শুভাপ্রসন্ন কি মমতার ডাক পাবেন? — ফাইল চিত্র।
সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম পর্বে অন্যান্য বিশিষ্টজনের সঙ্গে তৃণমূলের ‘ঘনিষ্ঠ এবং আস্থাভাজন’ হয়েছিলেন প্রবীণ শিল্পী শুভাপ্রসন্ন। সেই সময় থেকে প্রতি বছরই ২১ জুলাই তৃণমূলের ‘শহিদ দিবস’ পালনের মঞ্চে দেখা গিয়েছে তাঁকে। রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে নয়, ‘বিশিষ্টদের’ সারিতে। কিন্তু আগামী শুক্রবারের সমাবেশের মঞ্চেও কি সে ভাবে দেখা যাবে তাঁকে?
শুভাপ্রসন্নকে নিয়ে এমন প্রশ্ন উঠেছে তৃণমূলের অন্দরেই। কারণ, সম্প্রতি পঞ্চায়েত নির্বাচনে হিংসা কেন প্রশ্ন তুলে ফের ‘পরিবর্তন’ চেয়ে মিছিলে হাঁটার কথা শুনিয়েছিলেন শুভাপ্রসন্ন। যদিও ফলঘোষণার পরে তিনি নিজেকে আমূল বদলে ফেলেছেন। তবুও তাঁকে এ বারের ২১ জুলাই দলের তরফে তাঁকে আমন্ত্রণ জানানো হবে কি না, তা নিয়ে কৌতূহল তৈরি হচ্ছে বইকি!
২১ জুলাইয়ের মঞ্চে কোন কোন নেতা থাকবেন, কারা বক্তৃতা করবেন, সবটাই ঠিক করেন তৃণমূলের সর্বময় নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। গুরুত্ব বিচার করে কার পরে কে ভাষণ দেবেন, সেটাও দলের শীর্ষ পর্যায়েই ঠিক হয়। আর বিশিষ্টদের মধ্যে কারা আমন্ত্রণ পাবেন, কে গান গাইবেন, কারা গলা মেলাবেন, তা-ও ঠিক করেন স্বয়ং মমতা। তাই বার বার দলকে ‘অস্বস্তিতে’ ফেলা শুভাপ্রসন্ন মমতার ডাক পাবেন কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন তৃণমূলের অন্দরে। শুভাপ্রসন্ন ‘বেফাঁস’ কিছু বলে ফেললে তৃণমূলের পক্ষে যাঁর উপরে সেটি সামলানোর দায়িত্ব পড়ে সাধারণত, সেই কুণাল ঘোষের বক্তব্য, ‘‘উনি আমন্ত্রণ পাবেন কি না সেটা আমি বলতে পারব না। এটা ঠিক করেন দলনেত্রী।’’
শুভাপ্রসন্ন ‘ডাকলেই যাব’ মনোভাব নিয়ে পা বাড়িয়ে রয়েছেন বলেই মনে করছেন তৃণমূলের নেতারা। এক নেতার কথায়, ‘‘ওঁর মনের কথা এক। আর মুখের কথা আর এক। বোঝা মুশকিল! তবে ডাকলে যে আসবেন সেটা নিশ্চিত।’’ কী বলছেন শুভাপ্রসন্ন? আনন্দবাজার অনলাইনকে সোমবার তিনি বলেন, ‘‘যাব কি না এখন কী করে বলব? এখনও তো অনেক দেরি রয়েছে।’’ দেরি কোথায়? তিন দিন পরেই তো সভা! আমন্ত্রণ পাবেন বলে মনে করছেন? শুভাপ্রসন্ন বলেন, ‘‘আমি কী করে বলব আমন্ত্রণ পাব কি না? আমি তো বিচ্ছিন্ন হইনি!’’
শুভাপ্রসন্ন নিজে ‘বিচ্ছিন্ন’ হয়েছেন বলে মনে না-করলেও ‘বিচ্ছেদজনক’ পরিস্থিতি যে বিভিন্ন সময়ে তৈরি হয়েছে, তা সকলেই জানেন। রাজ্যে ‘দ্য কেরালা স্টোরি’ নিষিদ্ধ করার সরকারি সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেছিলেন তিনি। তখনও ‘অস্বস্তিতে’ পড়েছিল তৃণমূল। তবে শাসকদলের নেতাদের বেশি করে মনে পড়ছে গত ২১ ফেব্রুয়ারির কথা। ঘটনাচক্রে, সেই শেষ বার মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে এক মঞ্চে থাকার সুযোগ পেয়েছিলেন শুভাপ্রসন্ন।
উপলক্ষ্য ছিল ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’। দেশপ্রিয় পার্কে সেই উপলক্ষে রাজ্য সরকারের অনুষ্ঠানে মুখ্যমন্ত্রীর উপস্থিতিতেই শুভাপ্রসন্ন বলেছিলেন, ‘‘বাংলা ভাষার উচ্চারণ, বাংলা ভাষার তাৎপর্য, বাংলার ভাষার বৈশিষ্ট্য থেকে আমরা সরে আসছি। আমরা দেখছি বহু কারণে, নানান সাম্প্রদায়িক ছাপ বাংলা ভাষায় চলে এসেছে।’’ এর পরেই তিনি সটান বলেন, ‘‘যে শব্দগুলোকে আমরা কখনও বাংলা বলি না, ভাবি না, সেই শব্দ এখন বাংলা ভাষায় ঢুকছে। আমরা কোনও দিন বাংলা ভাষায় ‘পানি’ ব্যবহার করি না। আমরা কোনও দিন কখনও ‘দাওয়াত’ দিই না। সুতরাং, ভাবতে হবে কোন ভাষা আমাদের ভাষা।’’
মঞ্চেই শুভাপ্রসন্নের বক্তব্যের বিরোধিতা করেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা স্বয়ং। তিনি বলেন, ‘‘শুভাদা অনেক শ্রদ্ধেয়। কিন্তু শুভাদাকে একটা কথা বলব। দেখুন, কতগুলি শব্দ রয়েছে, যেগুলি সারা বিশ্বের। যেমন ‘মা’ বললে সবাই জানে দু’টি শব্দ রয়েছে। একটা ‘মা’ আর একটা ‘মাদার’। আর একটা শব্দ রয়েছে ‘জল’ বা ‘ওয়াটার’। কিন্তু ওয়াটারকে কেউ কেউ ‘পানি’ বলে। এটা আপনাকে মেনে নিতে হবে। মাকে কেউ ‘আম্মা’ বলে। এটাকে মেনে নিতে হবে। কেউ বারণ করেনি। আমি মা-ও বলব, আমি আম্মাও বলব।’’ মমতা আরও বলেন, ‘‘ওরা অতিথিসেবাকে দাওয়াত বলে। এটা বাংলাদেশের ভাষা। যাঁরা ও পার থেকে এ দেশে এসেছেন, তাঁরা এই ভাষাটাকে গ্রহণ করেছেন। আমি মাতৃভাষাকে চেঞ্জ (বদল) করতে পারি না। যেটা শিখে এসেছে, সেটা চেঞ্জ করবে কী ভাবে।’’
এর পরে ওই মঞ্চে শুভাপ্রসন্ন আর কিছু বলেননি। কিন্তু পরের দিন আনন্দবাজার অনলাইনকে শুভাপ্রসন্ন জানিয়েছিলেন, তিনি যা বলেছেন ভেবেচিন্তেই বলেছেন। বাংলা ভাষায় সাম্প্রদায়িকতা ঢুকছে বলে দাবি করে তিনি বলেছিলেন, ‘‘স্বামী বিবেকানন্দ বলেছিলেন, ঢাকা-শান্তিপুরের ভাষা মিশে কলকাতায় যে ভাষার প্রকাশ সেটাই আসল বাংলা ভাষার প্রকাশভঙ্গি। কিন্তু দিন দিন সেটা বদলে যাচ্ছে।’’ মুখ্যমন্ত্রীর আপত্তি প্রসঙ্গে বলেছিলেন, ‘‘মমতা তো বিষয়টা রাজনৈতিক ভাবে দেখবেন। ওঁর হয়তো মনে হয়েছে, এটা এই ভাবে বললে রাজনৈতিক অসুবিধা রয়েছে। কিন্তু আমার তো আর সেই ভয় নেই!’’ জবাব দিতে গিয়ে কুণাল বলেছিলেন, ‘‘জমি না কমিটির পদ লাগবে, এটা জেনে নিলেই ঝামেলা মিটে যাবে!” যার জবাবে শুভাপ্রসন্ন বলেন, “যাঁদের নিজেদের নানা রকম চাহিদা বা অভাব, তাঁরাই এমন বলে বেড়ান।”
পঞ্চায়েত ভোটের পর শুভাপ্রসন্ন ‘সন্ত্রাস’ এবং ‘হিংসা’ নিয়েও মুখ খুলেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, এই সংস্কৃতি ‘পরিবর্তন’ করার সময় এসেছে। প্রয়োজনে তাঁরা আবার কলকাতার রাজপথে এর বিরুদ্ধে মিছিল করবেন। তবে পঞ্চায়েত ভোটের ফলাফলের পর প্রবীণ শিল্পী অভিমত বদলে ফেলেন। বলেন, ‘‘এত মৃত্যু হয়নি। বাড়িয়ে দেখানো হচ্ছে। মমতা কঠোর হাতে সব নিয়ন্ত্রণ করেছেন।’’
পঞ্চায়েত নির্বাচন নিয়ে বিতর্কের সময়ে শিল্পীর বক্তব্য সম্পর্কে কুণাল বলেছিলেন, ‘‘ওঁর মাঝেমাঝে চুলকোয়। মলম লাগানো উচিত।’’ আর মতবদলের পর বলেছিলেন, ‘‘শুভাদার সুমতি হয়েছে। উনি বোধহয় ‘রামের সুমতি’ পড়ছেন এখন।’’
প্রশ্ন হল, সেই ‘সুমতি’-কে কি ধর্তব্যের মধ্যে আনবেন মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূল নেত্রী? একুশে ফেব্রুয়ারির ‘অভিঘাত’ কি পড়বে একুশে জুলাইয়ের মঞ্চে?