ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা মিলেছে বলে দাবি তালিবানের। —ফাইল চিত্র।
কাবুল দখল করার পর তেরাত্তির পার। এখনও পর্যন্ত মসনদের মুখ ঠিক করতে না পারলেও, ‘তালিবানি আফগানিস্তান’ নিয়ে মানুষের মনে আশার সঞ্চার করতে নেমে পড়েছেন তালিব নেতারা। আন্তর্জাতিক মহলে নিজেদের মূলস্রোতের রাজনীতিক হিসেবে তুলে ধরতেও চেষ্টায় কসুর করছেন না তাঁরা। তার জন্য নয়ের দশকের তালিবানের থেকে নিজেদের আলাদা করতেও পিছপা হচ্ছেন না বর্তমান নেতৃত্ব। কিন্তু আফগানিস্তানে তালিবান শাসনের আসন্ন দ্বিতীয় অধ্যায় কি আগের চেয়ে আলাদা হবে? মুখে যা বলছেন তালিবান নেতৃত্ব তার সিকিভাগও কি কার্যকর করে দেখাতে পারবেন? সংশয় কাটছে না।
আধুনিক সমরাস্ত্রে প্রশিক্ষিত বাহিনী, সর্বোপরি আমেরিকার নজরদারি। এত কিছু সত্ত্বেও তালিবান ফের মাথা তুলে দাঁড়াল কী ভাবে তা নিয়ে কাটাছেঁড়া চলছে বিশ্বের সর্বত্র। কিন্তু একেবারে মুছে যাওয়া অবস্থা থেকে ২০ বছর পর শক্তি বাড়িয়ে তাদের এই ফিরে আসাটা যে রাতারাতি হয়নি সে ব্যাপারে একমত সকলেই। কিন্তু ক্ষমতা দখল আর রাষ্ট্র পরিচালনা, দুটোর মধ্যে বিস্তর ফারাক। আর তাতেই প্রশাসক হিসেবে তাদের পরবর্তী কৌশল নিয়ে কৌতূহল দেখা দিয়েছে।
আফগানিস্তানে তালিবানি শাসনের পরবর্তী অধ্যায় কেমন হতে চলেছে, তা নিয়ে সংগঠনের নেতৃত্ব ইতিমধ্যেই একাধিক পরিকল্পনার কথা জানিয়েছে। কিন্তু এখনও সরকারের মুখ কে হবেন সেটাই ঠিক করতে পারেননি তাঁরা। কখনও পরবর্তী প্রেসিডেন্ট হিসেবে মোল্লা আবদুল গনি বরাদরের নাম উঠে আসছে। কখনও আবার পূর্বতন সরকারের অভ্যন্তরীণ বিষয়ক মন্ত্রী আলি আহমদ জালালির সঙ্গে বোঝাপড়ার কথা শোনা যাচ্ছে। শীঘ্র এ নিয়ে সিদ্ধান্তে পৌঁছনো না গেলে সংগঠনের অন্দরেই বিশৃঙ্খলা তৈরি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
২০ বছর পর প্রত্যাবর্তন। —ফাইল চিত্র।
আবার সরকারের মুখ ঠিক করা গেলেও গোটা দেশের উপর কতটা নিয়ন্ত্রণ থাকবে তালিবানের তা নিয়েও অনিশ্চয়তা রয়েছে। রক্ষণশীল মানুষের সংখ্যা যে সমস্ত এলাকায় বেশি, সেখানে শরিয়ত আইন চালু করতে অসুবিধে হওয়ার কথা নয় তাদের। কিন্তু শহর এবং শহরতলি, যেখানে আধুনিক মানসিকতার জনসংখ্যা তুলনামূলক বেশি, সেখানে তাদের শরিয়ত আইন খাটবে কি না সন্দেহের অবকাশ রয়েছে যথেষ্ট।
আফগান রাজনীতিতে গ্রাম বনাম শহরের তত্ত্ব সে ভাবে চালু নেই। কিন্তু বিগত ২০ বছরে শহুরে জীবনেই অভ্যস্ত আফগানবাসীর একটা বড় অংশ। বহির্বিশ্বের অনুদানে তাঁদের জীবনযাত্রার মান পাল্টে গিয়েছিল। নিরাপত্তার আশ্বাস ছিল। অবাধে রাস্তায় বেরনো, সরকারি-বেসরকারি চাকরি, শিক্ষা এবং নানাবিধ সামাজিক অধিকার এবং স্বাধীনতা পেয়েছিলেন। তালিবানের মানসিকতার থেকে তাঁদের মানসিকতা অনেকটাই আলাদা। সে ক্ষেত্রে রাতারাতি শরিয়তি আইন চাপিয়ে দিতে গেলেও বন্দুকের নলের মুখে তা আদৌ দীর্ঘস্থায়ী হবে কি না সন্দেহ থাকছে।
তালিবান নেতাদের কথায় এখনও পর্যন্ত যে ইঙ্গিত মিলেছে, তাতে গোটা দেশের প্রশাসনিক লাগাম কাবুলে পরবর্তী প্রেসিডেন্ট ভবনের হাতেই থাকবে বলে মনে করছেন কূটনীতিকরা। কিন্তু অর্থনীতি ধরে রাখার ক্ষেত্রে বিদেশি অনুদানের প্রয়োজন পড়বে তাদের। কারণ ওই অনুদানের টাকা থেকেই বর্তমানে শিক্ষা, স্বাস্থ্য-সহ জনকল্যাণমূলক পরিষেবা পান দেশের ৮০ শতাংশ নাগরিক। তাই অন্য রাষ্ট্র এবং রাষ্ট্রপুঞ্জের মতো সংগঠনের কাছে বৈধতা পেতে আগ্রাসন এবং কট্টরপন্থা থেকে সরে এসে তালিবানকে সুর নরম করতে হবে। ইতিমধ্যে তার ইঙ্গিতও মিলেছে। শরিয়তি আইন মেনে মহিলাদের সামাজিক সুযোগ-সুবিধার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তালিবান নেতৃত্ব।
রক্তমাখা ইতিহাস ফেলে এগিয়ে যাওয়ার বার্তা তালিবান মুখপাত্র জবিহুল্লা মুজাহিদের। ছবি: পিটিআই।
রবিবার গনি সরকারের পতনের পর থেকে বহু আফগান নাগরিকই দেশ ছেড়ে পালাতে উদ্যত হয়েছেন। যেতে চাইলে কাউকে বাধা দেওয়া হবে না বলেও জানিয়েছেন তালিবান নেতৃত্ব। কিন্তু সামনে অনিশ্চয়তা অপেক্ষা করছে জেনেও দেশের একটা বড় অংশের মানুষ এখনও আফগানিস্তানেই রয়েছেন। তাঁদের মধ্যে তালিবানকে নিয়ে অবস্থানও ভিন্ন। পূর্বতন সরকারের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগে সরব একাংশ। তাঁদের দাবি, বিদেশ থেকে কোটি কোটি টাকার অনুদান এলেও, মন্ত্রী-আমলাদের পেরিয়ে তা তাঁদের হাতে এসেই পৌঁছয়নি। তাই তালিবানের পুনরুত্থানকে সমর্থন করছেন তাঁরা।
অন্য দিকে, তালিবানের সঙ্গে ঝামেলায় যেতে চান না সে দেশের মধ্যবিত্তদের একটা বড় অংশ। বরং তালিবান কর্তৃত্ব মেনে নিয়ে পরিবার নিয়ে বেঁচে থাকাতেই সন্তুষ্ট তাঁরা। কিন্তু যে সব এলাকা মূলত আর্থিক ভাবে সম্পন্ন, সেখানে আবার অন্য ছবি দেখা গিয়েছে। আমেরিকার ‘দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস’-এর একটি রিপোর্ট অনুযায়ী দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা কাটুক না কাটুক অর্থনৈতিক নিরাপত্তার গুরুত্ব ঢের আগে বুঝে ফেলেছিলেন দেশের একটি অংশের মানুষ। সেই অর্থের বলেই এখন তালিবানের সঙ্গে দরাদরিতে নেমেছেন তাঁরা। পাল্টা চাপ দিচ্ছেন, যাতে অন্যত্র শরিয়ত আইন চালু হলেও, তাঁদের বিধিনিষেধের শিকল পরতে না হয়।
তালিবানও এই দরাদরি মানতে বাধ্য হয়েছে বেশ কিছু জায়গায়। রবিবার কাবুল দখল হয়ে যাওয়ার পরেও কুন্দুজ প্রদেশের অধিকাংশ জেলাতেই ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত মেয়েদের প্রাথমিক স্কুলগুলি খোলাই রয়েছে। শিক্ষক-শিক্ষিকা থেকে স্কুলের সমস্ত কর্মী মহিলা হলে মেয়েরা স্কুলে যেতে পারে বেশ কিছু জেলায় এমন নির্দেশিকাও গিয়েছে তালিবান থেকে। হেলমন্দে যদিও পরিস্থিতি উল্টো। তালিবানি নিষেধাজ্ঞা না থাকলেও, ঋতুমতী মেয়েদের অনেক পরিবার নিজে থেকেই স্কুলে পাঠানো বন্ধ করে দিয়েছে। স্থানীয় মানবাধিকার কর্মীদের দাবি, হেলমন্দে একাধিক অনগ্রসর উপজাতি শ্রেণিরও বাস। সেই সব শ্রেণির মোড়লরাই মেয়েদের স্কুলে পাঠানোর বিপক্ষে।
ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি রুখতে পারবে তালিবান? অনিশ্চয়তা। —ফাইল চিত্র।
মসনদে কে বসবেন সেই সিদ্ধান্ত এখনও ঝুলে থাকলেও একাধিক জায়গায় সরকারি কাজকর্মের গতি ফেরাতেও ইতিমধ্যে উদ্যোগী হয়েছে তালিবান। কুন্দুজে সরকারি কর্মীদের কাজে ফিরতে বলা হয়েছে। যদিও গজনিতে পূর্বতন সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকা একাধিক আধিকারিকের শাস্তি নির্ধারণ করা হচ্ছে। সেখানে আফগান সেনা এবং পূর্বতন সরকারের বিভিন্ন দফতরে হামলাও চালিয়েছে তালিবান। তাই তালিবানের প্রতিশোধস্পৃহা নিয়েও আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। যদিও রবিবার বিবিসি-কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে সংগঠনের মুখপাত্র সুহেল শাহিন বলেন, ‘‘আমরা মানুষের দাস। দেশের সেবা করতে চাই। আফগান নাগরিক, বিশেষ করে কাবুলের বাসিন্দাদের বলব নিশ্চিন্তে থাকুন। আপনাদের জীবন এবং সম্পত্তি সুরক্ষিত থাকবে। কারও উপর কোনও প্রতিশোধ মেটানো হবে না।’’
তবে তালিবান নেতৃত্ব দেশবাসীকে আশ্বস্ত করলেও মাঠে-ময়দানে তাঁদের যে যোদ্ধারা রয়েছেন তাঁদের সঙ্গে সংগঠনের নেতৃত্বের কোনও সংযোগ যে নেই তা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। কারণ এক দিকে দলীয় নেতৃত্ব যখন দেশবাসীকে আশ্বস্ত করছেন, ওই একই সময়ে প্রাক্তন সরকারি আধিকারিকদের উপর লাগাতার হামলার ঘটনা সামনে আসছে। আফগানিস্তানে গনি সরকারের নারী অধিকার সংক্রান্ত নজরদারি সংস্থার কর্মী হেদার বারের বক্তব্য, এর অন্যতম কারণ হল, তরুণ তুর্কিদের যুদ্ধজয়ের কাজে লাগানো হয়েছে। এঁদের অনেকের বয়স এখনও ২০ পেরোয়নি। সংগঠনের হয়ে শুধু লুঠপাট, খুনখারাপি চালিয়ে যাওয়াই কর্তব্য বলে মনে করে তারা। সরকার চালানোর জন্য তালিবানের নতুন ভাবমূর্তি গড়ার প্রচেষ্টার সঙ্গে কোনও সম্পর্ক নেই তাদের।
হেদার বারের কথায়, ‘‘গত কয়েক দিন ধরে চোখের সামনে যা ঘটছে, নয়ের দশক থেকে তাকে আলাদা করতে পারিনি এখনও। তালিবান ২.০ বলে কিছু এখনও চোখে পড়েনি। আগের তালিবানের সঙ্গে এই তালিবানের আদৌ কোনও ফারাক রয়েছে কি না, তা তখনই বোঝা যাবে, যখন বিরুদ্ধমত পোষণকারীদের সঙ্গে নিয়েই সরকার চালাতে পারবে ওরা।’’
হেদারের সঙ্গে একমত বেশির ভাগ কূটনীতিক বিশেষজ্ঞ। আগের তালিবানের চেয়ে এই তালিবান যদি বেশি বাস্তববাদী হয় তবেই রক্ষে আফগানিস্তানের। অন্য রাষ্ট্রের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখা, বহির্বিশ্ব থেকে অনুদান আসার রাস্তা তৈরি করতে পারলে আফগানিস্তানও বাঁচবে, বাঁচবে তালিবানও। তবে তালিবান যে ভাবেই সরকার চালাক পশ্চিমি দেশগুলিকে সন্ত্রাসদমন, মানবাধিকার রক্ষা নিয়ে তাদের উপর চাপ বাড়িয়ে যেতে হবে। তা না করে তালিবানের নিয়ন্ত্রণে থাকা আফগানিস্তানকে একঘরে করে দিলে, আশেপাশের দেশগুলির নিরাপত্তাও বিঘ্নিত হবে বলে মত কূটনীতিকদের।