এ তুমি কেমন তুমি? অঞ্জলি নেবে ফুল ছাড়া, গঙ্গাজলের বদলে স্যানিটাইজার মাখতে বল, রংবেরঙের মুখোশে সুন্দর মুখগুলো ঢেকে যায় যাক, ট্রাঙ্কের ভেতর থেকে ঝেড়েঝুড়ে বেরবে না জামদানি বা গরদ বা বালুচরী কিম্বা কাঁথাকাজের শাড়ি। লন্ডনের ঠান্ডাকে তোয়াক্কা না করে হল্টার নেক, স্টিলেটো হিল পরা এলোকেশী বঙ্গললনারাও উধাও। প্রবাসীর ডায়েরি থেকে পুজোর দিনগুলো এমনি করে কেন এবার মুছে দিলে বল তো মা? লন্ডনের পুজোর ইতিহাস বড় প্রাচীন। এমনধারা তো কখনও হয়নি? প্রথম বারোয়ারি পূজো শুরু হয়েছিল ’৬০-এর দশকের শুরুতে। সেই থেকে লন্ডনের বাঙালি প্রাণভরে পুজোর দিনগুলোতে মেতেছে নিয়ম মেনে পাঁজি দেখে ঘন্টা ধরে। চক্ষুদান, সন্ধিপুজো এমনকি ফায়ার অ্যালার্মকে তুষ্ট করে যজ্ঞ-হোমও করা হয়েছে। এ পুজো আমেরিকার মতো হালফ্যাশনের উইকেন্ডের ছিল না। এমনকি এখনও বেশির ভাগ পুজোই হয় তিথিধরে। কত আগে থেকে হল বুক করতে হয়, ঠাকুর আসে কুমোরটুলি থেকে, কলকাতা থেকে আসেন শিল্পীরা, ইদানিং তো শাড়ীর বুটিক, রিয়েল এস্টেট, ব্যাঙ্ক, ট্যুরিজম— তারাও আসে, এমনকি পুরোহিত বা ঢাকিও এসেছেন। এত বাঙালিকে একসঙ্গে পাওয়ার সুযোগ আর কখনই বা হয়? মা দুর্গার আগমনে বাণিজ্যলক্ষ্মী ঝমঝম করে নেচে ওঠেন। দুই দেশের মধ্যে লেনদেন হয় নানা ভাবে! কলকাতার ফ্লাইট শিডিউল একদম টাইট থাকে। কিন্তু এবার? উড়ান চলেনি প্রায় আট মাস। তাই লন্ডনে ইনার সিটিতে বন্ধ হয়েছে হাজারো হোটেল, রেস্তরাঁ। লোকজন এখনো ওয়ার্ক ফ্রম হোম করছে। তাই ইনার সিটি এখন ভূতের শহর হয়ে গেছে। বাকিংহ্যাম রাজবাড়ির রানির চেঞ্জ অব গার্ড দেখার ভিড়ও নেই। ঘরে বাইরে ছ’জনের বেশি একসঙ্গে কাউকে দেখা গেলেই নগর কোটালের চর ধরে কেস দিয়ে দেবে। আর এই কোভিড সংক্রান্ত আইন না মানার শাস্তি কিন্তু বেশ ভয়ানক। অর্ধেক দেশ জুড়ে নানা রকমের লকডাউন। ম্যাঞ্চেস্টারে টায়ার থ্রি, তো ক্রয়ডনে টায়ার টু। কোথাও বা পুরোপুরি লোকালাইজড শাটডাউন। করোনাসুরের দাপাদাপিতে লন্ডন তথা ইংল্যান্ড অতিষ্ঠ। আবার দ্বিতীয় দফায় সংক্রমণ বাড়ছে হু হু করে। এটা ঠিকই যে আগের থেকে মৃত্যুহার একটু কম ,তবু কত মানুষ এই গত কয়মাসে পাড়ি দিয়েছে না ফেরার দেশে, তারা তো আমার আপনার আপনজনই। তা ছাড়া ছ’জনের বেশি একসঙ্গে মেলামেশার সরকারি অনুমতি নেই যে! তাই বেশির ভাগ পুজোই এবার হচ্ছে না। না হয় নমো নমো করে কিছু একটা হচ্ছে। কর্মকর্তারা দুধের সোয়াদ এখন ঘোলে মেটানোর ব্যবস্থা করছেন। জুম, ফেসবুক বা ইউটিউবে এখন সব পুজোরই লাইভস্ট্রিম হচ্ছে। সব থেকে মজার কথা, নামগোত্র দিয়ে পুজো দেওয়াও যাবে। এ যেন সেই ছায়ার সঙ্গে যুদ্ধ, খেলা খেলা পুজো দেওয়া। কম্পিউটার খুললে এবার তিনিও আপনাকে বিলেতের ভার্চুয়াল পুজোয় অঞ্জলি দেওয়াতে পারেন। সে আপনি বার্মিংহ্যামেই থাকুন বা বাঁকুড়াতে। লন্ডনের পুজোতে এবার জয়েন করতে একটা ক্লিকই যথেষ্ট।
