বৈশাখী মজুমদার
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন ক্ষেত্রে দৃষ্টান্ত তৈরি করেছেন নারীরা। বিশ্ব জুড়ে সাবলীল ভাবে তুলে ধরছেন নিজেদের। উদাহরণ তৈরি করেছেন আগামী প্রজন্মের কাছে। এমনই এক নারী বৈশাখী মজুমদার। যিনি একাধারে সংবাদপাঠিকা, নৃত্যশিল্পী, সফল ক্রীড়াবিদ্। অন্য ধারে এক জন সফল ব্যবসায়ী। তাঁর পথ চলার গল্প বহু নারীর অনুপ্রেরণা।
দুরদর্শনের হাত ধরে কর্মজীবনে প্রবেশ করেন বৈশাখী মজুমদার। সংবাদ উপস্থাপক হিসাবে কাজ করেছেন বহু জাতীয় স্তরের সংবাদমাধ্যমে। তাঁর সংবাদ উপস্থাপনের ভঙ্গিমা এবং কথোপকথন চোখ টেনেছিল বহু দর্শকের। পাশাপাশি, আরও একটি বিষয়ে সাবলীল ভাবে নিজেকে মেলে ধরেছেন বৈশাখী। তা হল নাচ।
ছেলেবেলা থেকেই নাচের শখ ছিল বৈশাখীর। বহু দিন ভারতীয় ধ্রুপদী ওড়িশি নাচের স্বনামধন্য গুরু তথা পদ্মবিভূষণ কেলুচরণ মহাপাত্রের অনুগামী হয়ে থেকেছেন। দীর্ঘ সময় কাটিয়েছেন তাঁর আশ্রমে। তা ছাড়াও তাঁর কালীঘাটের বাড়িতে থেকেও নাচ শিখিয়েছেন বহু বছর। প্রসঙ্গত, সেই সময়েই শখ পরিণত হয় ভালবাসায়। শহর থেকে দেশ, বৈশাখীর নাচ মুগ্ধ করেছে দর্শকদের।
শহর পেরিয়ে দেশে, বিদেশের বহু জায়গায়, আমেরিকা, টরন্টো, এডমন্টন, ভ্যাঙ্কুভার, ক্যালগেরি, স্পিটবার্গ, ক্যানসাস সিটি, হিউস্টন-সহ বিভিন্ন জায়গায় অনুষ্ঠান করেছেন। ‘ওয়ার্ল্ড সামিট ফর সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট’-এ রাষ্ট্রপুঞ্জের প্রতিনিধি হয়ে নাচের অনুষ্ঠান করে প্রভূত প্রশংসা কুড়িয়েছেন বৈশাখী। তাঁর নাচে মুগ্ধ হয়ে মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী ‘ওয়ার্ল্ড ইউথ অ্যাওয়ার্ড’-এর আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। সেই খবর বিভিন্ন গণমাধ্যমের শিরোনাম দখল করেছিল। অনুপ জালোটাকে নিয়ে বহু নৃত্যনাট্যও প্রযোজনা করেছেন তিনি। এর মধ্যে দু’টি নৃত্যনাট্য— ‘মুরলিয়া বাজে’, ‘হে কৃষ্ণ’ মঞ্চস্থ হলে দেশ, বিদেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মানুষ উপস্থিত হয়েছিলেন। পঙ্কজ উদাসের সঙ্গেও একটি অনুষ্ঠান করার কথা ছিল বৈশাখীর। কিন্তু পঙ্কজ উদাসের প্রয়াণের কারণে তা আর হয়ে ওঠেনি।
বৈশাখীর এই কৃতিত্বের ভারে ভারী হয়েছে তাঁর পুরস্কারের ঝুলি। নৃত্যকলায় অসামান্য পারদর্শিতার জন্য ১৯৯৫ সালে উত্তম কুমার পুরস্কার পান তিনি। রয়েছে একাধিক বর্ষসেরা নৃত্যশিল্পীর খেতাব। বাংলাদেশ জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশন থেকে পেয়েছেন ‘সংবাদ পত্রিকা’ অ্যাওয়ার্ড। রয়েছে টিওওয়াইপি অর্থাৎ আউটস্ট্যান্ডিং ইয়ং পার্সন অফ ইন্ডিয়ার খেতাবও। নানা পুরস্কারের দ্যুতিতে সেই তালিকা সমুজ্জ্বল।
১৯৯৫ সালে শিক্ষার্থীদের অনুরোধেই একটি নাচের স্কুল খোলেন তিনি। বলা বাহুল্য, সেই সময়ে তিনি নিজেও এক জন শিক্ষার্থীই ছিলেন। ধীরে ধীরে সেই স্কুল বড় হতে থাকে। হাওড়া ও দিল্লিতে শাখাও খোলা হয়। তাঁর স্বামী যখন চাকরি সূত্রে বিদেশ চলে যান, সেই সময়ে নাচ থেকে কিছু দিনের বিরতি নিয়েছিলেন বৈশাখী। সেই সময়ে যাঁর দায়িত্বে নাচের স্কুলটি ছেড়ে এসেছিলেন, তিনি ঠিক মতো ক্লাস নিতেন না। ফলে শিষ্য সংখ্যা কমতে থাকে। অতিমারির সময়ে কিছু ক্লাস অনলাইনে নিতেন বৈশাখী।
নাচ, বা টেলিভিশনের অনেক আগে স্কুল জীবনেও জনপ্রিয় শো ‘চিচিং ফাঁক’-এ সঞ্চালনা করেছেন তিনি। খেলাধুলার জগতেও সমান পারদর্শী বৈশাখী। রাইফেল শ্যুটিংয়ে ৮-৯টি জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপে অংশ নিয়েছেন তিনি। ১৯৯৫ সালে অলিম্পিয়ান জয়দীপ কর্মকারের সঙ্গে তিনি জাতীয় স্তরে রেকর্ডও করেন। যে খবর বিভিন্ন সংবাদপত্রের পাতা দখল করেছিল। তা ছাড়াও রাজ্য স্তরে বহু সোনা ও রুপো জিতেছেন তিনি।
কথার মধ্যেই বৈশাখী প্রসঙ্গ টানলেন বাবার। বড় হয়ে ওঠার গল্পের বেশির ভাগটা জুড়েই রয়েছেন তাঁর বাবা রথীন মজুমদার। আসলে বাবার হাত ধরেই বাংলা সংস্কৃতির প্রতি ভালবাসা জন্মায় বৈশাখীর। রথীনবাবু সরাসরি যুক্ত ছিলেন চলচ্চিত্র নির্মাণ-সহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক চর্চার সঙ্গে। ফলে ছোট থেকেই সেই ধারাতেই বয়েছিলেন বৈশাখী। ‘বিয়ের ফুল’ ছবির বেশ কিছু দৃশ্যেও অভিনয় করেছেন। বাড়িতে যাতায়াত ছিল প্রভাত রায়, বীরেশ চট্টোপাধ্যায়ের মতো প্রবাদপ্রতিম চলচ্চিত্রকারদের। তবে বাবার প্রযোজনায় কোনও ছবিতে কখনও অভিনয় করা হয়নি। কারণ বাবার মত ছিল না। কিন্তু সংস্কৃতি ছিল তাঁর রক্তে। তাই বৈশাখী যখন কর্মজগতে প্রবেশ করেন, তিনিও খুব কম সময়ে সফলতার মুখ দেখেন।
তবে, সময় থেমে থাকে না। এগিয়ে চলে নিজের মতো করে। সংস্কৃতির সেই ধারাকে অব্যাহত রেখেই বৈশাখী শুরু করেছিলেন তাঁর ব্যবসা। ইচ্ছেটা যে বৈশাখীর মনে বহু দিন ধরেই ছিল, তা তিনি নিজেও স্বীকার করে নিয়েছেন। আর এই ব্যবসাতেও সফল তিনি। তাঁর ব্যুটিক ‘জ্যাসপার বাই বৈশাখী’র নাম ইতিমধ্যে হয়তো অনেকেই শুনেছেন। গ্রাহকদের সমস্ত প্রয়োজনীয়তার কথা মাথায় রেখেই বিভিন্ন ধরনের নকশা তৈরি করা হয় এখানে। নাচের জগৎ এবং সংবাদমাধ্যমে বহু দিন কাজ করার ফলে গ্ল্যামার ইন্ডাস্ট্রিকে খুব কাছ থেকে দেখেছেন বৈশাখী। ফলে তাঁর কাছে প্রথম থেকেই পরিষ্কার ছিল যে বাজারচলতি পণ্যগুলির মধ্যে আধুনিক ফ্যাশনের কোন কোন বিষয়ে এখনও খামতি থেকে গিয়েছে। এবং বলা বাহুল্য, প্রথাগত ধারণা থেকে বেরিয়ে এসে তাঁর ব্যুটিকের নকশায় সেই বিষয়গুলিকেই ফুটিয়ে তুলেছেন বৈশাখী। নিয়ে এসেছেন নতুন নতুন কাজ। যা সাদরে গ্রহণ করেছেন সাধারণ মানুষ। বেনারসি থেকে পৈঠানি — ভারতীয় ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত বিভিন্ন শাড়ি রয়েছে তাঁর সংগ্রহে।
প্রাথমিক পর্বে অতিমারির সময়ে অনলাইন প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে ব্যুটিকের ব্যবসা শুরু করেন বৈশাখী। খুব কম সময়ের মধ্যে জনপ্রিয়তার শিখর ছুঁয়ে ফেলেছে তাঁর এই উদ্যোগ। গ্রহণযোগ্যতা বেড়েছে বিদেশের মাটিতেও।
একটা বিষয় লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, বৈশাখী মজুমদার জীবনে প্রতিটি স্তরেই সফল হতে পেরেছেন। পাশাপাশি, তিনি জাতীয় স্তরের রাইফেল শ্যুটারও। এক কথায়, যাকে বলা চলে রঙিন জীবন। এই প্রসঙ্গে বৈশাখী জানাচ্ছেন, “কাজের মাধ্যমেই আমি নিজের মতো করে বিভিন্ন সম্ভাবনাগুলিকে ফুটিয়ে তুলেছি। ডিজিটাল মাধ্যম ছড়িয়ে পড়ার ফলে যে ভাবে বিশ্বব্যাপী যোগাযোগ ব্যবস্থা বৃদ্ধি পেয়েছে, তা আমার এই ব্যবসাকে ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে সাহায্য করেছে। চেষ্টা করছি আগামী দিনে এই ব্যবসাকে যাতে এক অন্য স্তরে নিয়ে যেতে পারি।”
আরও অপরাজিতাদের গল্প জানতে ক্লিক করুন —অপরাজিতা ২০২৩
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy