Advertisement
E-Paper

নবমীতে রেওয়াজির রেওয়াজে বাধা কেবল দূরত্ববিধি

নবমীর লাইন কোথা থেকে কতদূর যেতে পারে, তা আমাদের হাইকোর্ট জানে না। পুজোয় যদি এক দিনই বেরোনো হয় তো হোক, সেটা মাংস কিনতে।

সুমেরু মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২২ অক্টোবর ২০২০ ১২:৪৫
Share
Save

নবমীর দিন খাসির মাংসের দোকানের সামনের লাইন গত কয়েক বছরে অনেকটাই বেড়েছে। বাঙালি হুজুগে জাতি, কোত্থেকে কবে কে নবমীতে মাংস খাওয়া শিখিয়েছিল তার হদিস না পেলেও লাইনটা সে ভালই মেন্টেন করে চলেছে। ওয়াজেদ আলির কথা তো আর মিথ্যে হতে পারে না! বন্ধ হয়ে গিয়েছে নবমীতে দেবীর সামনে বলি দিয়ে রসনাতৃপ্তির রেওয়াজ। কিন্তু মাংস এখন ট্র্যাডিশনের দোহাই। কোলেস্টরলের ওষুধ আর হার্টের অপারেশনের ব্যবসা চাগিয়ে রেখে তাই চলছে খাসি-পাঁঠার ধুন্ধুমার। কিছু না হলেও ফি বছরে দোল আর নবমী মাস্ট। লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে সুখ-দুঃখ আলোচনা। কচি পাঁঠা না রেওয়াজি খাসি- এই দিন কেউ প্রশ্ন করে না, তাঁদের পেলেই হল। খাসির মাংসের দাম যেমন চড়চড়িয়ে বেড়েছে, তেমনই বেড়েছে খাসির মাংসের চাহিদা। বয়স্ক মানুষজন এখনও কচি পাঁঠার গন্ধ আঙুলে খুঁজে বেড়ান। বর্তমান কলকাতায় তার সুলুক কম। কয়েকটি বিশেষ দোকানে ব্যবস্থা থাকে। তা-ও আগে থাকতে বলে রাখতে হয়। তবে আজকালকার ছেলে ছোকরারা সেই সব দোকানের ছায়াও মাড়ায় না। তাদের চাই পুরু রেওয়াজের পরত দেওয়া খাসির মাংস। যার বেশির ভাগটাই আসে বিহারের দ্বারভাঙ্গা জেলা থেকে, যা বাজারে বিকোয় পাটানাই খাসি বলে। লকডাউনে বাঙালির সঙ্গে সঙ্গে মাথায় হাত পড়ে গিয়েছিল দ্বারভাঙ্গা জেলার গোট ট্রেডার্সদের। কলকাতা ও তার আশপাশ অঞ্চলে দাম হয়ে গিয়েছিল প্রায় দ্বিগুণ, কিন্তু লাইন তাতেও কমেনি। দোকানের সামনে গোল গোল দাগকাটার মধ্যে মাস্ক পরে, হাতে স্যানিটাইজার ঘষতে ঘষতে অপেক্ষা চলেছে এক টুকরো আলু আর দুই টুকরো মাংসের একবাটি ঝোলের স্বপ্নে বিভোর হয়ে।

আরও পড়ুন: আমিষে মিশে যাক মিষ্টি

নবমীর লাইন কোথা থেকে কতদূর যেতে পারে, তা আমাদের হাইকোর্ট জানে না। পুজোয় যদি এক দিনই বেরোনো হয় তো হোক, সেটা মাংস কিনতে। তার জন্য জামা-জুতো, রুমাল, মাস্ক সব কেনা সারা। বেশির ভাগটাই অনলাইনে। নিউ মার্কেট-গড়িয়াহাটের পুজোর ভিড়ের ছবিতে গুছিয়ে কমেন্টও করেছেন তাঁরা। কেউ কেউ শেয়ারও করেছেন উপযুক্ত চাণক্য শ্লোক বা রবি ঠাকুরের গানের মাধুরীর সঙ্গে। নবমীর মাংস কেনার লড়াই জিতে ফিরে এলে কী রান্না হবে, সেটা নিয়ে আলোচনা, টেলিফোন, রিসার্চ চলছে মাসখানেক ধরে। কারণ, বাঙালি বাইরের থেকে বেশি ঘরেই বিপ্লব করতে ভালবাসে। এ বার বিস্তর লাইন পেরিয়ে, স্যানিটাইজারের বোতল খালি করে সে যদি মাংস কিনে আনতে পারে তবে, কিচেনে মোঘল-ব্রিটিশ যুদ্ধ একটা বেধে যাবেই। সারা বাড়ি উত্তেজনায় কাঁপছে। টেম্পারেচার হাই। জঙ্গলে আগুন লাগলে দেবালয় রক্ষা পায় না। এখানে রান্নাঘরই সে দেবালয়। সে রেডি রেসিপি গুছিয়ে। আর আছে মিথ। ফি-নবমীতে ভোর থেকে শুরু হয় খাসি জবাই। সূর্য যত মাথার উপর ওঠে, লাইন লম্বা হতে থাকে তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে। সে লাইন এতটাই লম্বা হয়, বেলা একটা-দুটো-তিনটে-চারটে বেজে যায়। তাতেও কেউ কেউ খতম হয় না।

বয়স্ক মানুষজন এখনও কচি পাঁঠার গন্ধ আঙুলে খুঁজে বেড়ান।

কলকাতা জুড়ে তিন তারা, পাঁচ তারা খাসির মাংসের দোকান কম নেই। হাজি আলি, কোহিনূর, বেঙ্গল মিট শপ- এগুলো চেন স্টোর্স না আলাদা মালিকানা, তাই নিয়েও কারও মাথাব্যথা নেই। যেমন স্টার না পেয়েও অলটাইম গ্রেট বৌবাজারের গোপাল পাঁঠার দোকান। অনুশীলন সমিতির গল্প আর ‘খাঁটি বাঙালি পাঁঠার মাংসের দোকান’-এর মিমে আপাতত আটকে গিয়েছে সে। কেউ কেউ কালের স্রোতে গরিমা হারিয়েছে। যেমন ভবানীপুরের মোজাফফর হোসেন। কেউ নাম করেই হাইভোল্টেজ, বালিগঞ্জ মিনি বাসস্ট্যান্ডে সাইনবোর্ডের কেতা ছাড়াই দুরন্ত জনপ্রিয় এক মাংসের দোকান। কসবা রেলব্রিজের কাছের দোকানটি সে তল্লাটে হিরো। কলকাতার প্রতিটা বড় বাজারের সঙ্গে দুই চারটে দোকান থাকবেই। বংশানুক্রমে তাঁদের থেকে মাংস নিলে ক্রেতারা জানেন তাদের পরিবারের খবরাখবর, তেমন তাঁরাও জানেন কে কেমন কাট, কোথাকার মাংস, কতটা চর্বি পছন্দ করেন। এই কসাইরা কেউ এসেছেন লখনউ থেকে, কেউ মোরাদাবাদ, কেউ ছাপরা থেকে। কত পুরুষ আগে। এঁদের পরিবারের কেউ এক জন হজ করে এলে দোকানের নাম হয় হাজি মিট শপ। এ ছাড়া, বেঙ্গল মিট শপ তো বারোয়ারি নাম। পাতি বেঙ্গল সবাই নয়। তাদের মধ্যেও পাতিপুকুর, মুদিয়ালি, বেকবাগানের নামের পাশে বেশ কয়েকটা তারা আছে। ফাইভ স্টারে আছে কলেঙ্গার হাজি সাহেব, কোহিনূর বেকবাগান, হাজি সাহেব পার্ক সার্কাস, হাজি মিট শপ যদুবাবুর বাজার, যা পরিচিত মুন্না মিট শপ বলে। এদের চেনা যায় খুব সহজে আর ব্যবহার একই রকম। দোকানিরা দুর্দান্ত ছাগল চেনেন, আবার কাস্টমারও চেনেন বিলক্ষণ। পরিচিতের সঙ্গে মধুলাপ ও অপরিচিতের সঙ্গে তিরিক্ষি ব্যবহার করেন। আপনার পছন্দের জায়গার মাংস এঁদের কাছে পাবেন না। সেগুলো বড় হোটেল-রেস্তোরাঁর যায়। এঁদের মর্জিমতো পাঁচমেশালি মাংস নিলে আপনি লাইনে দাঁড়াতে পারেন, নয়তো কেটে পড়ুন। এর পর আছে সুপারস্টার দোকান। এদের দাম বেশি। ব্যবহার ভাল। নিজেরাই বলবেন- বিরিয়ানির জন্য হলে রান নেবেন না, সিনা বা চাপ নিন। এমনই হেল্পফুল তাঁরা। সুতরাং তাদের দোকানে ভোর থেকে লাইন পড়বে। সুরক্ষাবিধির সঙ্গে জল ও জলখাবার বেঁধে নিয়ে যেতে ভুলবেন না। এরা হলেন হাজরার বরকত আলি, আনোয়ার শাহ রোডে মাজারের গায়ে লাকি মিট শপ, খিদিরপুরের রহমানিয়া, বাঁশদ্রোণীর নূর ও ফুলবাগান মিট শপ।

আরও পড়ুন: রেস্তরাঁর মতো ডেজার্ট বানান বাড়িতেই

দূরত্ববিধি মানলে কোথাকার লাইন কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, তা আমাদের জানা নেই। সকাল থেকে পুলিশ মোতায়েন থাকবে নিশ্চিত। পুরসভা না দিক, দোকানিরা বাঁশের রেলিং স্যানিটাইজার ফাউন্টেনের ব্যবস্থা করতেই পারেন। কেবল পেটের কথা নয়, প্রাণের কথা চিন্তা করুন। মাংস দুই-চার দিন আগেই কিনে রাখুন। হোম ডেলিভারিতেও অনেকে খাসির মাংস কেনেন। তবে তাতে রেওয়াজ কম। বেশির ভাগ মাংসই পাঁচমেশালি। বাঙালি ছাগলের অ্যানাটমি চর্চা না করলেও হরেক স্বাদের রেস্তোরাঁয় খেয়ে এটুকু ধারণা করতে পেরেছে- মিক্সড মাংসে ‘লাল-হলুদ ঝোলে এক টুকরো আলু আর দু টুকরো মাংসের’ স্বপ্ন পূরণ হতে পারে, কিন্তু রিসার্চ করে রেসিপি পছন্দ করা হায়দ্রাবাদি বিরিয়ানি বা কাশ্মীরি তাবকমাজ কিছুই হবে না। মানে পুজোর দিনে মাস্ক, পিপিই যুদ্ধ সব যাবে জলে বা ফি-সপ্তাহের হলুদ ঝোলেও বলা যায়। হরিণঘাটা চেভলো বলে এক স্প্যানিশ ব্রিড আমদানি করেছে। তা-ও খেতে কচি পাঁঠার মতো। সুতরাং যদি মোটা ফাইবার আর রেওয়াজে মেশানো মাংসই খেতে হয়, তা হলে আগে গিয়ে কিনে রাখুন আপনার পছন্দের দোকান থেকে পছন্দসই জায়গার মাংস। এতে আপনার রিসার্চটা জলে বা ঝোলে গেল না, আর রেওয়াজটাও বলবৎ রইল। দূরত্ববিধির ফাইটটা না হয় ঘরে বসে টিভিতেই দেখে নেবেন। বরং এ বার মাংস ম্যারিনেট করুন চব্বিশ ঘণ্টা, আটচল্লিশ ঘণ্টা ধরে। দই-লেবু-ভিনেগারের বদলে ট্রাই করুন রেড ওয়াইন, বেদানার রস, আনারস, পাকা কামরাঙা, বিলিতি আমড়া, মেস্টা সিরাপ, রেড রাম। অপ্রচলিত ম্যারিনেশন স্বাদে আনবে চমক আর দূরের রেসিপিকে করবে নিকট বন্ধু। স্পেয়ার রিবস দিয়ে তাবকমাজ, সিনা আর বাঁশের কোড় দিয়ে নাগা স্টাইল মাটন, গর্দানের মাংসে বানান রাজস্থানী লাল মাঁস বা মাটন বানজারা, রানের মাংস দিয়ে সাদা নারকেলের গ্রেভিতে কোঙ্কনি মাটন কারি। আপাতত রান, বাঙালি রান। বুদ্ধিমান বাঙালির নবমীর রেওয়াজে এ ভাবেই ঘুচিয়ে দেবে দূরত্ববিধি!

Durga Puja 2020 দুর্গাপুজো খাবার Puja special sweets Nabami Special Food Mutton Durga Puja Celebration 2020 Durga Puja Kolkata Durga Puja

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

এটি একটি প্রিন্ট আর্টিক্‌ল…

  • এমন অনেক খবরই এখন আপনার হাতের মুঠোয়

  • সঙ্গে রোজ পান আনন্দবাজার পত্রিকার নতুন ই-পেপার পড়ার সুযোগ

  • ই-পেপারের খবর এখন শুধুই ছবিতে নয়, টেক্সটেও

প্ল্যান সিলেক্ট করুন

ক্যানসেল করতে পারবেন আপনার সুবিধামতো

Best Value
প্রতি বছরে

৫১৪৮

১৯৯৯

প্ল্যানটি সিলেক্ট করে 'Subscribe Now' ক্লিক করুন।শর্তাবলী প্রযোজ্য।
*মান্থলি প্ল্যান সাপেক্ষে
প্রতি মাসে

৪২৯

১৬৯

প্ল্যানটি সিলেক্ট করে 'Subscribe Now' ক্লিক করুন।শর্তাবলী প্রযোজ্য।