জয়ী: লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির সাফল্য উদ্যাপনে মেতেছেন সমর্থকরা। বেঙ্গালুরু, ৪ জুন। ছবি: পিটিআই।
সাতটি দফা ধরে প্রবল গ্রীষ্মের মধ্যে ২০২৪ সালের সাধারণ নির্বাচন শেষে ফলাফল প্রকাশের দিন ভারতের নাগরিক হিসাবে আমার সামর্থ্য অনুযায়ী এই নির্বাচনের অর্থ নিয়ে যখন লিখতে শুরু করেছি, তখনও সব গণনার ফল প্রকাশিত হয়নি।
কিন্তু একটি ব্যাপার পরিষ্কার। নরেন্দ্র মোদীর দশ বছর প্রধানমন্ত্রিত্বের সুবাদে নিছক একনায়কতান্ত্রিক দলে পরিণত ভারতীয় জনতা পার্টির আসনসংখ্যা রয়ে যাবে ২৪০-এর ঘরে। অর্থাৎ কোনও সম্ভাবনা নেই যে, সংসদের নিম্নকক্ষে বিজেপি ২৭২ ম্যাজিক সংখ্যা অতিক্রম করে প্রতিষ্ঠা করতে পারে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা। তবে একই সঙ্গে এই বিষয়েও কোনও সন্দেহ নেই যে, বিজেপিই হবে বৃহত্তম দল। রাষ্ট্রপতি ভবন থেকে তাদের কাছেই সরকার গড়ার প্রথম নিমন্ত্রণ আসা স্বাভাবিক, কিন্তু তার জন্য বিজেপির প্রয়োজন ন্যাশনাল ডেমোক্র্যাটিক অ্যালায়েন্সের (এনডিএ) জোটসঙ্গীদের।
অন্ধ্রপ্রদেশে চন্দ্রবাবু নায়ডুর তেলুগু দেশম পার্টি (টিডিপি) এবং বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমারের জনতা দল (ইউনাইটেড) পার্টি বা চিরাগ পাসোয়ানের লোক জনশক্তি পার্টি— এ সব এনডিএ সদস্যদল মিলেজুলে বিজেপিকে হয়তো তিনশোর কাছাকাছি সমর্থক সংগ্রহ করতে সমর্থ হবে।
তবে তারা কি মেনে নেবে মোদীর তৃতীয় আবির্ভাব? সেই সঙ্গে বিজেপি সংসদীয় দলও কি হাসিমুখে গ্রহণ করবে মোদী, তাঁর দোসর গৃহমন্ত্রী অমিত শাহ এবং তাঁদের রাজ্য গুজরাত থেকে বাছাই করে আমদানিকৃত শক্তিশালী আমলাদের পুনরাভিষেক? সংক্ষেপে, সেই মোদী কি রইবেন এই মোদী? কোনও একনায়কের পক্ষে কি সম্ভব তাঁর হাবভাব পুরো পাল্টে পারস্পরিক মতবিনিময়ের মাধ্যমে একটি জোট সরকার পরিচালনা করার?
এক কথায় উত্তর— না। কোনও গণতান্ত্রিক জোটের মাধ্যমে কি হিটলার হয়েছিলেন দেশের সর্বময় কর্তা, ফ্যুয়েরার? হয়েছিলেন ছলচাতুরি ও হিংসার মাধ্যমে। ইতিহাস তো তাই বলে। অর্থাৎ ভারতের যে মূলগত পরিবর্তন ঘটানোর জন্য মোদী শুরু থেকেই সচেষ্ট— ভারতের উদারবাদী রাষ্ট্রকল্পনাকে এক হিন্দুত্ববাদী ও বিভেদকামী ধারণায় পরিবর্তিত করা— তা কাজে পরিণত করতে ক্ষমতার মূল কেন্দ্রে মোদী ও তাঁর পার্শ্বচরদের উপস্থিতিই যথেষ্ট। মানুষ যদি সজাগ না থাকে (যেমন বিগত দশ বছরের অধিকাংশ সময়), তবে সংসদে কার কত আসন তার উপরে মোটেও নির্ভর করে না দেশে ফ্যাসিবাদের অবতরণ।
সাম্প্রতিক কালে লোকসভায় মোদী সরকারের ফ্যাসিবাদী লক্ষণ সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করেছেন অনেক সদস্য, যেমন কংগ্রেসের রাহুল গান্ধী বা তৃণমূল কংগ্রেসের মহুয়া মৈত্র। আশার কথা যে, এই নির্বাচনে বিরোধীপক্ষ তুলনায় অনেক বেশি সংখ্যক আসনে জয়লাভ করেছেন, অর্থাৎ বিগত লোকসভার তুলনায় আসন্ন লোকসভায় বিরোধী দলের সাংসদদের সংখ্যা অনেক বেশি থাকবে। কিন্তু মনে হয় না যে, তার ফলে নরেন্দ্র মোদীর সেই সব পরিকল্পনায় যতিচিহ্ন পড়বে, যে সব সিদ্ধান্ত নিহিত ছিল তাঁর “আগলি বার চারসো পার” ঘোষণার অন্তরালে।
তিনি কী করবেন— কখন ও কী ভাবে— তা কারও জানা থাকার কথা নয়। তবে ‘আগলি বার’ নতুন পদক্ষেপের ইশারা তিনি দিয়েছেন অত্যন্ত ইঙ্গিতময় পরিভাষায়। যেমন কন্যাকুমারীতে ধ্যানভঙ্গের পর তিনি বললেন যে, তিনি নাকি ‘নতুন স্বপ্ন’ দেখতে শুরু করেছেন। মোদীকে যাঁরা লক্ষ করেছেন তাঁরা জানেন, তিনি মোটেই কবিত্বময় স্বপ্নবিলাসী নন। তাঁর পরিভাষায় স্বপ্ন মানে নতুন অ্যাকশন প্ল্যান। তা যেমন হতে পারে সংবিধান পাল্টানোর কোনও পরিকল্পনা, অথবা এনআরসি বা জাতীয় নাগরিকপঞ্জি কার্যকর করার সঙ্কল্প। সে পরিকল্পনা সফল হলে যে কোনও প্রতিবাদীকে অনির্দিষ্ট কালের জন্য কারাবন্দি করা যায়, যেমন তা পরীক্ষামূলক ভাবে করা হয়েছে অসমে। ফ্যাসিবাদের ধর্ম হল নাগরিক সমাজের একটি অংশকে, যারা কার্যত বা সম্ভাব্য প্রতিবাদী, তাদের ‘বহিরাগত’ তকমা লাগিয়ে দেওয়া। একেই বলে ‘আদারিং’ বা অপরায়ণ। সেই চেষ্টা মোদী করেছিলেন নির্বাচন প্রচারের সময়ে, ঘুসপেটিয়া ইত্যাদি বাক্যাংশ ব্যবহার করে।
যাঁরা ভাবছেন যে, এই নির্বাচনের ফলাফলে অন্তত দমিত হবে নরেন্দ্র মোদীর অহঙ্কার, তাঁরা বোধ হয় ঠিক ব্যাপারটি বুঝতে পারেননি। অধিকাংশ আইন সংশোধিত হয় সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতায়— কেবলমাত্র কিছু সাংবিধানিক পরিবর্তনের জন্য আয়োজন হয় বিশেষ গরিষ্ঠতার, দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার। সরকারের বিপুল অর্থভান্ডার, ইডি প্রভৃতি প্রতিষ্ঠান এবং পেগাসাস জাতীয় সফটওয়্যার হাতে থাকলে সব আইনপ্রণেতা কি থাকতে পারেন প্ররোচনার উপরে?
মোদীর গত দশ বছরের মতিগতি দেখে কিন্তু দেশের মানুষ তাঁকে পরিত্যাগ করেননি। ২০১৯ সালের চেয়ে অধিক শতাংশের মানুষ এ বার তাঁকে ভোট দিয়েছেন। তিনি পূর্ণ সমর্থন পেয়েছেন দিল্লির মতো ধনী শহরে, অথবা উত্তরাখণ্ড বা হিমাচল প্রদেশের মতো রাজ্যে, যেখানে বাস করতেন মূলত উচ্চবর্ণের ধনী জমি মালিক, যাঁদের মধ্যে অনেকে সেনাবাহিনীর সঙ্গে জড়িত হওয়ার দরুন বিজেপির দেশপ্রেম সংক্রান্ত কথাবার্তায় বিশেষ স্পর্শকাতর। ব্যাপক অর্থে, সম্পন্ন শহুরে মানুষের সমর্থন আদায় করেছেন মোদী। ঠিক যেমন হিটলার আদায় করেছিলেন জার্মানিতে, আজ থেকে নয় দশক আগে।