসেছে। কিন্তু উনি সে সব নেননি। যাঁদের প্রয়োজন, তাঁদের সব কিছু দিয়ে দিয়েছেন। সেই সততার মূল্য তিনি এখনও পান।
আমার মনে হয়, রাজনীতিতে শিক্ষিতদের আসা ভীষণ জরুরি। কী জন্য রাজনীতি করতে এসেছি, সেই প্রশ্নের উত্তরটাও নিজের কাছে থাকা প্রয়োজন। ভোটে দাঁড়াচ্ছি মানে আমার কেন্দ্রের প্রত্যেকটি মানুষের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিচ্ছি। জিতলে তাঁদের জন্যই সব কাজ করতে হবে। সেখানে কোনও ভেদাভেদ রাখলে চলবে না। এ বিষয়ে নিজের লক্ষ্য নির্ধারণ করেই আসা উচিত। নতুনেরা সে বিষয়ে খুব উৎসাহী।
মোদ্দা কথাটা হল, জনপ্রতিনিধিদের উপর থেকে মানুষের বিশ্বাস না উঠে গেলেই মঙ্গল। সারা দেশেই তো এমন ঘটনা অহরহ ঘটছে। এই অরবিন্দ কেজরীওয়ালের সঙ্গে যা ঘটল! একটা রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী। তিনি জেল খাটছেন! ভাবুন তো, বাড়ির অভিভাবক যদি জেলে বসে থাকেন, তা হলে পরিবারের বাকিদের কী অবস্থা হবে। রাজনীতিকদের উপর থেকে সাধারণ মানুষের বিশ্বাস যাতে না উঠে যায়, সে নবীন হোক বা প্রবীণ, সেটা খুব জরুরি। তাঁদেরও অনেক স্বচ্ছ থেকে কাজ করতে হবে। এই দায় তাঁদেরই। মানুষের তো ভোটের উপর থেকেই বিশ্বাস উঠে যাচ্ছে। ভোট দেওয়া আমার গণতান্ত্রিক অধিকার। কিন্তু অনেকেই অভিযোগ তোলেন, ‘‘ভোট দিতে যাব কেন!। সেই তো আমার ভোটটা পড়েই যাবে!’’ পঞ্চায়েত, পুরসভা, বিধানসভা, লোকসভা— সব ভোটেই এমন অভিযোগ ওঠে। মানুষ ভোট দিতে যেতে ভয় পান। অনেক দেশে তো বাড়িতে বসে ভোট দেওয়া যায়। আমরা কিন্তু এখনও লাইনে দাঁড়িয়ে রোদ-বৃষ্টিতে পুড়ে-ভিজে ভোট দিই। তাই পদ্ধতিটা আরও স্বচ্ছ হওয়া উচিত। মানুষ কিন্তু অতটাও অশিক্ষার অন্ধকারে নেই আর। এখন সংবাদমাধ্যম ছাড়াও সোশ্যাল মিডিয়া রয়েছে। সকলে সব দেখতে পাচ্ছেন। একটা সময়ের পর কিন্তু এটাই ‘বুমেরাং’ হয়ে আসবে!
২০১১ সালে রাজ্যে পালাবদলের সময় খুব কষ্ট হয়েছিল। ক্ষমতায় এল অন্য একটা দল। কিন্তু এটা বলতেই হবে, বর্তমান সরকার কিন্তু শিল্পীদের জন্য অনেক, অনেক কিছু করেছে। আমি ২০১৩ সাল থেকে যত শো করেছি, যত সম্মান পেয়েছি, তা আগে পাইনি। আমি অভিভূত! আমাকে এই সরকার যে স্বীকৃতি দিয়েছে, সেটা কী করে ভুলব! এখনও কোনও বিপদে পড়লে জনপ্রতিনিধিদের যে কাউকে ফোন করলেই শিল্পী হিসাবে যথাযথ সাহায্য পাই। এটা তো অস্বীকার করতে পারব না। আমাকে যোগ্য সম্মান দিয়েছে এই সরকারই।
এ বার প্রশ্ন, সিপিএম কি শূন্য থেকে ঘুরে দাঁড়াবে? না কি এই সব নবীন প্রার্থীরা কাব্যে উপেক্ষিতই থেকে যাবেন? সিপিএম এ বারের নির্বাচনেও ‘উপেক্ষিত’ই থাকবে না তো? দেশ জুড়ে বর্তমান যে রাজনৈতিক পরিস্থিতি, সর্বত্র যা যা হচ্ছে, যা যা ঘটছে, সে সব দেখেশুনেই বলছি, সিপিএম এ বার কতটা পারবে আমি সত্যিই জানি না। কিন্তু তা বলে তো থেমে থাকলে চলবে না। কাজটা তো করে যেতেই হবে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে দেখেছি। উনি যখন বিরোধী নেত্রী ছিলেন থেমে থাকেননি। এখনও থেমে নেই। এই যে আমার কাকার কথা লিখলাম, তিনিও থেমে যাননি। রাজনীতি যাঁরা করেন, তাঁদের একটা বড় অংশ তো নিজের কথা না ভেবে সমাজের ভালই ভেবে এসেছেন চিরকাল। এখনও ভাবেন। জনপ্রতিনিধি নির্বাচনের সময় আমরা যদি তাঁদের কথা একটু ভাবি, তা হলে তো আমরাই শান্তিতে থাকতে পারি।
রাজনীতি থেকে অনেক দিন আগে বেরিয়ে এসেছি। জীবনে গানকে প্রাধান্য দিয়েছি। সেই সময় খুব দ্বন্দ্ব ছিল। বাড়িতে বললাম। মা বললেন, ‘‘যদি তোর মনে হয় পার্টি করবি, তা হলে সেটাই মন দিয়ে কর। আর গান করলে গান। দুটো একসঙ্গে পারবি না। করবিও না।’’ আমি গান বেছে নিয়েছিলাম। দল ছাড়লাম। এখনও অনেক রকমের প্রস্তাব আসে। আমি সসম্মানে ফিরিয়ে দিই। স্বেচ্ছায় দূরে থাকি।
পুরনো দিনের রাজনীতি আর বর্তমানের স্বীকৃতি— কাকে বেশি গুরুত্ব দিই? সেটা বলার পরিসর এই লেখা নয়। আর এ প্রশ্নের জবাব দিলে তো বলেই দেওয়া হল, ভোটটা কাকে দেব!
(লেখক ‘প্রাক্তন’ ছবির জন্য জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত গায়িকা। মতামত নিজস্ব)