এককালে আমাদের বিজয়া ছিল আজানুলম্বিত। দশমীতে অসুর, সিংহ সবাইকে সন্দেশ খাইয়ে, সিঁদুর মাখিয়ে জলে ফেলা হল কি হল না, আমাদের পেন্নাম আর আর কোলাকুলির ঘটা লেগে যেত। সে থামত গিয়ে কালীপুজোয় আবার একটা মস্ত খ্যাটনের সুলুক পেলে। ভাঁইফোটা অবধি আমাদের ওঠাপড়া ছিল সাইন কার্ভের মতো সহজ সরল বঙ্গজীবনের অঙ্গ। এই ওঠাপড়া সহজে গায়ে লাগত না। মানে চর্বিটর্বি। ফলে যে পরিমাণ ব্যায়ামাদি বিজয়ার দাক্ষিণ্যে ফিক্সড ডিপোজিট করা ছিল, তাতে বাকি জীবনটা ‘রেখেচ বাঙালি করে’ হয়ে খেয়েদেয়ে কাটিয়ে দেওয়া যায়। এর মধ্যেই কবে লক্ষ্মী ঠাকরুণ এসে পড়তেন দুর্গার আধখোলা প্যান্ডেলের মধ্যে, তার খোঁজ ‘জবাব চাই জবাব দাও, আমাদের দাবি মানতে হবে’ করতে করতে কখনও রাখা হয়নি। মা রাখত। তোরঙ্গ থেকে বার হত কাঁসা-পিতলের সংসার। গামলা, হাঁড়ি, থালা, বালতি থেকে মায় খুন্তি পর্যন্ত। চ্যাপ্টা থালার মতো রেকাবি ছিল প্রচণ্ড ভারী। প্যাংলা চেহারায় সে সব তোলার চেষ্টা করে দেখিনি, বিপ্লব এসে গেছে ধরে ‘ঘর হতে দুই পা ফেলিয়া’ বাইরে ড্যাংড্যাং করে বেড়িয়েছি। সেগুলো মাজা হবে মজানো তেঁতুলে, ঘাস দিয়ে। ছোবড়া বা ছাই তাদের টাচ অবধি করবে না সপ্তপদীর মতো। দিন দুই মাজলে সেগুলো ঝকঝক করত, ছাদের উপরে উদারহস্ত চাঁদও স্কোর দিত একটু একটু করে আলো বাড়িয়ে।
এই ঘষামাজা ও ফর্দ-বাজার-দশকর্ম ইত্যাদি পর্বে সে সময়টা ব্যস্ত থাকতাম ছিপের তদারকিতে ও বসার উপযুক্ত পুকুরের খোঁজে। এই দিন থেকে শুরু হত মাছ ধরার শীতকালীন অধিবেশন। হিমেল দিনে পিঠে রোদ্দুর নিয়ে ফাৎনার দিকে চেয়ে চেয়ে টের পেতাম এই বাড়ি, সেই বাড়ির পুজো সারা হচ্ছে। প্রসাদের প্রতি কোনও লোভ ছিল না, মাছের প্রতিও। ধরা মাছ বিলিয়ে দিয়ে সন্ধেবেলা বাড়ি ফিরে পরিবেশন করতে হত। মাছ বাড়িতে আনা যেত না। কাদের বাড়ি পুজো হচ্ছে না, সেই খোঁজ সব সময়েই রাখতে হত। বাড়ি ফিরে ঠান্ডা জলে স্নান করে মনে মনে ঘোষণা করতে হয়, এ বছর আর গা ধোয়া বন্ধ, এসেছে খবর স্নান স্কিপ করার সময় হয়েছে শুরু। বাড়ির পিছনের গাছ থেকে কলা পাতা সকালেই কেটে চিরে রেডি করে রাখা। রান্নাঘরে খিচুড়ি পায়েস সব বালতিতে। ভাজাভুজি আলাদা থালায়, তার পরিমাণ কম। সবাইকে দেওয়াও হত না। তবে এত রকম পদের ভাজাভুজি করা হত যে, সারা রান্নাঘরে অসংখ্য থালায় তারা ছড়িয়ে থাকত। এই ভাজায় বাদাম ছড়ানো শাকভাজা, আলুভাজা, বেগুন, পটল, কুমড়ো, মুলো, কাঁকরোল, কাঁচকলা থেকে কচুভাজা অনেক কিছুই থাকত তবে তেতোর কোন পদ থাকত না। খিচুড়ির সঙ্গে মূলত দেওয়া হত কুমড়োর তরকারি বা আলুর দম, খেজুর-আমসত্ত্ব দেওয়া টোম্যাটোর চাটনি, সকলে চেটেপুটে খেত, সেখানে কার্পণ্য করা হত না। কাজেই অনেক সময়ে খিচুড়ি বা তরকারি কমে এলে আবার চুলা জ্বালাতে হত। গ্যাসের চুলার