নরেন্দ্র মোদী ইতিহাস তৈরি করলেন। প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর পর মোদীই একমাত্র, যিনি প্রধানমন্ত্রিত্বের তৃতীয় দফায় পৌঁছলেন। কিন্তু সেটাই সব নয়। আরও অনেক দিক দিয়ে তিনি এ দেশকে ঐতিহাসিক নির্বাচনের স্বাদ এনে দিলেন। ২০২৪ সালের জাতীয় নির্বাচনটি সাতাত্তর বছরের স্বাধীন দেশের যাত্রাপথে ১৯৫২, ১৯৭৭, ২০০৪-এর মতো আর এক অবিস্মরণীয় নির্বাচনের দৃষ্টান্ত হয়ে রইল।
বাহান্ন বাদে অন্য বছরগুলির দিকে তাকিয়ে যেন একটা নকশা দেখতে পাওয়া সম্ভব। প্রতিটিতেই শাসক বুঝতে পারেননি, কোথায় তিনি বা তাঁরা ‘সীমা’ ছাড়িয়ে গিয়েছেন— এই বিরাট দেশের দশ দিক জুড়ে দারিদ্র-অশিক্ষা-অস্বাস্থ্য-অনধিকার জর্জরিত মানুষ শাসকদের বুঝিয়ে দিলেন ‘সীমা’র হদিসটা তাঁরা বলে দিতে পারেন, রাজার কাপড় নিয়ে সপাট প্রশ্ন তুলতে পারেন। আর এমন ভাবে তুলতে পারেন যে, কেউ আগে থেকে বুঝতেও পারবে না— তাঁরা কী করতে চলেছেন। এক্সিট পোল-মশাইরা নাহয় নানা ‘পাকে-চক্রে’ নিজেদের জড়িয়ে ফেলে সব ভুলভাল কথা বললেন, কিন্তু কোনও রাজনৈতিক দলের নেতাকর্তারাও কি বুঝতে পারছিলেন জনগণমন-র চলনটা কেমন? ওঁদের এ ভাবে অন্ধকারে রাখতে পারাটাই তো একটা বিরাট কৃতিত্ব: ‘গণতন্ত্র’ নামের একটা জাদু-ব্যবস্থাকে ব্যবহার করে সেই কৃতিত্বের অধিকারী হলেন ভারতবাসী: ‘ঐতিহাসিক’ মুহূর্ত ছাড়া আর কী!
২০২৪ সালটা শুরু থেকেই ইতিহাসে প্লাবিত। ১৯৯২ সালে বাবরি মসজিদ ভাঙা থেকে শুরু করে দেশে ধর্ম-বেচাকেনার বত্রিশ বছরের উদ্ভ্রান্ত রাজনীতির একটা পরিক্রমা শেষ হল ২০২৪-এর জানুয়ারিতে, রামমন্দিরের উদ্বোধন মহাযজ্ঞ দিয়ে। আর সেই মহাযজ্ঞের মহাকেন্দ্র অযোধ্যাতেই কিনা তিন-চার মাস পর বসে গেল যজ্ঞকর্তাদের রথের চাকা। একনায়কের হুহুঙ্কার আর ধর্মীয় উন্মাদনা তৈরির অপপ্রয়াসে শক্ত হাতে রাশ টেনে ধরল মানুষের নিঃশব্দ ভোট-প্রতিবাদ। উত্তরপ্রদেশের সঙ্গে রাজস্থানেও বিরোধীদের যে সাফল্য এ বার নজর কাড়ছে, তার কতটা ইঙ্গিত ছিল শাসকদের কাছে? দল-বদল আর খেলা ভাঙার খেলায় মহারাষ্ট্রের মানুষের প্রতিরোধ আর এক উল্লেখযোগ্য চমক। কৃষক আন্দোলনের অভিঘাত ও সেনাবাহিনীর নিয়োগে হঠকারী সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধতার যেমন সরাসরি প্রতিফলন হরিয়ানা, পঞ্জাব আর উত্তরপ্রদেশের একটা বড় অংশে, দেখে মনে হয় যেন মুখে-মুখে কথা না বলে চোখে-চোখে ঘটে গেল এক নীরব বিদ্রোহ।
এই নির্বাচন ঐতিহাসিক এক অন্য কারণেও। বিরোধী দলগুলি যা করতে চেয়েছে, তার প্রায় কিছুই করে উঠতে পারেনি। কংগ্রেসের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট আটকে দেওয়া হয়েছে। আর্থিক দিক দিয়ে শাসক দলের সঙ্গে সঙ্গে অন্য সকলের অ-তুলনীয় দূরত্ব তৈরি হয়েছে। দুই রাজ্যের নির্বাচিত মুখ্যমন্ত্রীকে নির্বাচনের মুখে হাজতে ঢোকানো হয়েছে, যে ভয়ের রেশ ছড়িয়েছে অন্যত্রও। সরকারি দমনযন্ত্রের যথেচ্ছ ব্যবহার চলেছে, ইডি-সিবিআই দিয়ে যে সব বিরোধী নেতার বিরুদ্ধে মামলা আনা হয়েছে, তাঁদের মধ্যে ২৫ জন বিজেপি-তে যোগ দিলে তাঁদের ২৩ জনেরই মামলা তুলে নেওয়া হয়েছে। দেশজোড়া প্রায় সমস্ত প্রচারমাধ্যমকে কেন্দ্রীয় সরকার টেনে নিজেদের পক্ষে এনেছে, ভয় দেখিয়েছে, পূর্ণমাত্রায় নিয়ন্ত্রণ করেছে। সভ্যতা-শালীনতা-গণতন্ত্র সীমা ছাড়িয়ে ধর্মীয় মেরুকরণ চলেছে, প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনী বক্তৃতায় নিজের মুখে বহু বার সংখ্যালঘু মুসলমানদের নিয়ে বিষাক্ত প্রচার করেছেন— কেবল অভূতপূর্ব নয়, স্বাধীন ভারতে যা অচিন্তনীয় বলা যেতে পারে। বিরোধীদের যত্রতত্র শাসানি দিয়েছে নির্বাচন কমিশন, কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর বিষয়ে, এবং অমিত শাহ, যোগী আদিত্যনাথ, হিমন্তবিশ্ব শর্মার মতো তারকা বিজেপি নেতার বিদ্বেষপ্রচারের বিষয়ে কমিশন থেকেছে পুরো নীরব ও নিষ্ক্রিয়। এ সব কিছু মিলিয়ে শাসক আর বিরোধীর মধ্যে যুদ্ধটা ছিল নেহাতই অসম। তবুও বিরোধীদের পাশে থেকেছেন জনগণ, চুপচাপ।
লক্ষণীয় বিরোধী জোটের ভূমিকাও। বিজেপির পক্ষে ভোটের হার প্রায় একই থাকলেও বিরোধী জোটের সংহতি থাকার কারণে উল্টো দিকের ভোটে সেই সংহতির ছাপ পড়েছে। আলাদা ভাবে দলগুলো যা পেয়েছিল ২০১৯-এর ভোটে, এ বার একত্র হয়ে তার থেকে বেড়েছে প্রায় ৭ শতাংশ। পঞ্জাব, কেরল, বাংলা বাদ দিলে প্রায় সব রাজ্যে লড়াই হয়েছে একের বিরুদ্ধে এক, আর সেখানেই ঘটে গেছে মূল তফাতটা। এই যে অত্যন্ত প্রতিকূল পরিস্থিতিতে, তীব্র আক্রমণ আর আগ্রাসনের সামনে নিজেরা যথাসাধ্য এক ছাতার তলায় থেকে লড়াই করে আসন জিতে নেওয়া, এখানেই ২৩৩টি বিরোধী আসনের গুরুত্ব আসলে শাসকের ‘৪০০ পার’-এর শামিল। জোটের ভোট ভারতে কম হয়নি, যদিও এ বারের আগে নির্বাচন-পূর্ব জোট হয়েছে মাত্র দুই বার, ১৯৯৯ সালে আর ২০০৯ সালে। বুঝতে অসুবিধা হয় না, জোটের সংহতি বা রসায়ন ক্রমশই কঠিন হয়ে উঠেছে এ দেশের রাজনীতির চলনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে, সুতরাং এ বারের কাজটা ছিল আগের চেয়ে অনেক বেশি কঠিন। সেই দিক দিয়ে দেখলে জোটকে একটা শাবাশ দিতেই হয়, নিজের নিজের মাটিতে কৃতিত্ব দেখানোর জন্য।
আর এর থেকেই বোঝা যায় এ বারের নির্বাচনের সবচেয়ে বড় ঐতিহাসিক গুরুত্ব: আঞ্চলিক রাজনীতির প্রবল এই ফিরে আসা। ‘ভারত’ নামক দেশটার যদি কোনও ‘সনাতন’ রূপ থাকে— তবে তা এই বহুমাত্রিক আঞ্চলিকতার মধ্যেই। এমনকি যে অঞ্চলকে এক বিকৃত হিন্দুত্ব-র চারণভূমি হিসেবে দেখানো হয়, ‘গোবলয়’ বলে হেয় করা হয়, সেখানে মানুষ বুঝিয়ে দিয়েছেন যে, তাঁদের ও-ভাবে তাচ্ছিল্য করা তো যাবেই না, বরং তাঁরাই দিতে পারেন সবচেয়ে বড় চমক।
সুতরাং ধরে নেওয়া যেতে পারে, ভারত আবার ফিরে এল কোয়ালিশন রাজনীতির বৃত্তে, যেখানে দর কষাকষি আর দাবিদাওয়ার টানাপড়েনে জেরবার হবে ভারতের গণতন্ত্র। আশা করা যাক, সামনের দিনগুলিতে প্রতিটি নীতি নিয়ে আলোচনা হওয়ার সময়ে সমবেত আতশকাচের নীচে সেগুলি কাটাছেঁড়া হবে। কথায় কথায় ইডি বা সিবিআই-এর জুজু দেখিয়ে দল ভাঙানোর প্রবণতায় একটু রাশ পড়বে— কেনাবেচার বাজার বাড়লেও। স্পিকারের দায়িত্বে একটু নিরপেক্ষতা আসবে। সরকারের সমালোচনা করলেই তাকে দেশদ্রোহিতা বলা হবে না। আর— সরকারের কর্মসূচি বা প্রকল্পকে কোনও ব্যক্তির একক প্রকল্প হিসেবে প্রচারে একটু হলেও বাধা পড়বে। কোয়ালিশন সরকারের চলনটাই হল সমবেত সিদ্ধান্তের মধ্য দিয়ে, তাই সিদ্ধান্ত নিতে সময় লাগবে, অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনার বাধ্যতা বেশি হবে। এ সব মিলে নিশ্চয়ই কঠিন হবে যাত্রাপথ, কাজের গতি কমবে, সংসদের এক অধিবেশনে এক ধাক্কায় গোটা পঁচিশেক বিল পাশ হবে না। কিন্তু গণতন্ত্রে কি এমন কঠিন যাত্রাই হওয়ার কথা নয়? বিশেষত ভারতের মতো বহুসমাজ-অধ্যুষিত প্রজাতন্ত্রে? কোয়ালিশন সরকারের শাসনে দেশের আর্থিক বৃদ্ধির হার কম থেকেছে, এমন কোনও প্রমাণ কিন্তু দেখানো মুশকিল, সে মনমোহন সিংহের দশ বছরই হোক আর বাজপেয়ীর পাঁচ বছরই হোক। দেশের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়া যে আর্থিক উদারীকরণ সংস্কার হয়েছিল ১৯৯১ সালে, তখন কেবল কোয়ালিশন সরকার ছিল না, সেই সরকার ছিল সংখ্যালঘু। ওটুকুই হোক। অন্তত এটুকু আশা থাকুক যে নোটবন্দির মতো তুঘলকি হঠকারিতার থেকে রেহাই মিলবে।
আসলে, আমাদের মেনে নিতেই হবে যে, ভারত দেশটাই একটা কোয়ালিশন। যাকে অন্য ভাষায় বলা যায়, ফেডারেশন, যুক্তরাষ্ট্র। জাতি, ধর্ম, বর্ণ, ভাষা মিলিয়ে তার মধ্যে অগণিত বৈচিত্র, বিভিন্নতা, এমনকি বিরোধিতা। ‘আইডেন্টিটি’ রাজনীতির উত্থানের পর এখন আর তা সম্ভব নয়, বাঞ্ছনীয়ও নয়। গত দশ বছর ভয় দেখিয়ে তা সম্ভব করার চেষ্টা হয়েছে। আশা করা যায়, এই নির্বাচন থেকে আবার সেই জোটের সুর ফিরে আসতে চলেছে। আশা করা যায়, সেই সুর প্রধান শাসক দল মান্য করে চলার চেষ্টা করবে। আশ্চর্য নয় যে শুক্রবারের বক্তৃতাতে দশ বছর পর প্রথম বার নরেন্দ্র মোদীর মুখে ‘সহমত’-এর প্রয়োজন ও গুরুত্ব ধ্বনিত হয়ে উঠল। দেশে নাকি অনেক বৈচিত্র, তিনি বললেন! এক দেশ, এক ভাষা, এক ধর্ম, এক ভোট, একটানা এই হুমকি-সুলভ রাজনীতি থেকে বেরিয়ে আসা গেল— অন্তত এই মুহূর্তে আশা করা যাক।
আশা করা যাক, মনুষ্যত্ব পেরিয়ে দেবত্ব-উদ্ভাসিত কোনও সর্বময় নায়ককে আর দেখা যাবে না। তৃতীয় বার প্রধানমন্ত্রী হয়েও ‘বিশ্বগুরু’ ভোটের ফল বেরোতেই ‘বিশ্ববন্ধু’-তে নেমে এসেছেন। তাই, মোদী যেমন ইতিহাস তৈরি করছেন, ইতিহাসও হয়তো তৈরি করতে চলেছে আর এক নরেন্দ্র মোদীকে। দেশের অন্নবস্ত্র-আকাঙ্ক্ষী দারিদ্রক্লিষ্ট সমাজ যে শুধু ভোট দিয়ে এক স্বৈরাচারী শাসকের চোখে চোখ রেখে এ কাজ করতে পারলেন— এই গৌরব আজ আমাদের সকলকে সম্মানিত করছে।