ইলিং টাউনহলে লন্ডন শারদোৎসবে মা জননী বড় উদ্ভাবনী । সব সময়ই নতুন কিছু না কিছু নিয়ে আসেন। কখনও তাঁদের মডিউলার দুর্গা, কখনও বিউটি কনটেস্ট কখনও অন্য কিছু সব সময়ই একটা নতুন মাত্রা আনে। এবার ২৪ এবং ২৫- এই দুই দিন শুধু মাত্র নিজেদের মেম্বারদের জন্য পুজো হবে, কোভিড নিয়ম মেনে স্লট বুক করতে হবে আগে থেকে। এই প্রথম ভার্চুয়াল রিয়ালিটিতে দেখা যাবে পূজো, ৩৬০ ডিগ্রিতে থ্রিডি ঠাকুর দেখা হবে। যাদবপুরের কম্পিউটার সায়েন্সের কৃতি ছাত্র সুরঞ্জন যখন দায়িত্বে তখন আর চিন্তা কী? তাই সেলফি নেওয়ার সুযোগ থাকবে ঠাকুরের সঙ্গে নিজের বাড়িতেই। সেজে গুজে শাড়ি গয়না, মেকআপ, লিপস্টিক মেখে (এমনিতে তো মাস্কে ঢাকা) নিজের বাড়িতে ভক্তি ভরে কম্পিউটারের ডালা খুললেই হল। অষ্টমীর অঞ্জলি কিম্বা বেলতলার বোধন। এমনকি ভোগ রান্নাও একেবারে হাতের মুঠোয়। ঘ্রাণেণ অর্ধভোজন না হলেও দর্শনেও কিছু পুণ্য নিশ্চয়ই হয়। অমিয়দা আমাদের বহুদিনের চেনা প্রিয় পুরোহিত এবার এভাবেই করবেন পূজো। পূজোর মন্ত্রের মানে সঙ্গে সঙ্গে বলে দেন অমিয়দা, দ্বিতীয় প্রজন্ম কেন, আমরাও মুগ্ধ হই, ঋদ্ধ হই। সত্যজিত রায়ের একশো বছরে তাঁকে স্মরণ করাটাই এবার এখানে থিম। তাই ‘রে অব হোপ’ নামের আবির্ভাব। অতিমারির শেষ কি তবে দেখা যাচ্ছে? সেই আশাতেই এই নামের সৃষ্টি। নাচ গান আবৃত্তির ডিজিটাল সাংষ্কৃতিক অনুষ্ঠানের সঙ্গে সঙ্গে লন্ডন শারদোৎসবের দ্বিতীয় প্রজন্ম সম্মান জানাবে ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিসের প্রথম সারির কোভিড কি ওয়ার্কারদের। দ্বিতীয় প্রজন্ম মানুষের মতো মানুষ হোক, এটাই আশীর্বাদ করুন আপনারা। শিকড় চিনুক ওরা। বিশ্ব নাগরিক হোক, তবু দেশের গান, দেশের মানুষ, ইতিহাস জানুক । মানুষে মানুষে ভেদাভেদ যেন না শেখে পরবর্তী প্রজন্ম। ধর্ম বর্ণ সব তুচ্ছ হয়ে শুধু মানবতার মন্ত্রে দীক্ষা পাক।
লন্ডনে একটু ঘুরে নিই চলুন। সাউথ লন্ডনে ইউকে হিন্দু কালচারাল অর্গানাইজেশানের ভার্চুয়াল পূজোয় সবার নিমন্ত্রণ। শারীরিক দূরত্ত্ব থাক কিন্তু সামাজিক নয়, এই শব্দবন্ধে ভরসা রেখে এবার সেখানেও মা আসছেন। শুক্র শনি রবি— এই তিন দিনে পুজো ভোগ পুষ্পাঞ্জলি সবই আছে কিন্তু দশমী পুজোর পর প্রোগ্রাম শেষ। কর্মকর্তাদের কাছে অনুরোধ, ভার্চুয়াল সিঁদুর খেলার একটু ব্যবস্থা করে দিন দাদা। সম্বচ্ছরে এই তো মাত্র একটা দিন! সেই দোলের খেলা অর্ধেক বাকি রেখে যে লক ডাউন করে দিলেন, তার পর তো আবার এই তাও তো সত্যি সত্যি চাইছি না। খেলা খেলা সারাবেলা– আপনমনে ভার্চুয়ালি দধিকর্মা মাখা হোক, ভার্চুয়ালি সিংহের মুখে সন্দেশ দেওয়া হোক, ভার্চুয়ালিই না হয় কার্তিকের কপালে সিঁদুর দেওয়ার ব্যবস্থা করে দিন দাদা। এই তো একটি বার। বিলেতের বাঙালির এমন আখাম্বা আবদার রাখার কোন উপায় থাকে কিনা, সেটাই ভাবা হচ্ছে। কথার মধ্যে একটু ঠাট্টার সুর থাকলেও ভারী একটা দীর্ঘশ্বাস লুকিয়ে আছে। প্যাম্পাসের ফুলগুলো একদম কাশফুলেরই মতো, হেমন্তের আকাশে পেঁজাতুলোর মতো মেঘ , কাশফুলের ঝাড় মনে করাচ্ছে, মা আসছেন। করোনার আবহে দুই দেশেই ভারী বিপর্যয় হয়েছে, হাজার হাজার মানুষ মারা গেছেন, তার চেয়েও বেশি মানুষ চাকরি খুইয়েছেন, মাইনে কাটা গিয়েছে অথবা অনাহারে বিনা চিকিৎসায় কষ্ট পেয়েছেন। দুঃখীদের মধ্যে আমরা সবাই আছি, এনএইচএস কিওয়ার্কার্স যেমন আছে, তেমন আছে মাইলের পর মাইল হাঁটতে থাকা পরিযায়ী শ্রমিক। কোভিড কোথাও এসে ধনী দরিদ্র নামী অনামী ক্ষমতাবান অথবা দুর্বল সকলকে এক করে দিয়েছে। এ গ্রেট ইকোয়ালাইজার– কে যেন বলেছিল।
আরও পড়ুন: স্যান অ্যান্টোনিও, টেক্সাসের এ বছরের আকর্ষণ অনলাইনে পুজোর আমেজ
স্লাও শহরের বাঙালি সংগঠন ‘আড্ডা’ আগের বছর প্রথম মাঠের মধ্যে প্যান্ডেল করেছিল। এবার শুধু ঘট পুজো সেখানে। যদিও আসন্ন পুজোপর্বে সাহিত্য গান বাজনা নাটক নিয়ে নিত্য আড্ডার আসর বসবে ভার্চুয়ালি, তা ছাড়াও চন্দ্রবিন্দু বাংলা ব্যান্ডের ওয়ার্লড ওয়াইড কনসার্ট নিয়ে তারা ভারী ব্যস্ত রয়েছে আজকাল। ফিনল্যান্ডের বেঙ্গলি ক্লাব এছাড়াও আরো কিছু সংগঠন হাত মিলিয়েছে এই অনুষ্ঠানে। সবাই মিলে আড্ডা-র সদস্যরা কাজ করছে অনেক। আমফানের দুর্যোগের সময় আড্ডার সহযোগী ভলান্টিয়াররা পৌঁছে গিয়েছিলেন সুন্দরবনে, সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন সযত্নে।
আরও পড়ুন: লন্ডনের শারদোৎসবে ‘আশার আলো’, উৎসর্গ সত্যজিৎকে
বন্ধ হয়েছে মিচ্যামের সাউথ লন্ডন দুর্গাপুজো, ক্রয়ডনের ‘স্পন্দন’, গ্লাসগোর ‘বঙ্গীয় সাংষ্কৃতিক পরিষদ’ ইত্যাদির পুজো। আরও অনেক পুজো হয় অনলাইনে, না হয় নমো নমো করে সারা হবে। তাই বাঙালির আজ বড় মন খারাপ। মা দুর্গাকে মনপ্রাণ দিয়ে বরণ করে নেয় প্রতি বছর লন্ডনের বাঙালি তথা ভারতীয়রা। আকাশে বাতাসে এখনও তারই আবাহন, কিন্তু এটাও ঠিক সরকারি বিধিনিষেধ মাথায় রেখে এবারের পুজো হবে আমাদের মানস-পুজো। আর পুজো বাবদ যে অর্থব্যয় হয় তার পুরোটা যাক মানুষের কাজে। মা দুর্গা আমাদের পরীক্ষায় ফেলেছেন– পাশ তো আমরা করবই। সবাই মিলে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy