শুভজিৎ ভট্টাচার্য
সে ছিল বড় আনন্দময় এক সময়। সে সময়ে ভোরের দিকে শিশির পড়তে আরম্ভ করত। আগের রাত্রে শুতে যেতে হত অন্য দিনের থেকে আগে। পরদিন ওঠা ভোরের আলো ভালো করে ফোটার কিছু আগে। মুখ-হাত ধুয়ে, চাদর জড়িয়ে গরম চা হাতে নিতে না নিতেই সব বাড়িতে একসঙ্গে বেজে উঠত সেই চেনা সুর। সেই মন কেমনের সুর, যা বছরের আর কোনও দিন শোনা যেত না।
একই সুর, একই কথা, একই কন্ঠ। তবু বছরের পর বছর এমন ভাবে মায়া ছড়ায় কী ভাবে কে জানে! শেষের দিকে শ্রী শ্রী চণ্ডীপাঠের সময়ে যখন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের গলায় জানতে পারতাম যে ক্ষুধা, তৃষ্ণা, লজ্জা, বিদ্যা, শক্তি, ভক্তি- মানবজীবনের যা কিছু, সব জুড়েই আছেন সে মহামায়া, আর যখন তিনি জাগরিত করতে চাইতেন সে অপার শক্তিকে- যখন “জাগো, মা, জাগো…” বলতে বলতে তাঁর কন্ঠ আসতো রুদ্ধ হয়ে কী এক অপ্রতিরোধ্য আবেগে, তখন নিজের অজান্তেই কখন যেন জলে ভরে উঠত চোখ প্রতি বার। শিশিরপাতের ভোর হয়ে উঠত অশ্রুপাতের।
অশ্রুপাতেরই তো বটে। মহালয়া যে স্মরণের দিন, শ্রদ্ধার দিন, তর্পণের দিন। পিতৃপক্ষের শেষে দেবীপক্ষের শুরুর এ দিনেই তো আবারও সবাই ফিরে যাই তাঁদের কাছে, যাঁদের হারিয়েছি জীবনের পথে চিরকালের জন্য। তাঁদের জন্য গিয়ে দাঁড়াই পুণ্যতোয়া গঙ্গার তীরে। সে জল তুলি করপুটে। বলি- আমার এ জলে তৃষ্ণা মিটুক আমার আপনজনের, আত্মীয় পরিজনের, বন্ধুবান্ধবের। যাদের চিনি না, চিনিনি কোনও দিনও, তাদেরও তৃষ্ণা মিটুক এ জলে। যারা সহায় সম্বলহীন, আত্মীয় পরিজনহীন, নির্বান্ধব ও একাকী, তাদের জন্যও রইল এ তৃষ্ণার জল। মহালয়া তাই তো স্মৃতিময়, তাই তো স্মরণের।
সে স্মৃতির হাত ধরে আজ ফিরি আমার দিদার কাছে। যাঁদের হাতের রান্না খেয়ে বড় হয়েছি, তাঁদের সকলের মধ্যে সবচেয়ে আগে মনে আসে দিদার কথা। সে রান্না যে এক বার খেয়েছে, সে ভুলতে পারবে না। মনে পড়ে, খর গ্রীষ্মে যখন আমের বোলে ঢাকত গাছগুলি, নির্জন শহরের রাস্তায় ডেকে যেত ফেরিওয়ালা, সে ডাক প্রতিধ্বনিত হত পর্দাঢাকা ছায়া ছায়া বাড়িগুলির দেয়ালে দেয়ালে, তখন সদ্য মোছা জলে ভেজা মেঝেতে কাঁসার থালায় বাড়া হত ভাত। তার পর আদরে যত্নে দিদা পরিবেশন করত গ্রীষ্মের বিশেষ পদটি- কাঁচা আম দিয়ে মাছ। তেলে পড়ত কালো জিরে-কাঁচা লঙ্কা ফোড়ন, আর তার পর কাঁচা আম দিয়ে কষিয়ে নুন-হলুদ মাখা ভাজা মাছ দিয়ে, সর্ষে-নুন-হলুদ দিয়ে ফুটিয়ে কাঁচা তেল ছড়িয়ে নামানো। সোনালি তেলভাসা মাখা মাখা, তার ঝোল গড়িয়ে আসত থালায়। সে তো কেবলমাত্র আর একটি রান্না নয়, সে যে বহুযুগের ওপার হতে ভেসে আসা এক ভালবাসার গল্প…। অথবা ডালটা? মুলো, লেবুপাতা আর গন্ধরাজ লেবু দিয়ে করা দিদার হাতের ফাটা ফাটা ডাল? কেবল কালোজিরে দেওয়া সে ডালের নাম এমন, কারণ সে রান্নায় মটর ডাল ফেটে যাবে, কিন্তু গলে যাবে না- এমনই হতে হবে সে রান্নায় সময়ের আন্দাজ। খাবার সময়ে পাতে রাখতে হবে কাঁচা লঙ্কা।
এ গল্প শেষ হবে না, যদি না বলি দিদার হাতের আরও দু’তিনটি রান্নার কথা। কত বার মায়ের মুখে শুনেছি, বেনারসের বাড়িতে মায়েরা সব ভাইবোন সারি দিয়ে খেতে বসত ঢালা বারান্দায়। দুপুরে দিদা কোনও দিন করত মাছের তরতরা। তার জন্য মাছে নুন-হলুদ মেখে ভেজে তুলে রাখতে হত আগে। তার পরে একটু বেশি তেলে শুধু নুন-হলুদ, কাঁচা লঙ্কা আর লঙ্কা গুঁড়ো দিয়ে কষিয়ে নিতে হবে বেশ অনেকটা পেঁয়াজ কুচি। যখন তেল ছাড়বে, তখন সাবধানে দিতে হবে মাছগুলি। অল্প জলের ছিটে দিয়ে সাবধানে মাছে পেঁয়াজ মিশিয়ে আঁচ কমিয়ে ঢাকা দিয়ে রাখতে হবে মিনিট পাঁচেক। তার পর পাতে পড়ত লাল টকটকে তেল গড়ানো মাছের তরতরা। গরম ভাতে যেন অমৃত! তা ছাড়া ডালের বড়া দিয়ে ঝিঙের ঝোল, পাঁপড়ের ডালনা বা বিশেষ দিনে মাংসের খিচুড়ির কথা তো শুনেছি কতই। আর শেষ পাতে দিদার হাতের তেঁতুলের ক্বাথ ও চিনি দিয়ে সর্ষে ফোড়ন দিয়ে মটর ডালের বড়ার টকের জুড়ি কই?
কতই তো এমন গল্প থাকে সবার বাড়ির। সবার জীবনের। সমুদ্রের যেমন ঢেউ, তেমনই হঠাৎ তারা জেগে ওঠে বুকের ভিতরে। মন কেমনের সময় আসে। তার পর বহু ব্যস্ততার মাঝে আবার কখন যেন মিলিয়ে যায়। বছর ঘুরে আবারও আসে মহালয়া। জলদানের তিথি। মনে ভেসে ওঠে সে সব মানুষের কথা। মনে হয়, কেবল জলে নয়, আমার মহালয়া পালিত হোক এ সব গল্পের মাধ্যমে, স্মৃতির নিবেদনে, ভালোবাসার কথনে। যারা সহায় বান্ধবহীন, তাদের জন্যও রাখা থাক ভালোবাসার আশ্বাস, বিশ্বাসের অভয়বাণী। বলি- “আছে, আছে। এ পৃথিবীতে স্নেহ আছে, মায়া আছে, বুকে ভালবাসা নিয়ে অপেক্ষা করার মানুষ আছে।” উদযাপিত হোক আমার তর্পণতিথি।
এই প্রতিবেদনটি 'আনন্দ উৎসব' ফিচারের একটি অংশ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy