মাধুকরীর চাল-ডালে বাচ্চাদের খাওয়াচ্ছেন স্যর

৫৫ মাস ধরে নিজেই বেতন পাননি প্রতীম। রাজ্য শ্রম দফতরের দাবি, কেন্দ্রীয় শ্রম মন্ত্রকের অনুদান না-আসায় তাঁকে ভাতা দেওয়া যাচ্ছে না।

Advertisement

অনির্বাণ রায়

জলপাইগুড়ি শেষ আপডেট: ১৮ এপ্রিল ২০২০ ০৬:০৬
Share:

জয়ন্তীপাড়ার শিশু শ্রমিক স্কুলে ভাত খাচ্ছে দুই পড়ুয়া। ছবি: সন্দীপ পাল

কাঁধে একটা কাপড়ের ঝোলা। মানুষটি হনহন করে হেঁটে এসে খুললেন ক্লাসঘরের তালা। সেই শব্দে আশপাশের ঘিঞ্জি বস্তি থেকে বেরিয়ে এল রোগাভোগা কচিকাঁচার দল। ‘স্যর এসেছে’ বলে জড়ো হয়ে গেল বারান্দায়। ‘স্যর’ তত ক্ষণে ঝোলা উপুড় করেছেন ক্লাসঘরে। থলি থেকে লাফিয়ে মেঝেতে পড়েছে চাল, আলু, সয়াবিন, ডালের মুখ বাঁধা প্লাস্টিক ব্যাগ। একমুখ হাসি নিয়ে মানুষটি বাচ্চাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘‘এ বার রান্না হবে। আজকের মেনু ভাত, ডাল আর সয়াবিন।’’ হাততালি দিয়ে উঠল খুদের দল। শুক্রবারের বৃষ্টিভেজা সকালে জলপাইগুড়ির জয়ন্তীপাড়ার শিশু শ্রমিক স্কুলে রান্না শুরু হল। বছর পঞ্চাশের প্রতীম চৌধুরী এ ভাবেই পেট ভরাচ্ছেন স্কুলের বাচ্চাদের, আশপাশের কয়েকটি শিশুরও।

Advertisement

অথচ ৫৫ মাস ধরে নিজেই বেতন পাননি প্রতীম। রাজ্য শ্রম দফতরের দাবি, কেন্দ্রীয় শ্রম মন্ত্রকের অনুদান না-আসায় তাঁকে ভাতা দেওয়া যাচ্ছে না। এত দিন ছাত্র পড়িয়ে রোজগার করতেন প্রতীম। লকডাউনে টিউশনও বন্ধ। কিন্তু তাতে বাচ্চাদের জন্য তাঁর চিন্তায় ছেদ পড়েনি। ‘‘এক অর্থে মাধুকরীই করতে হচ্ছে ওদের জন্য,’’ বলছেন তিনি। অপুষ্টিতে ভোগা চেহারা। এখন রোদ হোক বা ঝড়বৃষ্টি, সকালেই বেরিয়ে পড়ছেন প্রতীম। সংসার করেননি বলে পিছুটান তেমন নেই। তাই দিনভর ঘুরতে অসুবিধাও হচ্ছে না, জানালেন নিজেই। সে-ভাবেই এর-ওর দোরে ধর্না দিয়ে ঝোলা ভরে নিয়ে আসছেন চাল-ডাল, সয়াবিন বা অন্য কিছু।

শ্রমিক স্কুলে মোট ৪৩ জন পড়ুয়া। এমনিতে তারা মিড-ডে মিলের খাবার পায়। এখন লকডাউনে রান্না বন্ধ। পরিবর্তে প্রত্যেক পড়ুয়াকে দু’কেজি চাল ও দু’কেজি আলু দিয়েছে রাজ্য সরকার।

Advertisement

আরও পড়ুন: কেন্দ্রের চালে কী হবে, সিদ্ধান্ত ঝুলেই

সব পড়ুয়ার পরিবারেরই দিন-আনি-দিন খাই দশা। তৃতীয় শ্রেণির পড়ুয়া পবনের বাবা রিকশাচালক। লকডাউনে রোজগার বন্ধ। ওই দু’কেজি চাল ও দু’কেজি আলু শেষ হতে চার জনের সংসারে লেগেছে মাত্র দু’দিন। পবনের মতোই তুলসী, পুষ্পা, শুভদের বাড়িতেও একই দশা। কারও মা পরিচারিকার কাজ করেন তো কারও বাবা দিনমজুর। রোজগার কারওই নেই। সব খবরই রাখেন তাদের স্যর। ২৪ মার্চ চাল-আলু বিলির ঠিক তিন দিন পর থেকে তাই তিনি স্কুলে খাওয়ানোর আয়োজন করেছেন। শুধু স্কুলের পড়ুয়ারা নয়, দেখতে দেখতে জুটে যায় আশপাশেরও বেশ কয়েকটি বাচ্চা। তাঁর কথায়, “ছেলেমেয়েগুলোকে আধপেটা খেয়ে থাকতে হত। তা ছাড়া স্কুলে যায় না, এমন অনেকে স্কুলের বারান্দায় এসে ডাল-ভাত খেয়ে যাচ্ছে রোজ। ওদের বাড়িতেও তো রোজগার নেই।”

আরও পড়ুন: আটকে পড়া শ্রমিকদের ‘স্নেহের পরশ’

ছেলেমেয়েদের সঙ্গে আপনিও খেতে বসছেন? কানে হাত দেন প্রতীম। বলেন, “ছি ছি, কী বলছেন। বাচ্চাগুলোকে খাওয়াব বলে চাল-ডাল জোগাড় করে আনছি। সেগুলি আমি খাই কী করে!” ‘খেপা স্যরের’ দুপুরে খাওয়ার ব্যবস্থা করেছেন এলাকার প্রাক্তন কাউন্সিলর নারায়ণচন্দ্র সরকার। রাতে খাওয়াচ্ছেন অন্য এক জন পরিচিত।

(অভূতপূর্ব পরিস্থিতি। স্বভাবতই আপনি নানান ঘটনার সাক্ষী। শেয়ার করুন আমাদের। ঘটনার বিবরণ, ছবি, ভিডিয়ো আমাদের ইমেলে পাঠিয়ে দিন, feedback@abpdigital.in ঠিকানায়। কোন এলাকা, কোন দিন, কোন সময়ের ঘটনা তা জানাতে ভুলবেন না। আপনার নাম এবং ফোন নম্বর অবশ্যই দেবেন। আপনার পাঠানো খবরটি বিবেচিত হলে তা প্রকাশ করা হবে আমাদের ওয়েবসাইটে।)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement