বাংলা ভাষায় দর্শনচর্চার পরিসরে এই সঙ্কলনগ্রন্থটি প্রয়োজনীয় ও প্রাসঙ্গিক সংযোজন। এই সঙ্কলনে গ্রথিত হয়েছে দর্শনের প্রথিতযশা অধ্যাপক অমিতা চট্টোপাধ্যায়ের লেখা বেশ কিছু বাংলা রচনা। ইংরেজি ভাষায় তাঁর রচিত বিভিন্ন গবেষণামূলক বই, প্রবন্ধাবলি বিশ্বব্যাপী সারস্বত সমাজে সুবিদিত ও সমাদৃত। তবে বাংলা ভাষায় তাঁর লেখালিখির সূচনা তুলনায় দেরিতে।
এই প্রবন্ধসংগ্রহের সম্পাদকীয়কে এক প্রকার ঋণ স্বীকারের সঙ্গে তুলনা করে সম্পাদক ঋতপ্রভ বন্দ্যোপাধ্যায় বিভিন্ন রচনার বিষয়বস্তু এবং সেই রচনাগুলি হয়ে ওঠার নেপথ্যের ঘটনাক্রম উল্লেখ করেছেন। সঙ্কলনের শিরোনামে প্রবন্ধসংগ্রহ হিসেবে পরিচিতি থাকলেও সম্পাদকীয়তে স্পষ্ট হয় যে, এর অন্তর্ভুক্ত প্রতিটি রচনা প্রবন্ধ গোত্রীয় নয়। এই সঙ্কলনের সর্বশেষ বিভাগ ‘পরিশিষ্ট’তে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে ‘কথালাপ’ শীর্ষক একটি দীর্ঘ সাক্ষাৎকার। এই দিক থেকে বিচার করলে সঙ্কলনটি প্রবন্ধসংগ্রহের পরিবর্তে ‘রচনাসংগ্রহ’ হিসাবে অভিহিত হলে যথোপযুক্ত হত। পূর্বপ্রকাশিত রচনাগুলির ক্ষেত্রে সম্পাদক এ কথাও জানিয়েছেন যে, প্রবন্ধ ছাড়া অন্যত্র প্রথম প্রকাশ সম্পর্কিত তথ্য অনুল্লিখিত। সে তথ্য থাকলে পাঠকের কৌতূহল নিবৃত্ত হত।
এই সঙ্কলনে সংযুক্ত ‘পূর্বভাষ’টি রচিত হয়েছে অধ্যাপক নির্মাল্য নারায়ণ চক্রবর্তীর কলমে। সঙ্কলিত রচনাগুলির বিষয়বস্তু এবং লিখনশৈলীর পাশাপাশি অমিতা চট্টোপাধ্যায়ের চিন্তার প্রসারতা ও ঔদার্য, দর্শনশাস্ত্রে ব্যুৎপত্তি ও পাণ্ডিত্য এবং প্রশাসনিক দক্ষতা বিষয়েও আলোকপাত করেছেন নির্মাল্যবাবু।
এবার কথা প্রাণে প্রাণে অমিতা চট্টোপাধ্যায়,
সম্পা: ঋতপ্রভ বন্দ্যোপাধ্যায়
৭৫০.০০
একলব্য
লেখকের প্রতিবেদন, সম্পাদকীয় এবং পূর্বভাষ পেরিয়ে মোট পাঁচটি ভাগে বিন্যস্ত হয়েছে লেখাগুলি— বিভিন্ন সময়ে নানা পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত রচনা, এবং নতুন অর্থাৎ অপ্রকাশিত সাতটি প্রবন্ধ। পূর্বপ্রকাশিত রচনাগুলি পরিমার্জিত ও পরিবর্ধিত আকারে এই সঙ্কলনে স্থান পেয়েছে। বিষয়বস্তুর দিক থেকে এই সঙ্কলনে রয়েছে বিবিধ রতন— গ্রন্থিত রচনাগুলির বৈচিত্র এবং বিস্তার বিশেষ উল্লেখযোগ্য। এখানে যেমন রয়েছে মনোদর্শন এবং দর্শনশাস্ত্র বিষয়ে তাত্ত্বিক আলোচনা, তেমনই সংযোজিত হয়েছে সংবাদপত্রে প্রকাশিত নিবন্ধ। এ ছাড়াও আছে কিছু গ্রন্থ-সমালোচনা এবং পূর্বপ্রকাশিত গ্রন্থের জন্য লেখা ‘ভূমিকা’। লেখকের বাংলায় লেখা প্রথম পূর্ণাঙ্গ প্রবন্ধটিও এই সঙ্কলনে সংযোজিত হয়েছে।
‘বিবিধ’ অংশে যে ছ’টি রচনা গ্রন্থিত হয়েছে, সেগুলির চলাচল ভাষাদর্শন থেকে মনঃসমীক্ষণ হয়ে লজিক বা যুক্তিশাস্ত্রের অঙ্গনে। সঞ্চার বা যোগাযোগের প্রক্রিয়া বিষয়ে রামচন্দ্র গান্ধীর যে মত, তা বিচার-বিশ্লেষণ আলোচ্য এ বিভাগের প্রথম রচনায়; আর একটি প্রবন্ধে লেখিকা ব্যাখ্যা করেছেন প্রখ্যাত ভাষা-দার্শনিক হ্বিটগেনস্টাইনের ভাবনাতত্ত্বের নানা দিক। আবার অপর একটি প্রবন্ধে মনঃসমীক্ষক ফ্রয়েড এবং বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের পত্রালাপের প্রেক্ষাপটে তিনি উপস্থাপন করেছেন কাম-প্রবৃত্তি এবং মরণ-প্রবৃত্তির বিভিন্ন অভিব্যক্তি। এ ছাড়াও এই অংশে অন্তর্ভুক্ত অন্যান্য প্রবন্ধে রয়েছে মানুষের যৌক্তিকতা নিয়ে মনোবৈজ্ঞানিক আলোচনা, অন্য দিকে ন্যায়-অনুমান, বিকল্প যুক্তিকাঠামো নিয়ে যুক্তিবৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ।
দ্বিতীয় বিভাগটি আছে মনোদর্শন বিষয়ক আটটি রচনা। এখানে ২০০৩ সালে প্রকাশিত মনোদর্শন: শরীরবাদ ও তার বিকল্প শীর্ষক সঙ্কলন (অসীমা প্রকাশনী) থেকে দু’টি রচনা পুনর্মুদ্রিত হয়েছে। এ ছাড়াও দার্শনিক তথা বোধবিজ্ঞানের আঙ্গিক থেকে চেতনাচর্চা বিষয়ে একটি নাতিদীর্ঘ আলোচনা যেমন আছে, তেমনই রয়েছে তাঁর বাংলায় রচিত ও প্রকাশিত প্রথম প্রবন্ধ— ‘যান্ত্রিক ও মানসিক’। এই ভাগের অপর একটি প্রবন্ধে জিতেন্দ্রনাথ মহান্তির আত্মতত্ত্বের আলোচনায় উঠে এসেছে আত্মতত্ত্বের নানা স্তর এবং তাদের পরিচয়। মনোদর্শনের প্রেক্ষিত থেকে রচিত ‘জ্ঞান’ বিষয়ক দু’টি রচনা এই বিভাগের অন্যতম আকর্ষণ।
‘প্রসঙ্গ দার্শনিক’ অংশে আমরা পাই প্রধানত আধুনিক ভারতের বিভিন্ন চিন্তক/দার্শনিকদের নিয়ে লেখা আটটি রচনা। আচার্য ব্রজেন্দ্রনাথ শীল, সতীশচন্দ্র ও ধীরেন্দ্রমোহন দত্তের ভাবনার নানা দিক উঠে এসেছে এই বিভাগে সন্নিবিষ্ট লেখাগুলিতে। বাদ যাননি রবীন্দ্রনাথও। মন সম্পর্কে রবীন্দ্র-ভাবনা উপস্থাপিত হয়েছে একটি নাতিদীর্ঘ রচনায়।
চতুর্থ ভাগে আছে সাতটি লেখা— গ্রন্থবিষয়ক আলোচনা, পর্যালোচনা, স্মারক-বক্তৃতার লিখিত ভাষ্য, গ্রন্থ-ভূমিকা ইত্যাদি। সর্বশেষ বিভাগ ‘পরিশিষ্ট’তে নির্ঘণ্ট বাদে একটি সুদীর্ঘ সাক্ষাৎকার-সহ তিনটি রচনা রাখা হয়েছে। সাক্ষাৎকার পর্বে দ্বিতীয় বার এসেছেন রবীন্দ্রনাথ, তবে এক অভিনব প্রেক্ষাপটে— ‘কগনিটিভ মিউজ়িকোলজি’ এবং রবীন্দ্রনাথের গান নিয়ে আলাপচারিতায়।
এই সঙ্কলনের বিশেষত্ব হল, এখানে একত্রিত রচনাগুলি সাবলীল, সহজ বাংলায় দর্শনের নানা গূঢ় তত্ত্ব, দুরূহ সমস্যা পাঠকের কাছে তুলে ধরেছে। বাংলায় দর্শনচর্চায় আগ্রহী শিক্ষার্থী, গবেষক, সাধারণ পাঠক ও বিদ্যোৎসাহীদের কাছে তাই এই সঙ্কলন এক মূল্যবান প্রাপ্তি। বাংলায় দর্শনচর্চা, গবেষণা এবং আলোচনা নিঃসন্দেহে আরও সুগম ও সুলভ করবে এই রচনাগুলি। বিশেষ করে, বোধবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে বাংলা রচনার পথিকৃৎ অমিতাদেবীর প্রবন্ধগুলি, এ কথা বলাই যায়। বইয়ের প্রচ্ছদটি শোভন। মুদ্রণপ্রমাদ নেই বললেই চলে, তবে বাঁধাইয়ের ত্রুটিবশত কিছু পৃষ্ঠাসংখ্যার (১৫৯-১৮৭) বিন্যাস এলোমেলো হয়ে গেছে, যা পরবর্তী মুদ্রণে সংশোধনযোগ্য। সব শেষে একটি প্রশ্ন: ২০২১ সালে অমিতাদেবীর বাংলায় লেখা মনোদর্শন বিষয়ক প্রবন্ধের সঙ্কলন কল্পগল্পে মনোদর্শন (সাহিত্য সংসদ) প্রকাশিত হওয়ার পরে ২০২৪ সালে প্রকাশিত আলোচ্য গ্রন্থটি ‘বাংলাভাষায় তাঁর প্রথম প্রবন্ধ সঙ্কলন’ হিসেবে সম্পাদকের দাবিকি যুক্তিযুক্ত?