শাসনকালের আগে ঘুঁটে, গুল সাজিয়ে উনুন ধরানোর শিক্ষানবীশ কাল চলত আমার। সে সব স্মৃতি এতই ধোঁয়ায় ঢাকা যে, লিখতে গেলেও কাশি আসে। বাড়ির সামনে সাইকেল আর চপ্পল এ ওর ঘাড়ে উঠে সোহাগ করলে বিশ্রী চেঁচামেচিতে সারা পাড়া মুখর হয়ে উঠত। কারা আসতেন খেতে, তাদের সঙ্গে কুশল বিনিময় ছিল গৃহকর্তার কাজ। তিনি সকলকে না চিনতে পারলেও চেনার আপ্রাণ চেষ্ঠা করতেন। অতিথিরাও খাওয়ার মাঝে মাঝে যথাসাধ্য বংশলতিকা বলে টলে তাঁকে সন্তুষ্ট করে দিত। অন্দরমহলের তাণ্ডব তাঁর কাছ অবধি এসে পৌঁছত না।
আরও পড়ুন: সনাতনী আহারেই বাহার, মেটে মটরশুঁটি মরিচ বানান এ ভাবে
শীতের শেষের খিচুড়িতে ফুলকপি, সিম ও মটরশুঁটি যোগ ছিল অনিবার্য
উদ্বাস্তু হয়ে এই দেশে ঠাঁইগাড়া কতিপয় মানুষদের এই আয়োজনে পুজোটাকে চিরকাল উপলক্ষ বলেই মনে হয়েছে। শুদ্ধ, পবিত্রতা, পাপ-পূণ্যের মতো অলীক শব্দবন্ধের সীমানা ছাড়িয়ে অপরিচিত, অনাত্মীয়, অনাহুত মানুষের ঢল অন্য কোনও দিনে আসত না। এই নিয়ে লক্ষ্মী-সরস্বতীর কোনও বিবাদ আছে কি না জানি না। কিন্তু সরস্বতী পুজোর ভোগ রান্নার আয়োজন ছিল এর দশ ভাগেরও কম। মেনুও ছিল কাছাকাছি। শীতের শেষের খিচুড়িতে ফুলকপি, সিম ও মটরশুঁটি যোগ ছিল অনিবার্য। আমার মতে লক্ষ্মীপুজোর খিচুড়ি ছিল কিছুটা পিছড়ে বর্গ। আতপ চাল বলতে গোবিন্দভোগ আর ডাল বলতে মুগ। ভোগের খিচুড়িতে এই ভিন্ন পড়ত আলু, কাঁচালঙ্কা, তেজপাতা। হলুদ-লবণ থাকত প্রয়োজন মতো। মা দিতেন আলাদা করে শুকনো লঙ্কা–জিরার ফোড়ন অনেকটা ঘিতে আলাদা করে ভেজে। হ্যাঁ, আদা কুচিও। পেঁয়াজকে আমিষ ধরে তাকে বাদ রাখা হত এই দিন। স্পেশাল বলতে দুটো জিনিস হত— আতপ চালের থেকে ডালের পরিমাণ থাকবে বেশি। আর ঘি হবে মায়ের হাতের বানানো। জমানো সর থেকে ঘি বানানো হত বিজয়ার নাড়ু, তক্তি বানানোর মধ্যেই কোনও এক গভীর রাত্রে। সেই ঘি পরে আমাদের রোজকার খাওয়ার জন্য বেঁচে না থাকলেও তার গন্ধ ঘরে ঘুরে বেড়াত বেশ কিছু দিন। মা সম্ভবত রাত্রে কিছু খেত না। আমিও খেতাম না। এখনও বাল্যস্মৃতি ভাসে, পাতাটাতা ফেলে ঘর পরিষ্কার করে স্নান সেরে এসে হাওয়াইয়ান গিটারটা নিয়ে তাসের দেশের কোনও গান বাজাচ্ছে মা। বাইরে ঝকঝক করছে চাঁদের আলো।
আরও পড়ুন: নিউটাউনের এই আস্তানায় নিভৃতে কোরিয়ান ফ্রায়েড চিকেন
সেই সব দিন নেই। খাওয়ানোর লোক যেমন নেই, খাওয়ার লোকও কোথায় হারিয়ে গেছে। গিটারটাতে উই ধরে যাওয়ায় এঁটো কলাপাতার মতো বাইরে ফেলে এলাম এক দিন। মাও অনেক বছর নেই। আমাদের সারা বাড়িতে এখন উইয়ের আল্পনা। এই শহরে তেমন পুকুর নেই এখন। আমাদের আর মাছধরাও নেই। লক্ষ্মীপুজোও নেই। সে চুপিচুপি আসে যায়। শুধু চাঁদটাই বোকার মতো ফোকলা দাঁতের ফাঁক দিয়ে আলো ছড়ায়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy