—ফাইল চিত্র।
যে মা তাঁকে যৌন ব্যবসায় নামিয়েছিল, ১৫ বছরের শরীরে অনেক আঘাত নিয়ে যে মায়ের কাছে কেঁদেও লাভ হয়নি, তাকে ক্ষমা করে দিতে চান অহনা (নাম পরিবর্তিত)।
প্রথমে তাঁকে এবং পরে তাঁর সৎবোনকে যৌন ব্যবসায় নামানো মায়ের বিরুদ্ধে এর আগে মামলা করেছেন অহনা। আদালতে গিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে সাক্ষ্য দিয়েছেন দিনের পর দিন। মা এখন জেলে। তবু ১৮ বছরের তরুণী অহনার কথায়, ‘‘সংশোধনাগারে মায়ের সংশোধন হবে বলে পথ চেয়ে বসে আছি। মা ভুল বুঝতে পারবে। তখন আমি, বোন, ভাই আর মা একসঙ্গে থাকব।’’
প্রথমে হোমে ছিলেন। এখন হস্টেলে। সেলাই শিখিয়ে যে-টাকা পান, তা দিয়ে নিজের খরচ চালাচ্ছেন অহনা। হোমে থাকা সৎভাইবোনের সঙ্গে যোগাযোগও রাখছেন। আর পড়াশোনা করছেন মন দিয়ে। জানালেন, অন্ধকার কাটিয়ে আলোর আকাশে উড়তে চান, বিমানসেবিকা হয়ে।
অহনারা দুই বোন। জন্ম খাস কলকাতার এক মধ্যবিত্ত পরিবারে। তবে নিশ্চিন্তির জীবন বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। বাবা-মায়ের মধ্যে তুমুল অশান্তি শুরু হওয়ায় পঞ্চম শ্রেণির পরে অহনার স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়ে যায়। তাঁর কথায়, ‘‘২০০৬ সালে দিদির বিয়ের পরে এক দিন এক কাপড়ে মা বেরিয়ে আসে, আমাকে নিয়ে। বাবা মারা যান বছর কয়েক পরে।’’
অহনা জানান, মায়ের দ্বিতীয় বিয়ে হয় কলকাতার একটি ক্যাফের ম্যানেজারের সঙ্গে। জন্ম হয় এক ছেলে, এক মেয়ের। এর মধ্যে ২০০৯ সালে অহনার দিদির মৃত্যু হয়। অশান্তি শুরু হয় মায়ের নতুন সংসারেও। কারণ, মায়ের ভিন্ ধর্মের কারণে সৎবাবার পরিবার তাকে কোনও দিনই মেনে নেয়নি। শেষ পর্যন্ত দক্ষিণ কলকাতায় নিজের মায়ের কাছে গিয়ে থাকতে শুরু করে অহনার মা, তিন সন্তানকে নিয়ে। অহনার দাদু ছিলেন সেনা অফিসার। তাঁর মৃত্যুর পরে পারিবারিক পেনশনে চলত সংসার। অহনার কথায়, ‘‘তখন আমার সৎবাবা-মায়ের কাছ থেকে জোর করে টাকা নিয়ে যেতেন।’’
২০১৫ সাল পর্যন্ত এ ভাবেই চলে যাচ্ছিল। কিন্তু দিদার মৃত্যুর পরে, পারিবারিক পেনশন বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বিপাকে পড়েন অহনারা। মা চাকরি পায় একটি শপিং মলে। কিন্তু সেই
টাকায় দিন চালানো ছিল অসম্ভব। অহনার কথায়, ‘‘মা বদলে যাচ্ছিল। এখন বুঝি, মাকে তখন সাইকায়াট্রিস্ট দেখানোর দরকার ছিল। কিন্তু কে দেখাবে?’’ এরই মধ্যে এক দিন জানবাজারের পিছনে একটি গেস্ট হাউসে ১৫ বছরের অহনাকে নিয়ে যায় মা। সেটা ২০১৭ সাল। কী করতে হবে, বুঝতে পেরে হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল সদ্য কিশোরীটি।
অহনার কথায়, ‘‘অনেক কেঁদেছি। মায়ের কাছে কাকুতিমিনতি করেছি। কিন্তু মা বলেছিল, এটা করতেই হবে। টাকা রোজগার না-করলে সংসার চলবে না।’’ মায়ের চাপে সেই অত্যাচার দিনের পর দিন সহ্য করেছেন তিনি। শেষ পর্যন্ত প্রতিবেশীদের মারফত অহনার কথা জানতে পারে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা— ইন্টারন্যাশনাল জাস্টিস মিশন। ২০১৮ সালে পুলিশকে নিয়ে ওই গেস্ট হাউস থেকে অহনাকে উদ্ধার করা হয়। পাঠানো হয় হোমে। মাকে গ্রেফতার করা হলেও পরে জামিন হয়। অহনা বলেন, ‘‘আমার আশঙ্কা ছিল, ছোট বোনকে একই ভাবে ওই কাজে নামাবে মা। সে-কথা হোম থেকে লিখিত ভাবে শিশু কল্যাণ কমিটি (সিডব্লিউসি)-কে জানাই।’’
ওই স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ২০১৯ সালে পুলিশের সাহায্য নিয়ে অহনার ছোট বোনকে উদ্ধার করে, একই গেস্ট হাউস থেকে। মাকে গ্রেফতার করা হয়। জামিন আর হয়নি। বাড়িতে ১২ বছরের ভাই একা হয়ে যাওয়ায় তাকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় হোমে। শুধু অহনা নয়, তাঁর বোনও মামলা করেছেন মায়ের বিরুদ্ধে। সেই মামলা চলছে।
কাঁদতে কাঁদতে অহনা বলেন, ‘‘আমার মা এমন ছিল না। মা ভাল হয়ে যাবে। আমি বোন আর ভাইকে পড়াব। আমরা সবাই আবার একসঙ্গে ভাল করে বাঁচতে চাই।’’