কৈলাসে মা দুগ্গা, বাপেরবাড়ি আসার তল্পিতল্পা গোছাবেন কি গোছাবেন না, তাই নিয়ে চলছে দোনামনা। চিন্তার ছায়া মুখে দোল খাচ্ছে তাঁর। আর তাঁর চার ছানাপোনা রাগে-দুঃখে ছড়া কেটে বেড়াচ্ছে-
‘গোল পাকিয়েছ যেতে মামাবাড়ি
মারী, তোমার সঙ্গে আড়ি।’
‘কুমোরটুলি টু প্রবাস’ যাওয়ার রাস্তাও সিল করে দেওয়া হয়েছে এ বছর। তবু ভালবাসার জোরে পুজো এ বার হবেই- সিদ্ধান্ত নিয়েছে প্রবাসের বাঙালি। মারী-র সঙ্গে আপস নয়, চিরাচরিত বিশালবপু আয়োজনের সঙ্গে আপস করে।
আটলান্টার ‘পুজারী(প্রতিষ্ঠিত: ১৯৮৬)-র পুজো হচ্ছে সাবেক ‘নিত্যপুজো’র ফরম্যাটে, কিন্তু আধুনিকতার ‘টেক-কালচার পুষ্ট’ হয়ে। লাইভ টেলিকাস্টে অঞ্জলি দেওয়ার সুযোগ পাবেন সদস্যরা। অনলাইন অনুষ্ঠানের ডালিও সাজানো হয়েছে সেই অনুযায়ীই। শুধু গত বছরে বিপুল টাকা ব্যয়ে আনা কুমোরটুলির মূর্তি ‘স্টোরেজে’ আর এক বছর বিশ্রাম নেওয়ার অবসর পেল। তাঁকে উদ্দেশ্য করেই সকলের সমবেত ‘মন’ নিশ্চয়ই এক বার বলে উঠবে, “আসছে বছর আবার হবে।”
আরও পড়ুন: করোনা-কাঁটায় বন্ধ পুজো, ওসলো-র ভরসা ভার্চুয়াল আমেজ
আটলান্টার ‘বেঙ্গলি অ্যাসোসিয়েশন অফ গ্রেটার আটলান্টা’(প্রতিষ্ঠিত: ১৯৮২) সংস্থার কমিটির কর্মকর্তারা সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে পুজো করছেন গ্যারেজে। ছোট্ট মূর্তি না ছবি? এখনও সিদ্ধান্তের অপেক্ষায়। তবে তাঁদেরও বিশাল মূর্তি এ বছর বিশ্রামরত।
আটলান্টার নস্টালজিক বাঙালির মনে পড়ে যাচ্ছে, সাতের দশকে আটলান্টার প্রথম পুজোর সূচনা হয়েছিল এই গ্যারাজেই। বর্তমানের হাত ধরে এ ভাবেই আমরা কখনও সখনও পৌঁছে যাই অতীতে। তাঁরা দেশের খ্যাতনামা শিল্পীদের নিয়ে অনলাইন-অনুষ্ঠান করছেন দু’দিন। খাওয়ার কুপনও দিয়েছে সদস্যদের- দোকান থেকে সেই খাবার সংগ্রহ করা যাবে। যাতে যে যাঁর বাড়িতে একসঙ্গে একই পুজোর খাবার খেতে খেতে ভার্চুয়াল অনুষ্ঠান দেখতে পারেন।
‘পূর্বাশা’(প্রতিষ্ঠিত:২০১১) নিয়েছে ঘটপুজোর সিদ্ধান্ত। যেহেতু ১০ জনের বেশি লোক সমাগমে সরকারি বিধিনিষেধ রয়েছে, মূর্তি স্থাপন তাই দুষ্কর। আবার জাতীয় নির্বাচন সামনে বলে স্কুলও ভাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। তবে পুজো হচ্ছেই, খাবারও থাকছে। শুধু পুজো দর্শনার্থীদের নামের আদ্যাক্ষর ধরে দেবীদর্শনের সময় বেঁধে দেওয়া হবে, যাতে নির্দিষ্ট সময়ে তাঁরা হাজির থাকতে পারেন। অর্থাৎ মায়ের সঙ্গে ‘ভিজিট বাই অ্যাপয়েন্টমেন্ট’!
