হাটখোলার দত্ত পরিবারের দুর্গাপুজো
উত্তর কলকাতার নিমতলা স্ট্রিটে জগৎরাম দত্ত শুরু করলেন পরিবারের সকলকে নিয়ে দুর্গাপুজো। যদিও, দত্ত পরিবারে বহু আগে থেকেই দুর্গাপুজোর প্রচলন ছিল। এই দত্ত বংশের সূচনা কান্যকুব্জ (বর্তমানে কনৌজ) হলেও পরবর্তীকালে তাঁদের একটি শাখা হাওড়ার আন্দুল থেকে কলকাতায় চলে আসেন। কথিত আছে, তৎকালীন সময়ে সুতানুটি, কলকাতার সঙ্গে যে গোবিন্দপুরের নাম উচ্চারিত হত, এই জগৎরাম দত্তের পূর্বপুরুষ গোবিন্দশরণ দত্তর নামেই এই গোবিন্দপুরের উৎপত্তি। সেই প্রাচীন রীতি অক্ষুণ্ণ রেখে আজও দুর্গাপুজো অনুষ্ঠিত হয় পরিবারের বর্তমান প্রজন্মের হাত ধরে।
৯৮০ খ্রীস্টাব্দে বঙ্গাধিপতি আদিশূর কনৌজ থেকে পাঁচ বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণের পাশাপাশি পাঁচজন উচ্চবর্ণের কায়স্থদেরও বাংলায় এনেছিলেন। তাঁরা হলেন কালিদাস, দশরথ, মকরন্দ, বিরাট এবং পুরুষোত্তম। আর এই পুরুষত্তম দত্তই হলেন কায়স্থ কুলের অন্যতম তথা বঙ্গদেশে এই বংশের প্রথম পুরুষ।
গোবিন্দশরণের উত্তরপুরুষ জগৎরাম দত্ত হাটখোলার প্রসাদে দুর্গাদালান নির্মাণে সময় সমস্ত তীর্থের মাটি দিয়ে সেটি নির্মাণের ইচ্ছা প্রকাশ করলেন। সেই মতন দ্বারকা, পুরী, কাশী, হরিদ্বার থেকে নৌকা করে তীর্থের মাটি আসতে লাগল গঙ্গার ঘাটে। আর সেই মাটি দিয়েই তৈরি হল দত্তদের ঠাকুরদালান। কালের নিয়মে সেই ঠাকুরদালান ও সেই উঠোনটি আজও আছে হাটখোলার দত্ত বাড়িতে।
বর্তমান যুগে অন্যান্য ঠাকুরবাড়ি সুতানুটি পরিষদের পরিচালনার তালিকায় এসে গেলেও বা হেরিটেজ ঘোষণা হয় গেলেও, হাটখোলা দত্তবাড়ি এখনও নিজ চেষ্টায় পুজো চালিয়ে যাচ্ছে।
১৭৯৪ থেকেই এই দত্ত বাড়িতে দুর্গাপুজো হয়ে আসছে, যে ধারা আজও অব্যাহত। দত্ত বাড়িতে উল্টোরথের দিন কাঠামো পুজো হয়। আর শ্রাবণ মাসেই শুরু হয়ে যায় প্রতিমা নির্মাণের কাজ। এই বাড়ির প্রতিমার বৈশিষ্ট্য হল মঠচৌড়ি আকৃতির চালচিত্র। এমনকি ঠাকুরকে কোনও পোশাক পরানো হয় না। কারণ শিল্পীরা মাটির উপরও রং-তুলি দিয়ে দেবীর পোশাক আঁকেন। এতদিন এই পরিবারে পুজো উৎসর্গ হত কুলগুরুর নামে। বাড়ির কোনও সদস্যের নামে পুজো হত না। কুলগুরুই পুজো পরিচালনা করতেন। তাছাড়া এঁরা ব্রাহ্মণ না হওয়ায় পুজোর কোন কাজই করতে পারতেন না। তবে এখন অবশ্য সেই নিয়ম নেই। বাড়ির সদস্যের নামেই পুজো উৎসর্গ হয়। আগে বোধনের সময় থেকে পুজো পর্যন্ত বারো জন স্মৃতিতীর্থ পণ্ডিত দুর্গা নাম এবং চণ্ডী নাম জপ করতেন। এখন পণ্ডিতের সংখ্যা অনেক কমে গিয়েছে এই বাড়িতে।
ষষ্ঠীর দিন বেল বরণের মাধ্যমে ঠাকুরকে আবাহন করা হয়। অর্থাৎ বেল গাছের নীচে পরিবারের কুল দেবতা শাল গ্রামকে নিয়ে আসা হয়। দত্ত বাড়িতে তিন কুল দেবতা আছেন বেলবরণ এবং রথ এর সময় কুল দেবতা নীচে নামেন। পুজোর সময় তিনি ঠাকুর দালানে উপস্থিত থাকেন না। এবং কেবলমাত্র মহানবমী ছাড়া পুজোর বাকি দিনগুলিতে অঞ্জলি দেন না বাড়ির সদস্যরা। অষ্টমীর অঞ্জলিও দিতে পারেন না তাঁরা। নবমীতে দক্ষিণান্ত হয়ে যাওয়ার পরই অঞ্জলি দেন পরিবারের সকলে। এছারা সন্ধি পুজোতে ক্ষীরের পুতুল বলি দেওয়া হয় হাটখোলার দত্ত বাড়িতে। যদিও বাড়ির লোকেদের বলি দেখার কোন অধিকার নেই। তাই বলির স্থান কাপড় দিয়ে ঘিরে তবেই বলি দেওয়া হয়। অতীতে এই বাড়িতে সিদুঁর খেলার নিয়ম ছিল না। অষ্টমীর দিন সন্ধিপুজোর পর মায়ের সিঁদুর নিয়ে সধবা মহিলারা একে অপরকে পরিয়ে দেন।
অতীতে দুর্গাপুজো শুরুর আগে থেকেই বিশাল আকৃতির উনুন জ্বালিয়ে সারা দিন ধরে তৈরি হত মিষ্টি আর নোনতা। মায়ের এই খাবার তৈরি হয় গাওয়া ঘী দিয়ে। এখন পরিবারের সদস্য অনেকই কম, তাই চতুর্থীর দিন ভিয়েন বসে। জিলিপি, নিমকি, খাজা, গজা, বালুশই, দরবেশের মতন প্রচলিত মিষ্টির সঙ্গে তৈরি হয় লালমোহন, মুটরি, নারকেলের পুর দেওয়া পেরাকি, পোলাও নামে অনেকটা দরবেশের মতো দেখতে সাদা রংয়ের এক রকম মিষ্টি, গোলমরিচ দেওয়া মতিচূড়।
তৎকালীন সময়ে দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের ‘বঙ্গ আমার জননী আমার ধাত্রী আমার আমার দেশ’ গানটি এতটাই জনপ্রিয়তা লাভ করে যে গানটি রচনার পরের বছর থেকেই দশমীর দিনে ঠাকুর বিসর্জনের পর উর্ধ কণ্ঠে গানটি গাইতে গাইতে গঙ্গার ঘাট থেকে ফিরতেন দত্ত বাড়ির সদস্যরা, সেই প্রথা আজও চলছে এই পরিবারে। আগে বিসর্জনের সময় নীলকন্ঠ পাখি ওড়ানো হত গঙ্গার ঘাট থেকে। কথিত ছিল নীলকন্ঠ পাখি কৈলাশ এ গিয়ে মহাদেব কে বার্তা দেবেন যে মা বাড়িতে ফিরছেন, বর্তমান যুগে সরকার থেকে নীলকন্ঠ পাখি রাখা দণ্ডনীয় অপরাধ বলে এই প্রথা উঠে গেছে। রমেশচন্দ্র দত্ত, তরু দত্ত –সহ নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর মা প্রভাবতী বসুর মতো বহু কৃতী মানুষ এই পরিবারের সদস্য ছিলেন। এমনকি যখন বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন গোটা বাংলায় তীব্র হয়ে উঠতে তখন এই বাড়ির সদস্যরাও অরন্ধন পালন করে একে অপরকে রাখি পরিয়ে দেন। এই ভাবে ঐতিহ্যের সঙ্গে প্রাচীন রীতিনীতিকে অক্ষুণ্ণ রেখে আজও পুজো হয়ে আসছে হাটখোলার দত্ত পরিবারে।
এই প্রতিবেদনটি 'আনন্দ উৎসব' ফিচারের একটি অংশ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy