(বাঁ দিকে) বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য এবং নরেন্দ্র মোদী। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
আপনার সঙ্গে এত দিন যে বিশিষ্টজনেরা ছিলেন, তাঁদের মধ্যে অনেকেই তো আর আপনাদের সঙ্গে নেই। তাঁরা এখন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে পথ হাঁটছেন। কেন? কী মনে হয় আপনার?
মোটা ফ্রেমের চশমার কাচের ও পার থেকে সটান তাকালেন তিনি। তার পরে কণ্ঠস্বরটি সম্ভবত খানিক বেশিই মন্দ্র করে নিয়ে বললেন, ‘‘তাঁদের ছবি-টবি তো আপনার কাগজেই রোজ ছাপা হয়!’’
তৎকালে নবীন এবং অধুনালুপ্ত প্রভাতী ট্যাবলয়েডের ত্যাঁদড় এবং নাছোড় সমন্বয়সাধক সম্পাদক (কো-অর্ডিনেটিং এডিটর) জবাবে বলেছিল, ‘‘ওটা আমার কাগজ নয়। অভীক সরকারের কাগজ। আমি বেতনভুক কর্মচারী মাত্র।’’ সামান্য বিরতি দিয়ে, ‘‘এ বার যদি দয়া করে প্রশ্নের জবাবটা দেন।’’
২০১৪ সালের লোকসভা ভোটের পূর্বাহ্ণে কলকাতা প্রেস ক্লাবে ‘মিট দ্য প্রেস’ করতে-আসা প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর সুচিন্তিত এবং সংক্ষিপ্ত ‘জবাব’ এল, ‘‘আমি ওঁদের নিয়ে কোনও মন্তব্য করতে চাই না।’’
শুনতে শুনতে ২০১১ সালের বিধানসভা নির্বাচনের (সেই ভোটে তাঁর কোনও একটা প্রচারসভায় যাওয়ার পথে গাড়িতে সঙ্গী হতে চেয়ে মুখ্যমন্ত্রীর সচিবালয়ে আবেদন জানিয়েছিলাম। পেশাগত কারণেই। প্রত্যাশিত ভাবেই যা প্রত্যাখ্যান করা হয়েছিল) অব্যবহিত আগে আলিমুদ্দিনে তাঁর সাংবাদিক বৈঠকের কথা মনে পড়ছিল। ঘটনাচক্রে, সে দিনই আনন্দবাজার পত্রিকায় তাঁর নির্বাচনী প্রচার অভিযান নিয়ে একটা লেখা প্রকাশিত হয়েছে। যাতে লেখা হয়েছে, নন্দীগ্রামে গুলিচালনার দিন তিনি ছিলেন বিধানসভা ভবনে। সংঘর্ষের খবর আসার পরে বিধানসভায় কাউকে ডেকে নন্দীগ্রাম থানার অফিসার ইন-চার্জকে তাঁকে ফোনে ধরিয়ে দিতে বলেছিলেন। মনেই হয়েছিল, তিনি কুপিত হবেন। আশ্চর্য নয় যে, নামোল্লেখ না করে সাংবাদিক বৈঠকে আপাত-নৈর্ব্যক্তিক পাল্টা উড়ে এল, ‘‘আজ একটা কাগজে বেরিয়েছে, নন্দীগ্রামের ঘটনার দিন আমি সেখানকার ওসি-কে ফোন করেছিলাম। কথাটা ঠিক নয়। আমি কখনও কোনও ওসি-র সঙ্গে কথা বলি না!’’
প্রশ্নটা উড়ন্ত বটে। কিন্তু তার অভিমুখ স্পষ্ট। হাওয়া থেকে সেটা খপাত করে লুফে নিয়ে সবিনয়ে জানানো গেল, কোথাও লেখা হয়নি, তিনি নিজে ফোন করেছিলেন। লেখা হয়েছে, তিনি কোনও এক জনকে বলেছিলেন, ফোনে তাঁকে নন্দীগ্রাম থানার ওসি-কে ‘ধরিয়ে দিতে’।
জবাব আসেনি। কিন্তু তাঁর কণ্ঠের দার্ঢ্য, মাপা এবং স্পষ্ট উচ্চারণ শুনতে শুনতে মনে পড়ছিল, ২০০৬ সালের বিধানসভা ভোটে বামফ্রন্ট পশ্চিমবঙ্গে ২৩৫টি আসন জেতার পরে তিনি বলেছিলেন, ‘‘আমরা ২৩৫! ওরা ৩০! আমাদের কে রুখবে!’’
বাকিটা ইতিহাস! রাজনীতির মনোযোগী ছাত্র হিসেবে মনে করি, ওই কয়েকটি বাক্যই বঙ্গ রাজনীতির বামশাসনের অবসানের ‘ইট মোমেন্ট’ হয়ে রয়ে যাবে। সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের জন্ম ওই মুহূর্ত থেকেই। যার মাসুল সিপিএমকে এখনও ভোটের বাক্সে দিতে হচ্ছে। সেই ২৩৫ থেকে কমতে কমতে সিপিএম শূন্যে এসে নেমেছে। একের পর এক ভোট চলে যায়। সিপিএমের খাতা আর খোলে না! পিছিয়ে গেলে মনে হয়, ওই ‘রোখে কে’ আস্ফালনই সিপিএমের দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি করে দিয়েছিল। জনতা মাফ করেনি।
পাম অ্যাভিনিউয়ের সরকারি আবাসনের একতলার অপরিসর ফ্ল্যাটের বাসিন্দা অসুস্থ, অশক্ত বৃদ্ধ কি পিছু ফিরে ভেবে দেখেন যে, ওই কথাটা ওই ভাবে বলা উচিত হয়নি? ভেবে দেখেন কি যে, গণতন্ত্রে সংখ্যার গরিষ্ঠতাকে নৃশংসতার অবয়ব দিতে নেই? সংখ্যার আস্ফালন করতে নেই?
বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সেই ‘আত্মঘাতী বাক্য’টি মনে পড়েছিল এই লোকসভা ভোটের আগে। যখন লোকসভায় দাঁড়িয়ে নরেন্দ্র মোদী বুক ঠুকে বলেছিলেন, বিজেপি এ বার ৩৭০টা আসন পাবেই! আর এনডিএ ৪০০ পেরিয়ে যাবে!
শুনে একটু টিকটিক করছিল ভিতরে-ভিতরে। হতে পারে ২০১৯ সালে তাঁর নেতৃত্বে বিজেপি ৩০৩টি রেকর্ড আসন পেয়েছিল। কিন্তু তা বলে সেখান থেকে এক লাফে একেবারে ৩৭০ আসন পাওয়ার নির্ঘোষ? তা-ও আবার লোকসভার মধ্যে দাঁড়িয়ে? জনসভায় রাজনীতিকেরা অনেকে অনেক কথা বলে থাকেন। কখনও সমর্থকদের তাতানোর জন্য। কখনও দলীয় ক্যাডারদের উজ্জীবিত করার জন্য। কখনও আরও সাত-সতেরো কারণে। জনসভায় বলা সে সব বক্তব্য জনসভার হাওয়াতেই মিলিয়ে যায়। তার কোনও সংসদীয় পবিত্রতা থাকে না। কোনও সরকারি রেকর্ডও থাকে না। মনে হচ্ছিল, মোদী এতটাই নিশ্চিত এবং এতটাই নিশ্চিন্ত যে, সংসদে যে তাঁর রেকর্ড থেকে যাবে, সেটাও ভাবছেন না?
মোদীকে দেশের ‘পরিত্রাতা’ বলে মনে করেন, এমন দু-এক জন দিগ্গজকে শুধোলাম। তাঁরা মোদীর চেয়েও খানিক নিশ্চিত হয়ে জবাব দিলেন, হতেই পারে! মোদী দেশকে এমন জায়গায় নিয়ে গিয়েছেন যে, এই আত্মবিশ্বাস তাঁর মধ্যে থাকতেই পারে। মিউ মিউ করে বললাম, তা বলে লোকসভায় দাঁড়িয়ে এটা বলা যায়? রেকর্ড থেকে গেল তো! মানবসভ্যতা থাকা পর্যন্ত থেকে যাবে। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম দেখতে পাবে। ভবিষ্যৎ ছাড়ুন, ভোটের ফলঘোষণার পরে একা ৩৭০টা আসন না-পেলেও তো লোকে দুয়ো দেবে। এ তো ভারত-পাকিস্তান ম্যাচের আগে বিরাট কোহলির এক্স হ্যান্ডলে ঘোষণা করে দেওয়া যে, ‘হে মোর দেশবাসী, আমি এই ম্যাচে সেঞ্চুরি করছি।’ এটা তো একটা ফালতু চাপ। কেন নিতে গেলেন মোদী?
দিগ্গজেরা জবাব দেওয়ার প্রয়োজন মনে করলেন না। উল্টো দিকের প্রাণীটির দিকে চেয়ে করুণার হাসি হাসলেন শুধু। সেই নীরব হাসিতে বলা ছিল, ‘হে মোদীদেবতা, এই অর্বাচীন জানে না, এ কী বলছে! তুমি একে মাফ করে দিয়ো।’
হবে হয়তো!
মঙ্গলবার, ৪ জুন যখন বিজেপির জয়ের মিটার ধুকপুক করতে করতে ক্রমশ নীচের দিকে নামছে, ভাবছিলাম লোককল্যাণ মার্গের প্রধানমন্ত্রী আবাসের নরম গদি কি নারকেলের ছোবড়ার মতো গায়ে ফুটছে নরেন্দ্র মোদীর? যখন রামমন্দিরের সযত্নে নির্মিত আবেগকে এক চোপাটে সরযূ নদীর জলে উড়িয়ে নিয়ে গিয়ে ফেলল অযোধ্যার ধাত্রী ফৈজাবাদ লোকসভা কেন্দ্রের ফল, তখন কী মনে হচ্ছিল তাঁর? রামলালাকে তিনিই ঘর বানিয়ে দিলেন মার্কা দম্ভটা না-দেখালেও চলত? অথবা রাতারাতি অযোধ্যাকে ‘আন্তর্জাতিক শহর’ বানাতে গিয়ে নিরীহ কিছু ঘরবাড়ির উপর বুলডোজ়ার না-চালালেও চলত? তিনি কি ভেবেছিলেন, সেই বুলডোজ়ারের নীচেই গুঁড়িয়ে যেতে পারে তাঁর এবং তাঁদের যাবতীয় অহমিকা?
কিংবা যখন তাঁর দলের আসন সংখ্যাগরিষ্ঠতারও অনেক নীচে, ২৪০-এ গিয়ে থামল (ভাগ্যিস থামল! যদি আরও নেমে যেত?), তখন কি তাঁর মনে পড়ছিল লোকসভার ফ্লোরে দাঁড়িয়ে সেই সদম্ভ ঘোষণার কথা?
তিনি কি ভাবছিলেন ‘মোদীর গ্যারান্টি’, ‘মোদীর সরকার’, ‘মোদীকে ঈশ্বর পাঠিয়েছেন মানুষের কাজ করতে’ ইত্যাকার বিবৃতি আসলে এক ধরনের আমিত্বের আস্ফালনে মোড়া? যে আস্ফালন বলছে, আমি আসলে মনুষ্য নই। ঈশ্বরপ্রেরিত মহামানব। আমি মাটি থেকে কিছুটা উপর দিয়ে চলি। মর্ত্যে এসেছি কিছু চ্যাং-ব্যাঙের উপকার করতে। সে কর্তব্য হয়ে গেলে আবার নিজের জগতে চলে যাব। সেই আস্ফালনই কি তাঁকে দিয়ে লোকসভার অন্দরে ওই ৩৭০-এর বহ্বাস্ফোট করিয়ে নিয়েছিল?
মোদী কি ভুলে গিয়েছিলেন ইন্দিরা গান্ধীর কথা, যিনি নিজেকে আলোকিত করতে করতে এমন জায়গায় পৌঁছেছিলেন যে, দেশে জরুরি অবস্থা জারি করতেও দু’বার ভাবেননি!
জনতা মাফ করেনি। ইন্দিরাকে ক্ষমতা থেকে হটিয়েছিল তারা। মোদীকে খানিকটা ঝুঁকিয়ে দিল।
বলেছিলেন একার জোরে ৩৭০ আসন পাবেন। থামতে হল ২৪০ আসনে। ১৩০টা কম! এক-শো-তিরিশ! তবে না শরিক দলের নেতাদের দেখে প্রকাশ্যে লুড়লুড় করতে হল! এনডিএ-র বৈঠকে প্রকাশ্যে ‘আমি’ বিসর্জন দিয়ে ‘আমরা’-কে আঁকড়ে ধরতে হল। বলতে হল, ‘‘ব্যক্তিগত জীবনে জবাবদিহি করার প্রয়োজন আছে বলে মনে করি।’’ মিটিংয়ে নিজের পছন্দের অমিত শাহের বদলে চন্দ্রবাবু নায়ডুকে পাশে নিয়ে বসতে হল। নীতীশ কুমারকে দেখে গদগদ হাসতে হল। তাঁর আমলে দলের অন্দরে ‘হরিজন’ রাজনাথ সিংহ, নিতিন গডকড়ীকে দিয়ে বক্তৃতা করাতে হল। দিনে সর্বাধিক ছ’বার পোশাক বদলের রেকর্ডধারীকে সারা দিন একই কচি কলাপাতা রঙের জ্যাকেট পরে রাষ্ট্রপতি ভবন থেকে পরিবেশ দিবসে গাছে জল দেওয়া এবং শরিক নেতাদের সঙ্গে বৈঠক সারতে হল!
পাম অ্যাভিনিউয়ের সরকারি আবাসনের চিলতে ঘরের বৃদ্ধ বাসিন্দা লোকসভা ভোটের ফলাফল শুনতে শুনতে সম্ভবত মনে মনে ভাবছিলেন, ঠিকই। নম্রতা, ভদ্রতা, বিনয়, সৌজন্য বাদ দিলে যেমন সিভিল সোসাইটি চলে না, তেমনই গণতন্ত্রে সংখ্যার দম্ভ এবং আস্ফালন চলে না। ১৩ বছরের এ পাশে-ও পাশে তিনি এবং নরেন্দ্র মোদী সে কথা বুঝলেন। ১৩ বছর আগে ২০১১ সালের ভোটে তিনি হেরে গিয়েছিলেন তাঁর যাদবপুর কেন্দ্রে। ১৩ বছর পরে বারাণসীতে নরেন্দ্র মোদীর জয়ের ব্যবধান কমে গেল ৩ লক্ষ ২৭ হাজার ভোট। ২০১৯ সালে জিতেছিলেন ৪ লক্ষ ৮৯ হাজার ভোটে। ২০২৪ সালে জিতেছেন ১ লক্ষ ৫২ হাজার ভোটে।
অক্সিজেন সিলিন্ডার-নির্ভর জীবনে অভ্যস্ত হয়ে-যাওয়া কমিউনিস্ট নেতা সম্ভবত ভাবছিলেন, একটু ঝুঁকে থাকতে হয়। ঝুঁকতে পারেননি বলে তাঁকেও জনতা মাফ করেনি। জনতা মাফ করে না।
এ দেশের জনতা তথাকথিত ভিখিরি, অজ্ঞ এবং অশিক্ষিত হতে পারে। কিন্তু তারা জাগ্রত থাকে। জাগ্রত আছে।