আরও পড়ুন: অতিমারির পুজোয় গঙ্গা বাঁচানোর ডাক ক্যামডেনের মণ্ডপে
আটলান্টার ‘পূজা পরিষদ’ জানাল যে, কৃষ্টি অক্ষুণ্ণ ও অব্যাহত রাখতে সংক্ষিপ্ত হলেও পুজো তাঁরা করবেনই। জল্পনায় কাটছে তাঁদের ব্যস্ত দিন ও রাত। বিশদে সিদ্ধান্ত এই মুহূর্তে স্থগিত থাকলেও পুজো স্থগিত কদাপি নয়।
আটলান্টা বেঙ্গলি ফোরাম(প্রতিষ্ঠিত:২০০১) বর্তমান ‘করোনা’ পরিস্থিতিতে জনসমাগমের কোনও ঝুঁকি নিতে চাননি বলে ওয়েবসাইটে জানিয়ে দিয়েছেন পুজো হচ্ছে না। কিন্তু ঐতিহ্যের ক্রমানুসারিতা ভাঙতেও চান না। মা দুর্গা তাই তাঁদের কাছে আসবেন ‘আনঅফিশিয়ালি’ ও ‘প্রাইভেটলি’। আর হ্যাঁ, এ ক্ষেত্রে ছবি বা ঘট নয়, আসবেন কুমোরটুলির সালঙ্কারা প্রতিমা হয়েই।
‘বাংলাদেশ পুজা অ্যাসোসিয়েশন’-এর উপদেষ্টার বাড়িতে করোনা পরিস্থিতিতে কয়েক দিন আগে ‘শীতলা’ পুজোও হয়ে গিয়েছে। তাঁরা পুজো করবেন এ বার সভাপতির বাড়ির গ্যারাজেই, সাবেক প্রতিমায়। থাকবেন শুধু কর্মকর্তারাই। তবে সামাজিক দূরত্ব মেনেই হবে সব। প্যাকেট বা বাক্সে থাকবে খাবার। নিয়ম হল: ‘প্রণাম কর-প্যাকেট তোলো-বাড়ি চল।’
‘বাংলাদেশ হিন্দু অ্যাসোসিয়েশন’ বিদেশে গত ১৬ বছর যাবৎ পুজো করে আসছেন তিথি-দিনক্ষণ মেনে। এ বার স্বাস্থ্যগত নিরাপত্তার খাতিরে শুধুই নিয়মরক্ষার্থে হবে নবমীর ঘটপুজো।
‘জর্জিয়া বাংলাদেশ পুজা সমিতি’ (প্রতিষ্ঠিত : ২০০৩)-র পুরোহিতের বাড়িতেই এ বার নিষ্ঠাভরে হচ্ছে পুজো। তবে পরবর্তী সব রকম ‘বিতর্ক’ এড়াতে সাধারণ মানুষের তো বটেই, এমনকি সমিতির আজীবন সদস্যদের জন্যও পুজোয় আসা ‘বাধ্যতামূলেক’ করেননি তাঁরা।
আরও পড়ুন: লুপ্তপ্রায় পটচিত্রকে জীবনদানের প্রয়াস বেঙ্গালুরুর পুজোয়
আটলান্টার ‘বাতাস-মন্থনে’ তাই একটাই খবর এখন। ‘ম্যাক্সি’ পুজোকে ‘মিনি’ ফর্মে করে মারী-কে তুড়ি মেরে ওড়াতে ও এড়াতে বদ্ধপরিকর তাঁরা। আসলে পুজো মানেই তো তাই। বাস্তবের শিকল ভেঙে ক্ষণিকের মুক্তি-প্রাপ্তি!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy