মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ছবি: ফেসবুক।
প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য যা শুরু করতে দেরি করে ফেলেছিলেন, সেটা সময়ে শুরু করে দিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ২০০৮ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনে সিপিএম তথা বামফ্রন্টের বিপর্যয় দেখার পরে বুদ্ধদেব ‘শুদ্ধকরণ’ বার্তা দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সে সুযোগ আর আসেনি। একের পর এক নির্বাচনে হারতে হারতে শূন্যে পৌঁছে গিয়েছে বামেরা। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী মমতা সেই ‘ভুল’ না করে পর পরটি তিন নির্বাচনে ভাল ফলের পরে উৎসবের আবহের মধ্যেই সতর্ক করে দিলেন তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের। ২১ জুলাইয়ের বৃহত্তম সমাবেশ থেকে তৃণমূলে শুদ্ধকরণের ডাক দিলেন। যাকে দলের অভ্যন্তরে ‘কড়া বার্তা’ বলেই মনে করা হচ্ছে।
দলের প্রথম সারির নেতাদের মতে, নেত্রী এবং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বিলক্ষণ জানেন, দুর্নীতি এবং সরকারি পরিষেবা না-পাওয়া প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার অন্যতম দু’টি কারণ। তাই তিনি সে দিকে বিশেষ নজর দিয়েছেন। এবং সেই সংক্রান্ত বার্তা দেওয়ার জন্য বেছে নিয়েছsন ২১ জুলাইয়ের সমাবেশকে। যেখানে দলের সমস্ত স্তরের নেতা, কর্মী এবং জনপ্রতিনিধিরা উপস্থিত থাকেন।
রবিবার তাঁর বক্তৃতায় মমতা সরাসরি বলেছেন, ‘‘বিত্তবানদের নয়, বিবেকবানদের দল হতে হবে তৃণমূলকে। আমি দলে বিত্তবান লোক চাই না। বিবেকবান লোক চাই। কেন জানেন? পয়সা আসে, চলে যায়। কিন্তু সেবার কোনও বিকল্প নেই।’’ অর্থাৎ, রাজ্যের বিভিন্ন এলাকায় তৃণমূলের এক শ্রেণির নেতার যে আয়ের সঙ্গে সঙ্গতিহীন ব্যয়ের নিদর্শন দেখা যাচ্ছে, মমতা সে দিকে আঙুল তুলেছেন। মমতা বলেছেন, ‘‘যত জিতব, তত নম্র হতে হবে।’’ অর্থাৎ, রাজ্যের বিভিন্ন এলাকায় শাসক দলের নেতা-কর্মীদের একাংশের মধ্যে যে ‘দাদাগিরি’র প্রবণতা দেখা দিয়েছে, নেত্রী মমতা তার দিকে নজর দিতে বলেছেন। নেতা-কর্মীদের শাসন করার ভঙ্গিতে মমতা বলেছেন, ‘‘যেন কারও বিরুদ্ধে দল কোনও অভিযোগ না পায়! অভিযোগ পেলে দল উপযুক্ত ব্যবস্থা নেবে।’’ সেই কথার জের টেনেই ‘সৎ’ থাকার পরামর্শও দিয়েছেন। বলেছেন, ‘‘আমি চাই আপনারা গরিব থাকুন। তার মানে ঘরে যা আছে, সেটা খেয়ে বেঁচে থাকুন। লোভ করার দরকার নেই।’’ দলের নেতাদের একাংশের মতে, নেত্রী এবং প্রশাসক মমতা ইতিমধ্যেই দল এবং প্রশাসনে ‘ঝাঁকুনি’ দেওয়া শুরু করেছেন। ২১ জুলাইয়ের মঞ্চ থেকেও তিনি সেই প্রক্রিয়াই জারি রাখলেন। কারণ, মমতা জানেন, ২০২৬ সালের বিধানসভা ভোট ‘শাসক’ তৃণমূলের কাছে আরও একটি পরীক্ষার। সেই ভোটে তৃণমূলকে দীর্ঘ ১৫ বছরের প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার মোকাবিলা করতে হবে। সেই কারণেই মমতা তাঁর ভাষণে বলেছেন, ‘‘অন্যায় করলে আমি দলের কাউকে ছাড়ি না। গ্রেফতার করি। অন্যায় করবেন না। অন্যায় সহ্য করবেন না। আমি পরিষ্কার বলছি, মা-বোনেদের সম্মান দেবেন।’’
গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
বস্তুত, রবিবার তৃণমূলের ২১ জুলাইয়ের সমাবেশ ছিল দু’বছর পরের বিধানসভা ভোটের প্রক্রিয়া শুরু করে দেওয়ার মঞ্চ। এই সমাবেশ সর্ব অর্থেই ছিল ‘রাজনৈতিক’। অন্যান্য বার ২১ জুলাইয়ের সভায় ‘সংস্কৃতি’র ছোঁয়া প্রকট থাকে। এ বার তেমন কিছু ছিল না। বিশিষ্ট এবং খ্যাতনামীদের মধ্যে যাঁরা মঞ্চে থাকেন, তাঁরা এ বারও ছিলেন। ‘নজরকাড়া’ সংযোজন বলতে অভিনেত্রী শ্রাবন্তী চট্টোপাধ্যায়। যিনি ২০২১ সালের বিধানসভা ভোটে বিজেপির টিকিটে লড়েছিলেন এবং হেরেছিলেন। অন্যান্য বার ২১ জুলাইয়ের সমাবেশে নেতা-নেত্রীদের বক্তৃতার মাঝে গান হয়। কখনও বিশিষ্টেরা কিছু বলেন। কিন্তু রবিবার সে সবও কিছু হয়নি। মমতা, অখিলেশ, অভিষেক পৌঁছনোর আগে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান যা হওয়ার হয়ে গিয়েছিল। নেতাদের বক্তৃতার সময়ে গান শোনানোর জন্য ডাক পান শুধু নচিকেতা। মমতা নিজেই তাঁকে আহ্বান জানান। তা-ও নচিকেতা খানিক গেয়ে সুরে সুরেই মমতাকে বক্তৃতার জন্য ডেকে নেন।
সদ্যসমাপ্ত লোকসভা ভোটে তৃণমূলের বিরোধীদের বহু অভিযোগ মাথায় নিয়ে লড়তে হয়েছিল। একটা সময়ে বিরোধী শিবির মনে করেছিল, শাসকদল খাদের কিনারে দাঁড়িয়ে। কিন্তু ফলঘোষণায় দেখা যায়, উল্টে আসন বাড়িয়েছে তৃণমূল। কিন্তু সেই ফলাফল দলের কর্মীদের মধ্যে যাতে ‘আত্মতুষ্টি’ না ডেকে আনে, সে বিষয়েও সজাগ নজর দিয়েছেন মমতা। রবিবারের সমাবেশে আসা তৃণমূলের কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে উৎসবের মেজাজ ছিল। কিন্তু প্রধান বক্তা মমতা একটি বারের জন্যও উৎসবের কথা না শুনিয়ে ‘শাসন’ করেছেন নেতা-কর্মীদের। বলেছেন, ‘‘তৃণমূল করতে গেলে সকলকে নিয়ে চলতে হবে। যেখানে যেখানে জিতেছেন, সেখানে সেখানে গিয়ে মানুষকে ধন্যবাদ জানাবেন। মানুষের জন্য কাজ করবেন। যেখানে যেখানে আমরা জিতিনি, সেখানকার মানুষের কাছে গিয়ে ক্ষমা চাইবেন।’’ মনে করিয়েছেন, ‘‘গাড়িতে ঘোরার চেয়ে হেঁটে ঘোরা ভাল। সাইকেল নিয়ে গ্রামে গ্রামে ঘোরা ভাল।’’
তৃণমূলনেত্রী যে দলে ‘শুদ্ধকরণ’ চাইছেন, তা বুঝতে পেরেছে বিজেপিও। পদ্মশিবিরের নেতারাও মানছেন, লম্বা দৌড়ের ঘোড়া হতেই তৃণমূল এখন থেকে দল গোছানোর কাজ শুরু করেছে। এখন থেকেই বিধানসভা নির্বাচনের দিকে তাকিয়ে পথচলা শুরু করেছে। দলের রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার অবশ্য বলেছেন, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী বলার জন্য এ সব বলছেন। কিন্তু ওঁদের দলের যা ব্যবস্থা, তাতে আদৌ সেটা সম্ভব কি? তোলাবাজি বন্ধ হয়ে গেলে দলের টাকা জোগাবে কে?’’
সমাবেশে মমতার বক্তব্যে দলনেত্রী হিসাবে ‘শাসনের সুর’ই স্পষ্ট শোনা গিয়েছে। অন্যায়ের বিরুদ্ধে দলের কর্মীদের দাঁড়ানোর কথা বলার পাশাপাশি দলের কারও বিরুদ্ধে যাতে দুর্নীতির অভিযোগ না ওঠে, সেই শপথও করিয়ে নিয়েছেন মমতা। এমন কথা মমতা অতীতে কখনও বলেননি এমনটা নয়। তবে রবিবারের সমাবেশ যে মমতাকে দেখল, তিনি দলে ‘সার্বিক শুদ্ধকরণ’ দেখতে চান। মমতার কথায় স্পষ্ট যে, তিনি দলের এক শ্রেণির নেতার ‘ভাবমূর্তি’ নিয়ে ভাবিত। কেন্দ্রীয় সরকারের নীতির বিরোধিতা, বিজেপির বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ লড়াইয়ের কথা, রাজ্য প্রশাসনের প্রধান হিসাবে কর্মসংস্থানের কথা বলেছেন মমতা। কিন্তু প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত বুঝিয়ে দিয়েছেন, ‘শৃঙ্খলাবদ্ধ’ দলই তাঁর কাছে প্রধান। পর পর তিন বার ক্ষমতায় আসা দলের সংগঠনে যে ‘বেনোজল’ জমেছে, তিনি তা বার করতে নিজস্ব নিকাশি ব্যবস্থার প্রণয়ন করছেন।
যে ভাবে সম্প্রতি মমতা দল এবং প্রশাসনে ‘ঝাঁকুনি’ দেওয়ার কাজ শুরু করেছেন, তাতে ‘আত্মশুদ্ধি’ দেখছেন তৃণমূলের নেতাদের বড় অংশ। তাঁদের মতে, দলনেত্রী মমতা এখন নিজেই শাসক। নিজেই বিরোধী। ফুটবল রসিক এক নেতার কথায়, ‘‘মমতাদি এখন নিজেই পক্ষ, নিজেই প্রতিপক্ষ। তিনিই গোল করছেন। তিনিই গোল বাঁচাচ্ছেন। আবার একই সঙ্গে তিনিই রেফারি হয়ে বেয়াড়া ফুটবলারদের হলুদ কার্ড বা লাল কার্ড দেখাচ্ছেন!’’
সমাবেশের শেষে মমতা তাঁর প্রিয় স্লোগান ‘খেলা হবে’ শুনিয়েছেন। এই স্লোগান দিয়েই তিনি ২০২১ সালের বিধানসভা ভোটে বিজেপিকে রুখে দিয়েছিলেন। তৃণমূলের লোকজন অবশ্য বলছেন, ২০২৬ সাল পর্যন্ত ‘খেলা’ অনেক বেশি হবে তৃণমূলের অন্দরে।