আবারও একটি ২১ জুলাই। লোকসভা নির্বাচনের আগে গত ১০ মার্চ ব্রিগেডে সমাবেশ করেছিল তৃণমূল। তার ঠিক ১৩৩ দিনের মাথায় ২১ জুলাই উদ্যাপন করল তারা। তবে এ বারের ২১ জুলাইয়ের অন্য একটি মাত্রা ছিল। সদ্যই শেষ হয়েছে লোকসভার নির্বাচন। সেই নির্বাচনে এ রাজ্যে ২৯টি আসন পেয়েছে তৃণমূল। নির্বাচনের ফলপ্রকাশের পর জেলায় জেলায় বিজয় উৎসব হলেও তৃণমূলের তরফে কেন্দ্রীয় ভাবে সে ভাবে কোনও কর্মসূচি নেওয়া হয়নি। তৃণমূলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আগেই জানিয়েছিলেন, শহিদ স্মরণের পাশাপাশিই লোকসভা ভোটের জয়ও উদ্যাপন করা হবে ২১ জুলাইয়ের মঞ্চে। তিনি বলেছিলেন, ‘‘শত চেষ্টা করেও তৃণমূলকে যে আটকানো যায় না, লোকসভার ফলাফলই তা দেখিয়ে দিয়েছে।’’ ২১ জুলাইয়ের মঞ্চ থেকেও আবার সেই বার্তা দিলেন তৃণমূল নেতৃত্ব। বক্তার তালিকা তৈরি করেছিলেন মমতা নিজেই। সেখানে সমাজের বিভিন্ন স্তরের প্রতিনিধিত্বের উপরেই জোর দেওয়া হয়েছিল।
অখিলেশ যাদব: পরনে সাদা কুর্তা-পাজামা। কালো রঙের জওহর কোট। গলায় সাদা উত্তরীয়। মাথায় সমাজবাদী পার্টির লাল টুপি। চেনা পোশাকেই তাঁকে দেখা গিয়েছে ২১ জুলাইয়ের মঞ্চে। তৃণমূলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঠিক আগের বক্তা ছিলেন সমাজবাদী পার্টির প্রধান তথা উত্তরপ্রদেশের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী অখিলেশ। এই কর্মসূচিতে আমন্ত্রণের জন্য মমতাকে ধন্যবাদ জানান তিনি। বলেন, “দিদি যে ভাবে খুশি হয়ে কর্মীদের সঙ্গে দেখা করছেন, এই যে নেতা এবং কর্মীদের সম্পর্ক, এটাই দলকে মজবুত করে। যে কর্মীরা শহিদ হয়েছেন, তাঁদের স্মরণ করছি। সব দলের ভাগ্যে এমন কর্মী মেলে না, যাঁরা প্রাণ দিতে পারেন। দিদির কাছে এ রকম কর্মী রয়েছেন।” তৃণমূলনেত্রীর লড়াইকে কুর্নিশ জানিয়েছেন মুলায়ম-পুত্র। তাঁর লড়াইয়ে পাশে থাকার বার্তাও দিয়েছেন। বক্তব্যের মধ্যে এক জায়গায় মমতা সম্পর্কে অখিলেশ বলেন, “এক অকেলি লড় জায়েগি, জিতেগি অর বাড় জায়েগি।” ১৪ মিনিট বক্তৃতা করেছেন অখিলেশ। ধীর লয়ে বক্তৃতা শুরু করলেও শেষ পর্যন্ত তাঁর বক্তব্যে একটা বাঁধন লক্ষ্য করা গিয়েছে। আনন্দবাজার অনলাইনের বিচারে অখিলেশ ১০-এ পেলেন ৬।
ফিরহাদ হাকিম: বক্তাদের মধ্যে একমাত্র মুসলিম সংখ্যালঘু নেতা। বক্তব্যের শুরুতেই সুর চড়িয়েছেন। কী ভাবে বাংলার ক্ষমতা থেকে বামফ্রন্ট সরকারকে উৎখাত করেছেন তৃণমূলনেত্রী, সেই কথা তুলে ধরেছেন। ৮ মিনিটের বক্তব্যে ৬ মিনিটই তৃণমূলনেত্রীর লড়াইয়ের কাহিনি শোনা গিয়েছে তাঁর কণ্ঠে। ফিরহাদ বলেন, “মানুষের পাশে থেকে মানুষের সেবা করা শিখিয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।” কী ভাবে তৃণমূলনেত্রীর উপর বার বার হামলা হয়েছে, তা-ও তুলে ধরেন তিনি। অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় যে ভাবে লড়াই করছেন, তার প্রসঙ্গও ফিরহাদের বক্তব্যে এসেছে। এসেছে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বার্তাও। বলেছেন, “হিন্দু-মুসলিম-শিখ-ইসাই, আমরা সবাই ভাই-ভাই। আমাদের মধ্যে বিভেদ নেই।” তবে বক্তৃতার মাত্র ২ মিনিট খরচ করেছেন কেন্দ্রকে আক্রমণে। ১০-এ পেলেন ৫।
মধুপর্ণা ঠাকুর: বয়স কম। সর্বকনিষ্ঠ বিধায়ক। বাগদা বিধানসভা থেকে উপনির্বাচনে সদ্য জিতেছেন। বড় মঞ্চে দলের তাবড় নেতৃত্বের সামনে প্রথম বক্তৃতা! দেখে মনে হচ্ছিল নার্ভাস। মতুয়া সমাজের প্রতিনিধি হিসেবেই তাঁকে বক্তা তালিকায় রাখা হয়েছিল। শুরুতেই তৃণমূলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় এবং মঞ্চে উপস্থিত সকলকে প্রণাম জানিয়েছেন। একটু হোঁচট খেলেও সামলে নিয়ে স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করেছেন। ২১ জুলাই নিয়ে দু’-এক কথা বলেছেন। নাম না করে আক্রমণ এবং কটাক্ষ করেছেন তাঁর খুড়তুতো দাদা তথা বিজেপি সাংসদ তথা কেন্দ্রীয় মন্ত্রী শান্তনু ঠাকুরকে। মতুয়া ঠাকুরবাড়ির টানাপড়েনও উঠে এসেছে তাঁর বক্তব্যে। ঘটনাচক্রে, তাঁর বক্তৃতার মধ্যেই কাছে টিপু সুলতান মসজিদে আজান শুরু হয়। মধুপর্ণাকে থামিয়ে দেন সঞ্চালক অরূপ বিশ্বাস। আজান শেষ হওয়ার পরে দু’-এক কথা বলে বক্তব্য শেষ করেন। ৭ মিনিট বক্তৃতা করেছেন। একটু অগোছালো ছিলেন। কিন্তু এই প্রথম বড় মঞ্চে বক্তৃতা। বিধানসভায় বক্তৃতা করতে গিয়ে এই অভিজ্ঞতা তাঁর কাজে লাগবে। তাই মধুপর্ণা পাচ্ছেন ১০-এ ৪.৫।
জগদীশচন্দ্র বর্মা বসুনিয়া: ১২টার কিছু পরে বক্তৃতা করতে ওঠেন। স্থানীয় ভাষায় কিছুটা বলেন কোচবিহারের সাংসদ। ৮ মিনিটের বক্তৃতার বেশির ভাগটাই জুড়ে ছিল উত্তরবঙ্গের রাজবংশী, আদিবাসী মানুষের অধিকার। প্রথম থেকেই সুর ছিল চড়া। শেষ পর্যন্তও তেমনই থেকেছে। কথায় স্থানীয় ভাষার টান থাকলেও সাবলীল বক্তৃতা করেছেন। বক্তব্যে উঠে এসেছে পঞ্চানন বর্মা, রাজবংশী ভাষা অ্যাকাডেমি, কোচবিহার মেডিক্যাল কলেজ, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের কথা। ১০০ দিনের কাজ, আবাস যোজনা নিয়ে কেন্দ্রকে আক্রণ করেছেন। সব শেষে বলেছেন, “কোচবিহার জিতলেই উত্তরবঙ্গের লড়াই শেষ হবে না। যত দিন না পর্যন্ত গোটা উত্তরবঙ্গে জোড়াফুল ফুটবে, আমার লড়াই চলবে।” তবে লোকসভায় বলতে গেলে আরও সড়গড় হতে হবে। জগদীশ পেলেন ১০-এর মধ্যে ৪।
দুলাল মুর্মু: সাড়ে ১২টার কিছু পরে বক্তৃতা শুরু করেন। শুরু থেকেই সুর চড়িয়েছেন। তবে সাঁওতালি ভাষায়। বক্তব্যের বেশির ভাগ জুড়ে ছিল আদিবাসীদের অধিকার এবং কেন্দ্রের বিরুদ্ধে বঞ্চনার অভিযোগ। বক্তব্যের কিছু সময় ব্যয় করেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের লড়াই নিয়ে। শেষ দু’ মিনিট দু’-চার লাইন বাংলায় বলেন। আবার সাঁওতালিতে ফিরে বক্তব্য শেষ করেন। তার পরে আবার এক লাইন বাংলায়। সেখানেই শেষ করেন। মোট ৭ মিনিট বক্তৃতা করেছেন নয়াগ্রামের তৃণমূল বিধায়ক। পেলেন ১০-এ ৩.৫।
সুব্রত বক্সী: সভার প্রথম বক্তাই ছিলেন তিনি। ৭ মিনিট বক্তৃতা করেছেন। বক্তা হিসেবে কোনও দিনই খুব বিখ্যাত নন। তার উপরে তিনি আবার এই সমাবেশের সামগ্রিক দায়িত্বপ্রাপ্ত। তবে তাঁর এক এবং একমাত্র বিগ্রহ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেই জন্য সংক্ষিপ্ত বক্তব্যের বেশির ভাগ অংশ জুড়েই ছিল মমতার লড়াইয়ের স্মৃতিচারণা। কেন ২১ জুলাই, সেই ব্যাখ্যাও শুনিয়েছেন। ২০২৩ সালের এই সভায় একই কথা বলেছিলেন বক্সী। এ বারও তাই। তিনিও ১০-এর মধ্যে পেলেন ৩.৫।