পাড়ায় ঘুরে ঘুরে বিজয়া করার দিন মেলা শরৎকাল আগেই খতম। কাজেই কেনা মিষ্টির বাইরে হাতের নাড়ুটা, নিমকিটা পাওয়ার দিনও শেষ। দিনে দিনে যেতে পারলে ঘুগনি আর মিহিদানাও জুটত। বিজয়ার রান্নার তোড়জোড় শুরু হত আগের রাত থেকেই। মটর ভেজানো হত বড় হাঁড়িতে। আমাদের ছেলে-ছোকরাদের ডিউটি থাকত ঘণ্টায় ঘণ্টায় চেক করা, জল টেনে গেলেই জল দিয়ে ওয়াটার লেভেল বিপদ সীমানায় তুলে দেওয়া। রাত্রে তৈরি গরম মিহিদানা পাওয়া যেত কখনও সখনও, ওয়াটারম্যানের পারিশ্রমিক হিসেবে। আমার জ্যাঠতুতো দাদা আর পাড়াতুতো দিদিদের সঙ্গে বিকেলেই মিটিং হয়ে যেত, কার বাড়ির কী মেনু। আকর্ষণীয় মেনু হিসেবে সব থেকে বেশি র্যাঙ্কিং পেত মাংসের ঘুগনি। চিকেন পরে। মাটন আগে। যেখানে মাটন ঘুগনি, তাঁর বাড়ি আমরা আগে বিজয়া সারব। অবশ্যই দল বেঁধে। এই দল বেঁধে যাওয়ার কারণ ছিল। হাত সাফাই। নাড়ু, চন্দ্রপুলি, মিষ্টিটিষ্টি আমরা সেখানে বসে খেতাম না। কৌটায় ভরে নিয়ে, কেবল ঘুগনি খেয়ে পরের বাড়ির রাস্তা ধরতাম। তার পর ছিল নারকেলের ঘুগনির টার্গেট। তার পর প্লেন ঘুগনি। বাড়ি বাড়ি ঘুরে দশমীতে আমাদের ডিনারই ছিল বিভিন্ন পদের ঘুগনি খাওয়া। এই ঘুগনি কে রাঁধছে তা জেনেও যেমন টিক দিতাম, আবার উপাদান অনুসারেও সিরিয়াল ঠিক করতাম আমরা। হলুদ মটরের উপরে ছিল সবুজ মটর, তার উপরে ছিল কাবলি ছোলা। টাই অপশনে রাঁধুনিদের হাতযশ, প্রদেয় পরিমাণও বিচার্য ছিল। বাড়িতে কুকুর থাকলে নেগেটিভ মার্কিং-ও হত। সেই সব রাঁধুনিরা অধিকাংশই নেই। পুরনো বাড়ি ভেঙে হল ফ্ল্যাটবাড়ি, অবাঙালি পরিবার বাড়তে লাগল, আর বন্ধু-বান্ধব দেশে-বিদেশে হাওয়া হতেই পাট চুকল বিজয়ার। তাই আমরা সোশ্যাল ডিসট্যান্সিং প্র্যাকটিস করছি বহু বছর যাবৎ। পরের জেনারেশন থেকে এ সব হ্যাংওভার আর নেই।
আরও পড়ুন: সনাতনী আহারেই বাহার, মেটে মটরশুঁটি মরিচ বানান এ ভাবে
হলুদ পাখির মতো মাংসের ঘুগনি চট করে পাওয়া যেত না বটে, কিন্তু কলকাতার রাস্তায় বিকেলে চাটওয়ালারা শিঙাড়া আর আলুর টিকিয়া দিয়ে বা না দিয়ে ঘুগনির চাট বানাত। উপরে ছড়িয়ে দিত কাঁচা লংকা, পেঁয়াজ, ধনে পাতার কুচি। ইদানীং সেউও। পার্ক সার্কাস ময়দান, ইডিএফ, লেক গার্ডেন্স, গড়িয়াহাট বা হেদুয়ার বেথুনের গায়ে এই ‘স্বাদে ঘুগনি নামে চাট’ তরিবৎ করে বানালেও মাংসের ঘুগনি হাতে গোনা চার-পাঁচ জনই বেচতেন। সেগুলো আবার ঠিক মাংসের না। ছাঁটের ঘুগনি বলাই ভাল। বাগবাজার সর্বজনীনের কাছে বসতেন জনা চারেক। এক জন খন্না সিনেমার গায়ে। গাঁজা পার্কে দুই জন। এক জন যদু বাবুর বাজারের উল্টো দিকে দেবেন ঘোষ রোডে। খন্না সিনেমার গায়ে বসতেন হরি। তার গায়ের সরু গলিতে ক্ষেত্রপ্রসাদ সেনশর্মার বাড়িতে বসত জমাটি আড্ডার আসর, রবিবার সন্ধ্যায়। তাঁর স্ত্রী শিপ্রা সেনশর্মার কাছে পড়তে বসলেই পাশের ঘরে শুরু হত আড্ডা। সেই আড্ডায় আসতেন চলচ্চিত্র জগতের অনেক দিকপাল অভিনেতা। হাহা হিহি শুরু হওয়ার কিছুক্ষণ পরে এসে পৌঁছত