Somlata Acharyya Chowdhury

এই ভোটে কার কী গান? শাসক-বিরোধী-ভোটারের জন্য আলাদা আলাদা ‘থিম সং’ বাছলেন গায়িকা ‘বনবিহারিণী’

সুস্থ গণতন্ত্রে শাসক থাকে। থাকে বিরোধী। আর থাকেন ভোটার। গোটা পরিস্থিতি বিচার করে সঙ্গীতের পরিভাষায় ‘ডিকোড’ করলে এই তিন কাঠামোর জন্য আলাদা আলাদা গান মাথায় আসে।

Advertisement
সোমলতা আচার্য চৌধুরী
শেষ আপডেট: ১৮ এপ্রিল ২০২৪ ০৮:০১
Bengali Singer Somlata Acharyya Chowdhury writes on the upcoming Lok Sabha Election 2024

আমি রাজনীতির লোক নই। রাজনীতিতে খুব উৎসাহ আছে, তেমনও নয়। আমি গানের মানুষ। গানে থাকি। গানে আছি। গানেই থাকতে চাই। কিন্তু আনন্দবাজার অনলাইনের তরফে প্রস্তাব এসেছে, আমার মতে এই লোকসভা ভোটে শাসক, বিরোধী এবং ভোটারদের জন্য আলাদা আলাদা ‘থিম সং’ বেছে দেওয়ার।

Advertisement

চেষ্টা করি?

আমাদের ছোটবেলায় যে জিনিসগুলোকে ‘খারাপ’ বলে শেখানো হয়েছিল, এখন দেখি সে সবই খুব স্বাভাবিক। অসত্য বলা, চুরি করা, কাউকে ঠকানো, অকারণে কাউকে আঘাত করা— এ সবে আমাদের বিধিনিষেধ ছিল। এখন সবই খুল্লমখুল্লা। কিছুতেই কোনও দোষ নেই যেন! ইদানীং বিশেষ কিছুই আর বুঝে উঠতে পারি না। বার বার অমর পালের সেই গানটা মাথায় আসে। ঘুরে বেড়ায়— ‘কতই রঙ্গ দেখি দুনিয়ায়…আমি যেই দিকেতে চাই, দেখে অবাক বনে যাই, আমি অর্থ কোনও খুঁজে নাহি পাই রে।’ এ গান তো রাজনীতির ক্ষেত্রে সত্যিই। বড্ড বেশি সত্যি। যা হচ্ছে, যা দেখছি দেশ জুড়ে, তাতে এ গান একেবারে লাগসই।

সুস্থ গণতন্ত্রে শাসক থাকে। থাকে বিরোধী। আর থাকেন ভোটার। গোটা পরিস্থিতি বিচার করে সঙ্গীতের পরিভাষায় ‘ডিকোড’ করলে এই তিন কাঠামোর জন্য আলাদা আলাদা গান মাথায় আসে। তবে সে সব একান্তই ব্যক্তিগত। কোথাও নিজের গান খুঁজে পাই। কোথাও আবার লালন সাঁই। বাংলা সঙ্গীতের এই বিপুলা ভান্ডার থেকে এই মুহূর্তে তিনটে গান আলাদা আলাদা করে মনে পড়ছে।

শাসকের জন্য: ‘জাত গেল জাত গেল বলে।’

এটা লোকসভা নির্বাচন। তাই শাসক বলতে দেশের নিরিখেই ভাবছি। বেশ কয়েক বছর ধরে দেখছি ধর্মের নামে, জাতপাতের নামে দেশ জুড়ে একটা উন্মাদনা কাজ করছে। সেই উন্মাদনায় শাসকের ভূমিকা অত্যন্ত ‘সদর্থক’। আমার মনে হয়, ধর্ম আর জাতপাত নিয়ে আমরা আরও বেশি প্রাচীনপন্থী হয়ে গিয়েছি। যত দিন এগিয়েছে, তত আমরা এ বিষয়ে পিছিয়ে গিয়েছি। ভুলে গিয়েছি, এ সবের বাইরেও অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ করার জায়গা রয়েছে। সে সব জায়গা অবহেলিতই রয়ে গিয়েছে। লালন তো সেই কবেই লিখে গিয়েছেন, ‘জাত গেল জাত গেল বলে/ একি আজব কারখানা/ সত্য কাজে কেউ নয় রাজি/ সবই দেখি তা না না না।’ এই গানেরই আর একটা স্তবক আরও গুরুত্বপূর্ণ। যেখানে লালন বলছেন, ‘ব্রাহ্মণ চণ্ডাল চামার মুচি/ এক জলে সব হয় গো শুচি/ দেখে শুনে হয় না রুচি/ যমে তো কাউকে ছাড়বে না।’ আমরা আসলে ভুলতে বসেছি যে, এ সবের বাইরেও একটা দুনিয়া আছে। এ সব বাদ দিয়েও জীবন চলে। সেই জীবন চালাতে গেলে যেখানে যেখানে নজর দেওয়া প্রয়োজন, সেখানে খুব একটা গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে না। সেই সব কাজেই তো শাসকের ‘ফোকাস’ করা উচিত। আমি যদিও উচিত-অনুচিত বলার কেউ নই। তবে নাগরিক হিসাবে ভাবনাচিন্তা এড়াতে পারি না। ইদানীং একটা বিষয় দেখি, কারও মতের সঙ্গে অমিল হলেই তাঁকে দাগিয়ে দেওয়া হয় ‘বিরোধী’ বা ‘খারাপ’ বলে। ভুলে যাওয়া হয়, সকলেই আলাদা আলাদা চরিত্র। তাদের আলাদা বেড়ে ওঠা। লেখাপড়া আলাদা। সংস্কৃতি আলাদা। কৃষ্টিও আলাদা। মতের অমিল হতেই পারে। সেটাই স্বাভাবিক। নিজের মতকে মান্যতা দিয়ে অন্যের মতকে সম্মান করতে পারাটাই তো গণতন্ত্র। এটাই আমরা যেন ভুলতে বসেছি।

বিরোধীর জন্য: ‘তুমি আসবে বলে তাই।’

গণতন্ত্রে শাসকের মতো বিরোধীদেরও একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। কিন্তু কেন্দ্র বলুন বা এই রাজ্য, সেই অর্থে শক্তপোক্ত বিরোধী কোথায়! আমার সব সময় মনে হয়েছে, গণতন্ত্র তখনই সুস্থ হয়, যখন সেখানে শক্তপোক্ত বিরোধী থাকে। আমাদের মতো দেশে তো আরও বেশি করে বিরোধী আসা উচিত। কারণ, সরকারে যারাই থাকুক, তাদের তো ভুলত্রুটি হতে পারে। চোখে আঙুল দিয়ে সে সব দেখানোই তো বিরোধীর কাজ। যদি বিরোধী নড়বড়ে হয়, তা হলে সরকারকেও নড়বড়ে লাগবে। তবে বিরোধীদের ভূমিকা সদর্থক হতে হবে। না হলে সবটাই জলে যাবে। বিরোধী শক্তপোক্ত হলে শাসকের ভাল কাজ করার তাগিদ আরও বাড়ে বলে আমি মনে করি। সরকার পক্ষও চাপে থাকে। নইলে গণেশ উল্টে অন্যেরা চলে আসতে পারে। বিরোধীদের জন্য আমি আমারই গাওয়া ‘তুমি আসবে বলে তাই’ গানটা বাছতে চাই। কারণ, তার পরের লাইনেই অঞ্জনদা (অঞ্জন দত্ত) লিখেছিলেন, ‘আমি স্বপ্ন দেখে যাই/ আর একটা করে দিন চলে যায়।’ সত্যিই তো একটা শক্তপোক্ত বিরোধী দল কত দিন দেখেনি আমার দেশ!

ভোটারের জন্য: ‘অধিকার কে কাকে দেয়, অধিকার কেড়ে নিতে হয়।’

গণতন্ত্রের এই সিস্টেমে আমি সব চেয়ে বেশি সংশয়ে আমাদের নিয়ে। অর্থাৎ, ভোটারদের নিয়ে। অথচ নির্বাচনের সময় আমরাই সব চেয়ে বেশি শক্তিশালী। কিন্তু কেন জানি না, নিজেদের ভূমিকা নিয়ে আমি খুব সন্দিহান থাকি। অথচ আমরাই পারি গোটা খেলা ঘুরিয়ে দিতে। পাল্টানোর ক্ষমতা তো আমাদেরই হাতে। কিন্তু আমরা সেটা করি না। হতে পারে, কোনও বিশেষ রাজনৈতিক দলের প্রতি আমার দুর্বলতা রয়েছে। পছন্দের দল ভাল কাজ করলে যেমন খুশি হই, তেমন এই ভাবনাও থাকা প্রয়োজন যে, সেই দল ভাল কাজ না করলে আমি তার সমালোচনা করব। আমাদের, ভোটারদের আরও বেশি বুদ্ধি-বিবেচনা প্রয়োগ করা উচিত। পছন্দের দলের তরফে যা পাঠানো হচ্ছে, তাতে অন্ধবিশ্বাস না রাখাই বুদ্ধিমানের কাজ। নিজের পড়াশোনা দিয়ে সেটা যাচাই করে নেওয়া উচিত। তার পর সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত। আমাদের ভোটারদের সেই ধারণাটাই যেন এখনও তৈরি হয়নি। সলিল চৌধুরীর ওই গানটা তাই আমাদের জন্য খুব প্রযোজ্য— ‘অধিকার কে কাকে দেয়/ অধিকার কেড়ে নিতে হয়।’

শেষে: ‘কাঁধে কাঁধ মেলাই, হাতে হাত মেলাই, এসো বন্ধু।’

এ সব তো ছিল। থাকবেও। তা বলে কি স্বপ্ন দেখব না! অবশ্যই দেখব। ‘উমা’ ছবিতে উজ্জয়িনীর সঙ্গে আমি একটা গান গেয়েছিলাম। সব শেষে সেই গানটার কথা আপনাদের বলতে চাই— ‘কিসের ডাকে মাঠে নেমেছি/ নেমেছি যখন ভালবেসেছি/ কাঁধে কাঁধ মেলাই/ হাতে হাত মেলাই/ এসো বন্ধু/ আকাশ যতই ভয় দেখাক, তুমি থেমো না, সবাই আশা ছেড়ে দিলেও তুমি ছেড়ো না।’

(লেখক গায়িকা। মতামত নিজস্ব)

আরও পড়ুন
Advertisement