স্লাওয়ের কালীপুজো। নিজস্ব চিত্র।
স্বদেশ ছাড়লেও বাঙালি আড্ডা ছাড়তে পারে না, ছাড়তে পারে না খেলাধুলোও। যেমনটা ছাড়তে পারেননি লন্ডনের কাছে স্লাও শহরের জনা পাঁচেক বাঙালি। ২০০৬ থেকে ২০১০ এর মধ্যে বিভিন্ন সময়ে এই শহরে এসেছিলেন তাঁরা। প্রাথমিক ভাবে সপ্তাহান্তে দেখাসাক্ষাৎ, খেলাধুলো করে সময় কাটানোর পরে এক দিন তাঁদের মনে হল— একটি সংগঠন তৈরি করলে কেমন হয়। বিদেশের মাটিতে মাতৃভাষায় আড্ডা দেওয়ার সুযোগটা তা হলে আরও পাকাপোক্ত করা যাবে। সেই ধারণা থেকেই ২০১২ সালে তৈরি হয় আমাদের ‘আড্ডা’।
বিদেশের মাটিতে অনেক বাঙালি সংগঠনই ধুমধাম করে দুর্গাপুজো করে। কিন্তু আমাদের সংগঠন শুরু করে প্রথমে সরস্বতী পুজো, আর তার পরেই কালীপুজো দিয়ে। ২০১২ সালে ক্লাবে প্রথম শুরু হয় সরস্বতী পুজো। বিপুল সাড়া পেয়েছিলাম স্থানীয় বাঙালি ও সংগঠনের সদস্যদের মধ্যে থেকে। তার পরে ২০১৬ সালে পরিকল্পনা করা হয় কালীপুজোর। সে বছরই কুমোরটুলি থেকে প্রতিমা আনা হয়। প্রথম বছরের কালীপুজোয় স্থানীয়দের কাছ থেকে সাড়া পাওয়ার পরে আমরা সিদ্ধান্ত নিই, এই পুজো চালিয়ে যেতে হবে। এই ভাবনার পিছনে একটা কারণ হল, তখন লন্ডন বা তার আশপাশের শহরগুলিতে বেশ কয়েকটি দুর্গাপুজো হলেও কালীপুজো সে ভাবে হত না। পরে অবশ্য ২০১৯ সালে দুর্গাপুজোও শুরু করি আমরা। তবে এখনও পর্যন্ত স্লাও শহরে শুধু আমরাই কালীপুজো করি।
গত কাল হয়ে গেল ‘আড্ডা’র কালীপুজো। সাধারণত আমরা পুজোর কাছাকাছি সপ্তাহান্তে পুজো করার চেষ্টা করি। আমাদের সংগঠনের সদস্য ৩২টি পরিবার। সকলে মিলে হাতে-হাতে সাজিয়ে তুলেছি মণ্ডপ। ঢাক কেনা হয়েছে আমাদের, সকলে মিলে পালা করে ঢাক বাজাই। পুরোহিতও আমাদের মতো প্রবাসী। ‘আড্ডা’র পুজোর অন্যতম আকর্ষণ ‘আড্ডা গেট অব জয়’, তাতে এ বারের থিম পুরুলিয়ার ছৌ নাচের মুখোশ, শান্তিনিকেতনের শোলার কদমফুল, পিংলা নয়াগ্রামের পটচিত্র ও সরা। দক্ষিণ দিনাজপুরের কুশমণ্ডি থেকে বাঁশের মুখোশও আনা হয়েছে। মূলত, বাংলার শিল্পকে আন্তর্জাতিক মঞ্চে তুলে ধরতেই এই প্রচেষ্টা। এ বছর ‘আড্ডা’র দশ বছর পূর্ণ হচ্ছে। তাই সারা বছর ধরে দশটি বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। কালীপুজো তার মধ্যে অন্যতম।
পুজোর দিন সকাল থেকেই স্লাও ক্রিকেট মাঠে শুরু হয়ে গিয়েছে আয়োজন। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও বাঙালি ভোজের আয়োজন আমাদের পুজোর অন্যতম আকর্ষণ। এ বারের মেনুতে ছিল ‘নিরামিষ’ মাংস, গুড়ের রসগোল্লা, পায়েস ও সন্দেশ। স্থানীয় কাউন্সিলের অনুমতি নিয়ে দৃষ্টিনন্দন আতশবাজি প্রদর্শনীরও আয়োজন করা হয়েছিল। সাধারণত বিদেশের পুজোগুলি কমিউনিটি হলে আয়োজিত হয়, কিন্তু স্লাও ক্রিকেট ক্লাবের মাঠের পাশে খোলা জায়গায় মণ্ডপ বেঁধে আয়োজন হয় ‘আড্ডা’র কালীপুজো। মণ্ডপটি আসলে একটি বিশাল আকারের তাঁবু। তার মধ্যেই হয় যাবতীয় আয়োজন। যে-হেতু এই সময় বেশ ঠান্ডা পড়ে তাই হিটিং সিস্টেম চালু রেখে গরম রাখা হয় তাঁবু। পুজো, বাজি ফাটানো, খাওয়াদাওয়া, আড্ডা— সব মিলিয়ে এ বার জমজমাট ছিল আমাদের আনন্দ-উদ্যাপন।