তেলেভাজা বা মাংসের ঘুগনির গন্ধ। আমাদের কাজ ছিল কোনও ক্রমে সেখান থেকে পড়া শেষ করে বেরিয়ে হরির দোকানে গিয়ে পরপর দুই প্লেট ছাঁটের ঘুগনি খাওয়া। তখন দাম ছিল প্লেট প্রতি চার টাকা। সুতরাং হাতখরচ থেকে দু টাকা বাঁচাতেও পারতাম। এ বার পুজোর আগে খোঁজ নিতে গেলাম। পুজোর বাজারের ভিড়েও এই ফুটপাথ আশ্চর্য অন্ধকার। হল বন্ধ বহু দিন। সে এখন ভূতের বাড়ি। সেনশর্মাদের বিখ্যাত বাড়িও চিনতে পারলাম না। এটুকু জানলাম, হরি এখান থেকে উঠে গিয়েছে বছর কুড়ি আগে। হল বন্ধ হতেই। এক বৃদ্ধ খবর দিলেন, হরি এখন বসে ডোমপাড়ায় কোনও মদের ঠেকের কাছে। বলে সটান উপর দিকে আঙুল তুলল, তাই সেখানে গিয়ে খোঁজ করতে সাহস হয়নি।
দেবেন ঘোষ রোডে পেলাম জগন্নাথ সিংহকে। বাবা পরেশ সিংহ যখন চালু করেন এই দোকান, তখন এই ঘুগনির দাম ছিল ৩৫ পয়সা। সাল তারিখ তাঁর মনে গাঁথা ঘুগনির দামের নিরিখে। ট্যাক্সি চালানো ছেড়ে এই দোকানের দায়িত্ব নিতে হল ১৯৮৪ সালের পরে। তখন ঘুগনির দাম ৩ টাকা পঞ্চাশ। বর্তমানে যার দাম কুড়ি টাকা প্রতি প্লেট। ছ’মাস বন্ধ থাকার পরে আবার চালু করেছেন দোকান। রোজ বিক্রি হয় তিন বড় বড় ডেকচি ছাঁটের ঘুগনি। মটর আর ছাঁট মিলিয়ে চার-পাঁচ কেজি। লোকে মাস্ক খুলে রাস্তায় দাঁড়িয়ে দেদার খাচ্ছে। এ ছাড়াও বিক্রি হয় ছাঁট কষা, বট, ফ্যাবড়া বা লাংস, ব্রেন কারি। টলিউডে এই ঘুগনি জনপ্রিয় করে দিয়েছিলেন সুখেন দাস। গাঁজা পার্কে বসতেন যে দু’জন, এক জন আগেই বন্ধ করেছেন। অন্য জন লকডাউনে দোকান উঠিয়ে ফিরে গিয়েছেন ট্যাক্সির পেশায়। জগন্নাথের জনপ্রিয়তা কমেনি, বেড়েছে। সে অবশ্য ছাঁটের বদলে ব্যবহার করে খাসির মাথার মাংস আর ঘরে তৈরি মশলা। যা আমরা সহজেই বানিয়ে ফেলতে পারি এ বারের বিজয়ায়, বাড়ির রান্নাঘরে। নবমীতে এত মাংসের চাহিদা, কিন্তু মাথার চাহিদা এত নয়। কাজেই মাংস বিক্রেতাদের সে সব ভাগাড়ে পাঠানোর সুযোগ দেবেন না। আগে থেকে বলে রাখুন মাথার জন্য। সহজেই জোগাড় হয়ে যাবে।
প্রণালী- মটর বা কাবলি ছোলা প্রেশার কুকারে সেদ্ধ করে নিন। লবণ কম দেবেন। কারণ মাংস আলাদা করে রান্না করে এতে মেশানো হবে। মাংস ধুয়ে মশলা মাখিয়ে, পেঁয়াজের টুকরো সহ রেডি করে রাখুন। প্রেসারে তেল দিয়ে জিরে ও শুকনো লংকা ফোড়ন দিন। মাংসটা দিয়ে লবন দিয়ে কষতে থাকুন। প্রেশারের ঢাকনা দিয়ে মাঝারি আঁচে ১৫ মিনিট রান্না করুন। মটর আগেই সেদ্ধ করা, তাই চারটের বেশি সিটির প্রয়োজন নেই। এই ঘুগনি খাবেন গরম গরম। বেঁচে থাকা ভাজা মশলার গুঁড়ো পরিবেশনের সময় উপরে ছড়িয়ে দিতে পারেন। কলকাতার রাজপথে উপরে কাঁচা লংকা, পেঁয়াজ কুচি, লেবুর রস ইত্যাদি দেওয়া হয়। আমি বলি কি, সে সবের প্রয়োজন নেই। দেরি করলে শেষ হয়ে যেতে পারে। এই জন্য ছোটবেলায় আমরা কত তিথি-নক্ষত্র বিচার করে ঘুগনি খাওয়ার লিস্টি বানাতাম! এই বার মুখে দিলে বুঝতে পারবেন।
গ্রাফিক চিত্র :তিয়াসা দাস
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy