Book Review

বঙ্গসমাজ ও সংস্কৃতির বৈচিত্র অনুসন্ধান

বাকি দু’টি প্রবন্ধের মধ্যে দীপান্বিতা দত্ত এবং শুভায়ু চট্টোপাধ্যায়ের প্রবন্ধ দেখিয়েছে, ঔপনিবেশিক আমলে কণ্ঠস্বর রেকর্ডিংয়ের আবিষ্কার এবং তার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সংযোগ।

Advertisement

কুন্তক চট্টোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১১ জানুয়ারি ২০২৫ ০৫:০৫
Share:

—প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।

ঔপনিবেশিক শাসনে ইংরেজি শিক্ষিত ‘ভদ্রলোক’ শ্রেণির উত্থান হয়েছিল এবং বঙ্গের তথাকথিত ‘রেনেসাঁস’-এর পিছনে এই শ্রেণির অবদান বহুচর্চিত। কিন্তু বাংলার সামাজিক-সাংস্কৃতিক ইতিহাস লেখার ক্ষেত্রে সেই একমুখী ভাবনার সময় বদলে গিয়েছে। বরং উচ্চবর্গীয় এবং নিম্নবর্গীয় সংস্কৃতির দ্বন্দ্ব ও আন্তঃসম্পর্কের বিশ্লেষণেই বাংলার সমাজ-সংস্কৃতির চিত্র ধরা সম্ভব। আলোচ্য বইটি সেই তালিকায় নব সংযোজন। বাংলা এবং বাঙালির এই সমাজ-সংস্কৃতির বৈচিত্র অনুসন্ধানে অগ্রগণ্য ছিলেন অধ্যাপক রমাকান্ত চক্রবর্তী। বইয়ের শুরুতেই সেই স্বীকৃতি দিয়েছেন সম্পাদক। প্রবন্ধকারদের লেখাতেও অধ্যাপক চক্রবর্তীর বিস্তারিত গবেষণার উল্লেখ ফুটে উঠেছে। সম্পাদক অধ্যাপক অচিন্ত্যকুমার দত্ত বইয়ে থাকা প্রবন্ধগুলিকে দু’টি পর্বে ভাগ করেছেন। প্রথম পর্বের শিরোনাম ‘দ্য মেনি ওয়ার্ল্ডস অব বেঙ্গলি কালচার’। দ্বিতীয় পর্বটি ‘আসপেক্টস অব বেঙ্গলি পলিটিক্স, সোসাইটি অ্যান্ড ইকনমি’।

Advertisement

প্রথম পর্বে থাকা সাতটি প্রবন্ধের মধ্যে পাঁচটি বৈষ্ণব ধর্ম সম্পর্কিত। বাকি দু’টি প্রবন্ধের মধ্যে দীপান্বিতা দত্ত এবং শুভায়ু চট্টোপাধ্যায়ের প্রবন্ধ দেখিয়েছে, ঔপনিবেশিক আমলে কণ্ঠস্বর রেকর্ডিংয়ের আবিষ্কার এবং তার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সংযোগ। নতুন রেকর্ডিং প্রযুক্তি কী ভাবে রবীন্দ্রনাথের গান, কবিতা রেকর্ডিংয়ের মাধ্যমে সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে ভিন্ন মাত্রা যোগ করেছিল, তারই বিস্তারিত আলোচনা করেছেন দুই লেখক। অধ্যাপক অমিত দে তাঁর প্রবন্ধে বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গে বাউল, জারি এবং মাইজভান্ডারি গানের সম্পর্ক তুলে ধরেছেন। উচ্চবর্গীয় সংস্কৃতির বাইরে থাকা এই সঙ্গীতের মাধ্যমে কী ভাবে হিন্দু-মুসলিম সমন্বয় সাধন হয়েছিল এবং কী ভাবে সাধারণ মানুষের দুর্দশার কথা গানের কথায় ফুটে উঠত, তুলে ধরেছেন তা।

বৈষ্ণব সম্পর্কিত প্রবন্ধগুলির মধ্যে বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য বরুণী ভাটিয়ার ‘দ্য ফলেন উইমেন অ্যান্ড দ্য সেন্ট: দ্য বৈষ্ণবী ইন কলোনিয়াল বেঙ্গল’ শীর্ষক রচনাটি। সমাজের মূলস্রোতের বাইরে থাকা এই মহিলাদের ভাবমূর্তি ‘ভদ্রলোক’ বাঙালি এবং ঔপনিবেশিক শাসনের কাছে কেমন ছিল তা তুলে ধরতে গিয়ে বরুণী দেখিয়েছেন যে, শ্রীচৈতন্যের বৈষ্ণব ধর্ম নিয়ে বাঙালির ভাবাবেগ যা-ই হোক না কেন, পিতৃতান্ত্রিক সমাজের কাছে বৈষ্ণবীরা ‘দুশ্চরিত্রা’ এবং বহু ক্ষেত্রেই ‘যৌনকর্মী’ তকমা পেয়েছেন। নিজের বক্তব্য প্রতিষ্ঠায় মঠ-আখড়ার অন্দরের সম্পর্কের সমীকরণ, বঙ্কিমী সাহিত্য এবং হাই কোর্টের মামলার নথির উল্লেখ লেখকের মুনশিয়ানার পরিচয় দেয়। এই প্রবন্ধের আর একটি দিক, বিনোদিনী দাসী তথা ‘নটী বিনোদিনী’র আত্মকথার ব্যবহার। নিম্নবর্গীয় ‘জাত বৈষ্ণব’ সমাজ থেকে উঠে আসা বিনোদিনী কী ভাবে মঞ্চে চৈতন্যের ভূমিকায় অভিনয়ের মাধ্যমে নিজের অন্তরের গ্লানিমোচনের পথ খুঁজে নেন, তা আলোচনার মাধ্যমেই নারীবাদী ইতিহাসচর্চার একটি নতুন দিক উন্মোচন করেছেন লেখক।

Advertisement

এক্সপ্লোরেশনস ইন কলোনিয়াল বেঙ্গল: এসেজ় অন রিলিজিয়ন, সোসাইটি অ্যান্ড কালচার

সম্পা: অচিন্ত্যকুমার দত্ত

১৪৯৫.০০

ওরিয়েন্ট ব্ল্যাকসোয়ান

বইয়ের দ্বিতীয় পর্বে থাকা প্রবন্ধগুলি আবর্তিত হয়েছে রাজনীতি, সমাজ এবং অর্থনীতিকে কেন্দ্র করে। অধ্যাপিকা রীলা মুখোপাধ্যায়ের প্রবন্ধে জল-পরিসরে (ওয়াটারস্কেপ) ঔপনিবেশিক বাঙালির আনাগোনা উঠে এসেছে। সমুদ্র, নদী বা মোহনা যে শুধু বাণিজ্যের পথ নয়, বরং নদীকেন্দ্রিক সমাজের বৃহত্তর ক্ষেত্রের সম্পর্কযুক্ত, সে কথাই তুলে ধরেছেন তিনি। ফ্রান্সের আনাল স্কুলের ইতিহাসচর্চার যে ধারা বিভিন্ন বিষয়ের মধ্যে সমন্বয়ের মাধ্যমে সামগ্রিক চরিত্রের কথা বলে, ঔপনিবেশিক আমলে বাঙালির জল-পরিসরের চর্চায় সেই পদ্ধতিরই প্রতিফলন ধরা পড়ে। এই পর্বের আর একটি প্রবন্ধে রজত দত্ত বিস্তারিত তথ্য এবং পরিসংখ্যান ব্যবহার করে আঠারো শতকের বাঙালির অর্থ ব্যবসা এবং ব্রিটিশ শাসনের আন্তঃসম্পর্ক দেখিয়েছেন। তথ্যনিষ্ঠ ইতিহাসচর্চার ক্ষেত্রে অধুনা প্রয়াত অধ্যাপক দত্তের প্রবন্ধটি উল্লেখযোগ্য উদাহরণ। অচিন্ত্যকুমার দত্তের প্রবন্ধটি বাংলার উগ্রক্ষত্রিয়দের সামাজিক চলমানতাকে তুলে ধরেছে। সামরিক পেশায় যুক্ত থাকা উগ্রক্ষত্রিয়েরা কী ভাবে কৃষি অর্থনীতিতে অন্তর্ভুক্ত হল এবং তা থেকেই বর্ণব্যবস্থার উপরের স্তরে উঠে এল, সে কথাই বিস্তারিত ভাবে আলোচনা করেছেন লেখক।

আর একটি প্রবন্ধে শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের অতি পরিচিত তুঙ্গভদ্রার তীরে উপন্যাসের সূত্রে রঞ্জিতা দত্ত বঙ্গসমাজে দাক্ষিণাত্যের প্রতিচ্ছবির সন্ধান করেছেন। সাহিত্য এবং ইতিহাসের মধ্যে তফাৎ আছে, কিন্তু সাহিত্যের দর্পণে সামাজিক ভাবনার প্রতিচ্ছবি মুনশিয়ানার সঙ্গে তুলে ধরেছেন রঞ্জিতা। স্বদেশি আন্দোলন-পরবর্তী সময়ে রবীন্দ্রনাথের লেখনীতে জাতীয়তাবাদ এবং আন্তর্জাতিকতাবাদ কী ভাবে ফুটে উঠেছিল এবং জাতীয়তাবাদের প্রচলিত ধারণাকে কী ভাবে তিনি খারিজ করেছিলেন, তা দেখিয়েছেন অনুরাধা রায়। কৃষি-উদ্যোগী নিত্যগোপাল মুখোপাধ্যায়ের কর্মকাণ্ড ধরে প্রবন্ধের পরিসরে বাঙালির কৃষিভাবনাকে বোঝার চেষ্টা করেছেন বিপাশা রাহা। প্রবন্ধগুলির বাইরেও বাংলায় বৈষ্ণবধর্মের গবেষণায় অধ্যাপক রমাকান্ত চক্রবর্তীর অবদান নিয়ে মুখবন্ধ লিখেছেন ইতিহাসবিদ অমিয়প্রসাদ সেন। ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণার সূত্রে অনুরাধা রায়ের লেখাটিও অধ্যাপক চক্রবর্তীর পাণ্ডিত্যের নানা দিক তুলে ধরেছে। এ ছাড়াও, শব্দটীকা, বিষয় সম্পর্কিত সূত্রের তালিকা ও পরিসংখ্যান এবং ছবি বইটিকে সমৃদ্ধ করেছে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement