Advertisement

Associate Partner

Style Partner

Associate Partner

Weddings Partner

Food Partner

NRI Bengali

পুজোর কোনও চিঠি আসে, কোনও চিঠি আসে না, কোনও চিঠি ঠিকানা ভুলে চলে যায় দুনিয়ার বুকপকেটে

অনেক অনেক দিন আগে, মানুষের জীবনে এরকম কিছু ‘আপন আপন’ চিঠি ছিল। এখনের নাকঢাকা মুখঢাকা মানুষের দুনিয়ায় সেই সব চিঠি আর নেই।

মানুষের জীবনে এরকম কিছু ‘আপন আপন’ চিঠি ছিল।

মানুষের জীবনে এরকম কিছু ‘আপন আপন’ চিঠি ছিল।

শুভঙ্কর মুখোপাধ্যায়
ন্যাশভিল শেষ আপডেট: ১৪ অক্টোবর ২০২১ ১৮:৪৩
Share: Save:

প্রতিদিন বিকেলে মানুষটা একা একা এসে বসে থাকতেন রাস্তার ধারে লাল টুকটুকে ডাকবাক্সটার পাশে।

উসকোখুসকো চুল, এলোমেলো পোশাক, কত দিন চান নেই কে জানে! মুখে মৃদু হাসি, ক্যামেরার মতো সন্ধানী দুই চোখ! কলেজ স্ট্রিটকে একটু পিছনে রেখে খানিক পরেই ওই রাস্তা হুমড়ি খেয়ে পড়বে সেন্ট্রাল এভিনিউয়ে। বাঁ হাতে মেডিক্যাল কলেজ, ডান হাতে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়। ডাকবাক্সটার পিছনেই বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা ফটক, আমরা ছাত্রছাত্রীরা যেটাকে বলতাম ‘পাশের দরজা’! হার্ডিং বিল্ডিংয়ের ক্লাস, ছাত্রভবনের মিটিং, রাখালদার ক্যান্টিনের আড্ডা মিটিয়ে, ফি বিকেলে আমি ওই পাশের দরজায় গিয়ে দাঁড়াতাম, ঠিক ওই মানুষটার মতো। ওখানে একটি মেয়ে অপেক্ষা করত আমার জন্য। ওর সঙ্গে আমার কিছু ‘বন্ধু বন্ধু’ গল্প হত! যেমন, মেয়েটা হয়তো আমাকে বলত, ‘‘চুলটা কাটবি তো। খুব বেড়ে গিয়েছে!’’ কিংবা আমি হয়তো মেয়েটিকে বলতাম, তোকে অফ কালারের শাড়িতেই বেশি ভাল লাগে! এ ভাবেই দিব্য চলছিল আমাদের এই টুকরো বিকেলগুলি। একদিন অচানক, এ রকম এক গল্পের বিকেলে আমি মেয়েটির কাছে জানতে চাইলাম, তোর কোনটা বেশি ভাল লাগে, দুপুর না বিকেল? মেয়েটা কেমন একটা অচেনা অনুযোগের সুরে বলল, ‘‘আমার এই বিকেলগুলো ভাল লাগে। থাক সে সব। তুই কি কিছুই বুঝিস না!’’ এ কথা বলেই মেয়েটা হারিয়ে গেল পথের প্রান্তে, সঙ্গে করে নিয়ে গেল আমার কিছু একান্ত অপরাহ্ণ!

যাওয়ার আগে একবার, এই শেষবারের মতো মেয়েটি পিছন ফিরে চাইল আমার দিকে। খুব একা লাগল আমার। সেই মানুষটি তখনও ঠায় বসে আছেন ডাকবাক্সটার পাশে। আমি তাঁর কাছে গিয়ে, একটু ঝুঁকে প্রশ্ন করলাম, রোজ বিকেলে এখানে এসে বসে থাকেন কেন? মানুষটি খুব চাপা স্বরে, কোনও গোপন খবর দেওয়ার মতো করে বললেন, ‘‘চিঠি আসবে!’’ বলেই ফ্যালফ্যাল করে আকাশের দিকে চেয়ে, আপনমনে শিস বাজিয়ে সুর ধরলেন, ‘‘আমারে যে জাগতে হবে, কী জানি সে আসবে কবে।’’

এই গানটা খুব ভাল গাইত শশাদা। আমাদের কলেজ হস্টেলের শশাঙ্কশেখর জানা। চিঠির ব্যাপারে একটা আশ্চর্য দরদ ছিল ওর। ও বলত, ‘‘যা মুখ ফুটে বলা যায় না, মনের সেই সব কথাই তো চিঠি!’’ এই অরূপ বাণীটুকু দিয়ে, ডান হাতে ডান কান চেপে শশাদা ছোটে ওস্তাদের মতো গান ধরত, ‘‘হাজার কথার মরণ হলে হৃদয় কথা বলে।’’

সপ্তাহে দু’টি করে চিঠি লিখত শশাদা, একটা মা-বাবাকে, আর ‘এ সপ্তাহের প্রেমিকাকে’ একটা। এই দুই রকম চিঠির খসড়া করে, তার ফটোকপি করা থাকত ওর কাছে। মা-বাবাকে লেখা চিঠির কপি খামে ভরে নিয়মিত ডাকবাক্সে ফেলে দিত শশাদা, আর অন্য চিঠির কপি যথাসময়ে জমা দিত ‘সাপ্তাহিক’ মেয়েটির হাতে। প্রথম চিঠিটি এরকম, ‘প্রিয় মা ও বাবা, প্রথমেই প্রণাম জানাই, নইলে পরে ভুলে যাব। তোমরা ভালই আছো নিশ্চয়ই। আমি ঠিক আছি। পড়াশোনা ছাড়া আর কিছু করার সময়ই পাই না। তবে হস্টেলের খাবার খেয়ে খেয়ে আমার পেট খারাপ লেগেই থাকে। ওষুধ খেয়ে সামাল দিই। কলকাতায় ওষুধের দাম হু হু করে বেড়েই চলেছে। কাজেই একটু বেশি করে টাকা পাঠিও। ইতি তোমাদের হতভাগ্য ছেলে, শশা।’ পরের চিঠিটা এরকম, ‘শনিবার সকালে হস্টেলের বিপরীতে অপেক্ষা করো। অনেক না বলা কথা আছে। পত্রদ্বারা নিমন্ত্রণের ত্রুটি মার্জনীয়!’

এ ভাবেই সব ঠিকঠাক চলছিল। হঠাৎ এক বিকেলে, সম্ভবত গঞ্জিকার মাত্রাধিক্যের কারণে, চিঠির ভ্রান্তিবিলাস ঘটে গেল শশাদার অজান্তে। মেয়েটির হাতে যে চিঠিটি জমা পড়ল, সেই চিঠিরই আর একটি কপি খামে ভরে পোস্ট করে দিল শশাদা। ফলত, শনিবার সকালে ছেলের জন্য অপেক্ষারত ‘শশার বাপ’ সময় কাটানোর নিমিত্ত পাশেই প্রতীক্ষামানা মেয়েটির সাথে গল্প জুড়ে দিলেন। আর ঠিক সেই সময়ে মঞ্চে প্রবেশ করে হতবাক শশাদা নিজের ভুল বুঝতে পেরে জিভ কাটল লজ্জায়। তবে শেষ পর্যন্ত অসামান্য দক্ষতায় পিতা ও প্রেমিকা, দু’জনকেই ম্যানেজ করে নিয়েছিল শশাদা। আসলে শশাদা জানত, কিছু চিঠি থাকে, যা ভুল ঠিকানায় চলে যায়। সেই সব উড়োচিঠির তল পাই না আমরা। আমরা শুধু হলফ করে বলতে পারি, শশাদার ওই সব ‘অপ্রকাশিত পত্রাবলি’ যে কোনও উঁচু দরের শারদীয়া পত্রিকায় প্রকাশযোগ্য। সেগুলির মধ্যে শশাদার শেষ চিঠিটা সবচেয়ে সেরা। ‘ব্যক্তিগত কারণ’-এ আমাদের হস্টেল থেকে নিরুদ্দেশ হওয়ার আগে ওই চিঠিটা আমার বালিশের তলায় রেখে গিয়েছিল শশাদা, ‘চললাম। আর দেখা হবে না। ঠিকানা দিলাম না। যদি কখনও একা লাগে, আমার এই চিঠিটা হাতে নিয়ে ভাববি, এই তো শশাদা।’ মানুষ কেন কখন লেখে এমন নিরুত্তর চিঠি? চিঠি কি তা হলে মানুষের অসম্পূর্ণ জীবনের অভিজ্ঞান?

হবেও বা। নইলে কেনই বা পারুলমাসি তার ছেলের শেষ চিঠি অবিন্যস্ত শাড়ির আঁচলের খুঁটে বেঁধে পথে পথে ঘুরে বেড়াবে, ধুলিধূসর ক্ষতবিক্ষত পায়ে, অন্তহীন! আমরা বলতাম ‘হাজার চুরাশির মা’। পারুলমাসির ছেলে পলাশদা ছিল সেই সময়ের নামকরা ছাত্র। প্রেসিডেন্সি, পদার্থবিজ্ঞান। এক মহালয়ার বিকেলে ছেলের চিঠি পেয়েছিল পারুলমাসি। ‘মা, কলকাতায় ঢাক বাজতে শুরু করে দিয়েছে। হস্টেলে আমার ঘরের জানলা দিয়ে সকালবেলা শরতের হাওয়া ঢোকে, হিমের পরশ পাই। তখন বাড়ির কথা খুব মনে পড়ে। আমাদের উঠোনের শিউলি গাছটায় নিশ্চয়ই এখন ফুলের মেলা। ষষ্ঠীর দিন বাড়ি যাব। নারকেলের নাড়ু করে রাখবে’। পলাশদা আসেনি। ওর হস্টেলের বন্ধুরা জানিয়েছিল, শেষবার পলাশদাকে দেখা গিয়েছিল মহালয়ার দু’দিন পরে। ইডেন হস্টেলের সামনে কলকাতার এক কুয়াশা সন্ধ্যায় ‘নকশালবাড়ি লাল সেলাম’ বলতে বলতে পুলিশের একটা কালো ভ্যানে উঠে গিয়েছিল পলাশদা। তার পরে থেকেই আমাদের হাজার চুরাশির মায়ের জীবন যেন এক পরিত্যক্ত ডাকঘর! একটা মিথ্যা চিঠি আঁচলে বেঁধে ডাকপিয়নের মতো রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াত পারুলমাসি। আর কাউকে সামনে পেলেই খবর দিত, ‘‘পলাশ চিঠি দিয়েছে। পুজোয় বাড়ি আসবে।’’ মায়ের হাতে কেন যে এমন চিঠি দেয় নিয়তির ডাকহরকরা!

কমলজেঠু কি জানত সেটা? জানতে চাইনি কখনও। আমাদের পাশের বাড়ির কমলজেঠু কাজ করত পোস্ট অফিসের ‘ডেড লেটার’ সেকশনে। কমলজেঠু বলত, ‘‘ডেড লেটার আবার কী কথা! চিঠিরা মরে না। কিছু চিঠি মাঝপথে হারিয়ে যায় বটে। সে তো কত কত মানুষও হারিয়ে যায়! তাই বলে কি তারা সবাই মরে যায় নাকি!’’ না তো, মরে না তো! অজানা গল্প হয়ে, অচেনা ছবি হয়ে কত শত চিঠি ঘুমিয়ে থাকে, লুকিয়ে থাকে আজীবন, চিরন্তন! হয়তো গন্তব্যহীন, হয়তো অকারণ।

কমলজেঠুর ছেলে গোলাপদা চাকরি করত ভিনজেলায়। সেবার গোলাপদা ‘বিজয়ার প্রণাম’ জানিয়ে চিঠি দিয়েছিল বাবাকে। সেই চিঠি যখন নির্দিষ্ট ঠিকানায় পৌঁছল, কমলজেঠু তখন সব পোস্টাল নেটওয়ার্কের বাইরে। গোলাপদার বোন বকুল। বাবাকে লেখা দাদার ওই চিঠিটা জমা দিয়ে এসেছিল ডাকঘরের ডেড লেটার সেকশনে। বেশ করেছিল, হতে পারে সেটা একটা লক্ষ্যভ্রষ্ট চিঠি, কিন্তু তাই বলে তো তা গৃহহীন নয়! থাক না সে জিয়নকাঠিটি হয়ে অনাদিকাল, এই পৃথিবীর গোপন বুকপকেটে। বকুল, আমার মনেও এমন করে কিছু সোনারকাঠি রুপোরকাঠি চিঠি জমে আছে রে! আমার মায়ের বাদামি পোস্টকার্ড, ‘আর একটু কষ্ট করো বাবা। দেখবে, সুসময় আসবেই।’ আমার ঠাকুমার নীল ইনল্যান্ড, ‘সময় সুযোগ করে একবার এই বুড়ি বান্ধবীটাকে দেখে যেও। দাদাভাই, একা থাকি তো, সময় আর কাটে না।’ আর একটি মেয়েটির রঙিন খাম, যত্নে লেখা, ‘পুজোর সময় আসবি তো? কত দিন দেখিনি তোকে।’ ঘুমভাঙা মাঝরাতে আমি মনে মনে ওই চিঠিগুলি খুলে বসি। এই তো আছে, সব আছে, সবাই আছে। চিঠি হয়ে আছে।

অনেক অনেক দিন আগে, মানুষের জীবনে এরকম কিছু ‘আপন আপন’ চিঠি ছিল। এখনের নাকঢাকা মুখঢাকা মানুষের দুনিয়ায় সেই সব চিঠি আর নেই। কে লিখবে চিঠি? কাকে লিখবে? একটা বন্ধঘরের ভিতরে বসে আমরা সবাই কয়েকটা ছোট বড় যন্ত্রের সঙ্গে গোলকধাঁধার মতো জড়িয়ে আছি। ‘ডাক’ আসে না। ‘কর্নেলকে কেউ চিঠি চিঠি লেখে না’! তবু চিঠিরা থাকবে। গল্প শুরুর সেই মানুষটার মতো উদভ্রান্ত আধমরা কিছু মানুষ ওই লাল টুকটুকে ডাকবাক্সটার পাশে গিয়ে বসবে। অপেক্ষা করবে, কখন চিঠি আসবে।

রানার, ছুটেছে রানার, কাজ নিয়েছে সে নতুন খবর আনার!

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy