তবে কি গ্রাম দিয়ে শহর ঘিরল তৃণমূল? ৪ জুন সূর্য পশ্চিমে গড়াতে গড়াতে এই প্রশ্নটাই নতুন করে উঠে এল বাংলার রাজনৈতিক মহলে। যেখানে পরের পর দুর্নীতির অভিযোগ, নেতা-মন্ত্রীর হাজতবাস, ইডি-সিবিআই হানা, সেখানে ২০২৪-এর বড় পরীক্ষায় কী ভাবে এত ভাল ফল করল তারা? যে প্রশ্নের জবাব খুঁজতে গিয়ে সেই গ্রামের দিকেই নজর চলে যাচ্ছে রাজনৈতিক মহলের।
গ্রাম দিয়ে শহর ঘেরো।
এই নীতিতে ভর করেই বামপন্থীরা একদা রাজ্যে ক্ষমতা দখল করেছিলেন। ঠিক যেন সেই স্লোগানেই ভরসা রেখে গত দু’বছর ধরে ঘর গুছিয়েছে তৃণমূল। মঙ্গলবার যার ফসল তুলল তারা। শহুরে মধ্যবিত্তের মধ্যে গত দু’বছর ধরে এসএসসি দুর্নীতি, রাজ্যে কর্মসংস্থানের সুযোগের অভাব ইত্যাদি নানা কারণে ক্ষোভ তৈরি হয়েছিল। এই নিয়ে বিজেপি এবং অন্য বিরোধীরা লাগাতার প্রচার চালিয়েছে। স্বাভাবিক ভাবে, এর কিছুটা প্রভাব শহুরে মধ্যবিত্তের মধ্যে পড়বেই। ভোটবাক্সেও তার ছাপ পড়াটা অসম্ভব নয়। হয়তো ভোটের পুরো ফল এলে সমাজের বিভিন্ন স্তর ধরে আলোচনা করলে সে সব আরও স্পষ্ট হবে।
ঠিক এখানে এসেই যেন পার্থক্য গড়ে দিল গ্রামবাংলা। কোচবিহার থেকে কাকদ্বীপ, গ্রামাঞ্চলই তৃণমূলকে এনে দিল বড় সাফল্য। এমনকি, যে চা বাগান এলাকা গত কয়েক বছর ঘাসফুলকে বিশেষ পাত্তা দেয়নি, সে সব এলাকাতেও এ বারে ‘কাঁটে কা টক্কর’। মালবাজার ও নাগরাকাটায় তৃণমূলের দিকেই পাল্লা ভারী ছিল। প্রায় একই চিত্র জঙ্গলমহলে। ঝাড়গ্রাম শহরের কথাই ধরা যাক। পুরসভার ১৪টির মধ্যে ১১টি ওয়র্ডে এগিয়েছিল বিজেপি। কিন্তু গণনা গ্রামে ঢুকতেই তারা ধরাশায়ী।
প্রশ্ন হল, গত দু’বছর ধরে গ্রামে কী এমন কাজ করল যে, রাজ্য জুড়েই সেখানে এমন পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে মানুষের মধ্যে? যার জেরে উত্তরবঙ্গের কোচবিহারের মতো শক্তিশালী গড়েও হারতে হচ্ছে বিজেপিকে? সুকান্ত মজুমদারের মতো শীর্ষস্থানীয় রাজ্য নেতার জিততে কালঘাম ছুটছে?
এর সবচেয়ে সহজ জবাব নিশ্চয়ই লক্ষ্মীর ভান্ডার। দু’বছর আগে, বিধানসভা ভোটের পর পর এই প্রকল্পটি চালু করে রাজ্যের শাসক দল। মনে রাখা দরকার, ২০২১ সালে সেই সময়ে কোভিডের ধাক্কায় নড়ে গিয়েছিল গোটা দেশের অর্থনীতির ভিত। অসংগঠিত ক্ষেত্রে ধাক্কা লেগেছিল সবচেয়ে বেশি। পরিযায়ী শ্রমিকদের অনেকে চাকরি খুইয়ে ফিরে এসেছিলেন ঘরে। সেই সময়ে লক্ষ্মীর ভান্ডার চালু করে রাজ্য সরকার— সরাসরি বাড়ির মহিলাদের হাতে টাকা দেওয়া শুরু হয়। এ বারে লোকসভা ভোটের ঠিক আগে সেই অর্থ বাড়িয়ে দেওয়া হয়। রাজ্যে মহিলা ভোটার মোট ভোটারের প্রায় অর্ধেক। এই প্রকল্প যে সেই অর্ধেক আকাশকে প্রভাবিত করেছে, তা ফলেই স্পষ্ট।
কিন্তু শুধু এই একটি প্রকল্পকে সবটুকু গুরুত্ব দিলে মনে হয় কিছুটা কমই বলা হবে। এর সঙ্গে রয়েছে প্রতিশ্রুতি দিয়ে তা রাখার উদাহরণ। এবং সেটাও বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই গ্রামের সঙ্গে যুক্ত। যেমন, স্বাস্থ্যসাথী কার্ড। এই কার্ডেও মূল নামটি বাড়ির মহিলার। তবে সরকারি টাকায় চিকিৎসা পাচ্ছেন পরিবারের সকলেই। সম্প্রতি গ্রামেগঞ্জে ঘুরতে ঘুরতে সরকারের একাধিক প্রকল্প নিয়ে মানুষের মনে ক্ষোভ দেখেছি। কোথাও রাস্তা পাকা হয়নি, কোথাও পানীয় জলের লাইন পৌঁছলেও তা এখনও শুকনো, কোথাও বিদ্যুতের পোল বসেছে কিন্তু বাতি লাগেনি। বার্ধক্য ভাতা নিয়ে তো ক্ষোভ বিস্তর। কিন্তু দু’টি বিষয়ে প্রায় একশো শতাংশ কাজ করেছে সরকার— লক্ষ্মীর ভান্ডার এবং স্বাস্থ্যসাথী। শহরের মানুষ স্বাস্থ্যসাথী থেকে কতটা উপকৃত, তা সমীক্ষার পরেই বলা সম্ভব। কিন্তু গ্রামে ঘুরলেই উপকৃতরা নজরে পড়বেন।
বিজেপির বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় ক্ষোভ সম্ভবত এই গ্রামেরই বিভিন্ন প্রকল্পের টাকা আটকে দেওয়া। যে তালিকার প্রথমেই রয়েছে একশো দিনের কাজ। তার পরে আবাস যোজনা। একশো দিনের কাজ গ্রামের অর্থনীতির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি। এমনকি, মহিলা কর্মিবর্গেরও একটা অংশ একশো দিনের কাজের মাধ্যমে আয় করে থাকেন। দুর্নীতির অভিযোগে সেই টাকা গত প্রায় দু’বছর ধরে আটকে রেখেছে কেন্দ্রীয় সরকার। একই ভাবে এবং একই অভিযোগে আটকে রাখা হয়েছে আবাস যোজনার টাকাও। যে মেয়েটির স্বামী ভিন রাজ্যে কাজে গিয়েছেন, একাধিক সন্তান, শ্বশুর-শাশুড়ি নিয়ে সেই মেয়ে কোনও ক্রমে মাথা গোঁজার ঠাঁইটা বাঁচিয়ে রাখতে চেয়েছিলেন। বিজেপি তাতে বাদ সাধল।
এই দুই প্রকল্প দেখতে গত দু’বছরে পরের পর কেন্দ্রীয় দল এসেছে। কিন্তু তারা ফিরে গিয়ে কী রিপোর্ট দিয়েছে, তার ভিত্তিতে কী ব্যবস্থা করা হয়েছে— সবই অন্ধকারে। গ্রামে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে: যারা দুর্নীতি করেছে, তাদের শাস্তি দেওয়ার ব্যবস্থা করে আসল উপভোক্তাদের প্রকল্পের টাকা দেওয়া হবে না কেন? আবাসের ক্ষেত্রে যেমন, তেমনই একশো দিনের কাজের ক্ষেত্রে। অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় এই দু’টি বিষয়ে আন্দোলনকে দিল্লি পর্যন্ত নিয়ে যেতে পেরেছেন। তিনি নিজে মাঠে নেমে দেখাতে চেয়েছেন, গ্রামের এই মানুষদের জন্য আন্দোলনে রয়েছে দল। তার পরে রাজ্য সরকার একশো দিনের বকেয়া টাকা ফেরত দিয়েছে গ্রামের মানুষকে। একই সঙ্গে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, এর পরে আবাসের টাকাও দেওয়া হবে। এই ‘টাকা আটকে রাখা’ বনাম ‘টাকা দেওয়ার’ লড়াইয়ে শেষ পর্যন্ত গ্রামের মানুষ বেছে নিয়েছে তৃণমূলের অবস্থানকে।
২০১৯ ও ২০২১, গত দু’টি বড় নির্বাচনের ফল দেখলেই স্পষ্ট হবে, রাজ্য জুড়ে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে শহরের ভোট বিজেপির দিকে রয়েছে। কলকাতা, বিধাননগর বা হাওড়া ব্যতিক্রম। সেই সম্ভাবনা এ বারেও পুরোদস্তুর ছিল। তাই তৃণমূল মন দিয়েছিল গ্রামে। পুরনো বামেদের রাজনৈতিক পথ ধরে।
৪ জুন দিনের শেষে দেখা যাচ্ছে, সেই কৌশলে তারা সফল।