এ যেন ‘দ্বন্দ্বযুদ্ধে’র খোলা চ্যালেঞ্জ! কিংবা পাঞ্জার লড়াইতে চিরশত্রুকে আহ্বান! খোদ প্রেসিডেন্টের গলায় সেই কথা শুনে প্রমাদ গুনছে বিশ্ব। সেই সঙ্গে আতঙ্কে কাঁপছে পূর্ব ইউরোপের ‘রুটির ঝুড়ি’। ক্ষমতা জাহিরের নেশায় তাঁকেই গিনিপিগ হিসাবে ব্যবহার করতে পারে দুই শক্তিধর। সেই সঙ্গে এই চ্যালেঞ্জকে কেন্দ্র করে ইউরোপ জুড়ে যুদ্ধ ছড়ানোর আশঙ্কাকে উড়িয়ে দিচ্ছেন না প্রতিরক্ষা ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞেরা।
চলতি বছরের ১৯ ডিসেম্বর রাজধানী মস্কোর এক সাংবাদিক বৈঠক থেকে আমেরিকা-সহ ‘নেটো’ভুক্ত পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলিকে খোলা চ্যালেঞ্জ জানান রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। সেখানেই উচ্চ প্রযুক্তির দ্বন্দ্বযুদ্ধের আহ্বান করেছেন তিনি। এই পাঞ্জা ‘ওরেশনিক’ ক্ষেপণাস্ত্র বনাম আমেরিকা-সহ নেটোভুক্ত দেশগুলির ‘আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা’র মধ্যে দেখতে চাইছেন রাশিয়ার সর্বময় কর্তা।
মস্কোর মাঝারি পাল্লার হাইপারসনিক ব্যালেস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র (ইন্টারমিডিয়েট রেঞ্জ ব্যালেস্টিক মিসাইল বা আইআরবিএম) হল ‘ওরেশনিক’। ইউক্রেন যুদ্ধে ইতিমধ্যেই এই ‘ব্রহ্মাস্ত্র’ ব্যবহার করেছেন পুতিন। তাঁর দাবি, শব্দের চেয়ে ১০ গুণ গতিতে (১০ ম্যাক) উড়ে গিয়ে নির্দিষ্ট লক্ষ্যে আঘাত হেনেছে সেটি। ইউক্রেনীয় শিল্প শহর ডেনিপ্রোকে ধুলোয় মিশিয়ে দিতে ভয়ঙ্কর এই মারণাস্ত্র ব্যবহার করেছে পুতিন ফৌজ।
গত ২১ নভেম্বর ডেনিপ্রোতে আছড়ে পড়ে ‘ওরেশনিক’। রুশ ভাষায় যার অর্থ হল ‘হ্যাজ়েল গাছ’। ইউক্রেনীয় গুপ্তচরদের রিপোর্ট অনুযায়ী, মাত্র ১৫ মিনিটের মধ্যে প্রায় হাজার কিলোমিটার (৬২০ মাইল) দূরত্ব অতিক্রম করে মস্কোর ওই আইআরবিএম। কিন্তু তা সত্ত্বেও এর ধ্বংস ক্ষমতা নিয়ে বারে বারে প্রশ্ন তুলেছে আমেরিকা।
যুক্তরাষ্ট্রের সেনা কর্তাদের একাংশের দাবি, রুশ ‘ওরেশনিক’কে চিহ্নিত করে মাঝ আকাশে ধ্বংস করা খুব কঠিন নয়। সেই ক্ষমতা ওয়াশিংটনের ‘আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা’গুলির রয়েছে বলেও মন্তব্য করতে শোনা গিয়েছে তাঁদের। এই অবস্থায় আচমকাই তাঁদের খোলা চ্যালেঞ্জ দিয়ে বসলেন রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিন।
মস্কোর সাংবাদিক বৈঠকে পুতিন বলেছেন, ‘‘ওরা (পড়ুন আমেরিকা) আমাদের হ্যাজ়েলকে সন্দেহের চোখে দেখছে। আর তাই ওদের উন্নত প্রযুক্তির চ্যালেঞ্জে জানাচ্ছি। ইউক্রেনের রাজধানী কিভকে বেছে নেওয়া হোক। সেখানে যাবতীয় এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম এনে জড়ো করুক আমেরিকা আর পশ্চিমি শক্তি। তার পরও ওরা আমাদের হ্যাজ়েলকে আটকাতে পারবে না। আমরা এই পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত।’’
‘ওরেশনিক’ তথা ‘হ্যাজ়েল’কে আধুনিকতম হাতিয়ার বলে উল্লেখ করেছেন রুশ প্রেসিডেন্ট। সাংবাদিক বৈঠকে এর প্রশংসার এতটুকু খামতি রাখেননি তিনি। ‘‘ধরা যাক দু’হাজার কিলোমিটার দূর থেকে হ্যাজ়েলের উৎক্ষেপণ করা হয়েছে। সীমান্তবর্তী দেশ পোল্যান্ডে ক্ষেপণাস্ত্র ধ্বংসকারী সিস্টেম থাকলেও কোনও লাভ নেই। সেটি সক্রিয় হওয়ার আগেই নির্দিষ্ট লক্ষ্যে আঘাত হানতে সক্ষম হবে ওরেশনিক।’’ বলে়ছেন গর্বিত পুতিন।
মস্কোর সর্বময় কর্তা আরও জানিয়েছেন, সম্পূর্ণ দেশীয় প্রযুক্তিতে এই ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি করেছেন রুশ প্রতিরক্ষা গবেষকেরা। তবে আগে ক্ষেপণাস্ত্র বা হাতিয়ারগুলির চেয়ে অনেক বেশি উন্নত প্রযুক্তিতে হ্যাজ়েলকে তৈরি করেছেন তাঁরা। এর উৎপাদন সংক্রান্ত সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে সরাসরি তাঁর জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে নিয়েছেন রুশ প্রেসিডেন্ট।
রুশ ‘হাওয়াই হামলা’র থেকে রক্ষা করতে ইউক্রেনকে ইতিমধ্যেই ‘টার্মিনাল হাই অলটিচ্যুড এরিয়া ডিফেন্স’ বা থাড সরবরাহের সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে আমেরিকা। ওয়াশিংটনের দাবি, ওই এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম হাতে এলে মাঝ আকাশে সহজেই মস্কোর যে কোনও ক্ষেপণাস্ত্রকে ধ্বংস করতে পারবে কিভের বাহিনী। আর তাই ‘ইউরোপের রুটির ঝুড়ি’তে থাড পৌঁছনোর আগেই বড় চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিলেন খোদ প্রেসিডেন্ট পুতিন।
যুক্তরাষ্ট্রের মতো রাশিয়ারও নিজস্ব আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা রয়েছে। সেগুলি হল, ‘এস-৪০০ ট্রায়াম্ফ’ এবং ‘এস-৫০০’। চলতি বছরে বেশ কয়েক বার নিজেদের ক্ষমতা দেখিয়েছে এই সমস্ত এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম। এগুলির ফাঁক গেল রুশ ভূখণ্ডে দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে হামলা চালাতে ব্যর্থ হয় ইউক্রেনীয় সেনা।
ওরেশনিক-চ্যালেঞ্জের পাশাপাশি থাডের সঙ্গে ‘এস-৪০০’-র তুলনা টেনেছেন প্রেসিডেন্ট পুতিন। আমেরিকার আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার দুর্বলতার কথা বলতে শোনা গিয়েছে তাঁকে। পাশাপাশি খোঁচা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ‘প্যাট্রিয়ট’ নামের একটি এয়ার ডিফেন্সটিকেও।
সাংবাদিক বৈঠকে পুতিন বলেন, ‘‘আমেরিকানরা যদি ইউক্রেনকে থাড সরবরাহের সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে তা হলে সেটা ওরা করে নিক। থাড আধুনিক হলেও ওতে অনেক দুর্বলতা রয়েছে। প্যাট্রিয়টের সাহায্য পেলে সেটা এস-৩০০ এয়ার ডিফেন্স সিস্টেমের মতো কাজ করে। ওটা পুরনো হয়ে যাওয়ায় আমরা এখন বাতিল করে দিয়েছি। থাডের আমাদের ক্ষেপণাস্ত্র আটকানোর ক্ষমতা নেই।’’
গত নভেম্বরে দূরপাল্লার ব্রিটিশ এবং আমেরিকান ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে রাশিয়ার কারস্ক এবং ব্রায়ানস্ক এলাকায় হামলা চালায় ইউক্রেনীয় সেনা। এর পরই কিভকে শিক্ষা দিতে ‘ওরেশনিক’-এর প্রত্যাঘাত শানানোর সিদ্ধান্ত নেন পুতিন। সেই মত ২১ নভেম্বর ‘অপারেশন ডেনিপ্রো’ কার্যকর করে রুশ সেনা।
কিভের সেনাবাহিনী দাবি, শব্দের চেয়ে ১১ গুণ গতিতে উড়ে এসে হামলা চালায় ওই রুশ ক্ষেপণাস্ত্র। মোট ছ’টি ওয়ারহেডে সজ্জিত ছিল ‘ওরেশনিক’। সেগুলির প্রতিটি থেকে আবার ডেনিপ্রোর উপর আছড়ে পড়ে ছ’টি করে বিস্ফোরক ভর্তি হাতিয়ার। ইউক্রেনীয় শহরকে ধূলিসাৎ করার ভিডিয়ো ইতিমধ্যেই প্রকাশ করেছে মস্কো।
ওই ঘটনার পর থেকে ধারাবাহিক ভাবে ‘ওরেশনিক’-এর গুণকীর্তন করে চলেছেন প্রেসিডেন্ট পুতিন। একসঙ্গে একাধিক এই ক্ষেপণাস্ত্র প্রয়োগ করলে, তার ধ্বংসক্ষমতা পারমাণবিক হামলার থেকেও নাকি বেশি হবে। সম্প্রতি এমন কথাও বলতে শোনা গিয়েছে তাঁকে।
রুশ আইআরবিএম নিয়ে তাৎপর্যপূর্ণ মন্তব্য করেছেন ‘ন্যাশনাল ডিফেন্স ম্যাগাজিন’-এর প্রধান সম্পাদক ইগর কোরেচোঙ্কো। তাঁর কথায়, ‘‘ওরেশনিককে আটকানো সত্যিই খুব কঠিন। কারণ এর উৎক্ষেপণের মুহূর্ত কার্যত শনাক্ত করা অসম্ভব। কৃত্রিম উপগ্রহ মারফত এটিকে ট্র্যাক করা যায় না।’’
সূত্রের খবর, উৎক্ষেপণের পর ব্যালেস্টিক ট্রাজেক্টোরি অনুসরণ করে একেবারে মহাকাশে পৌঁছে যায় ‘ওরেশনিক’। এর পর সেখান থেকে নির্ধারিত লক্ষ্যে আঘাত হানে সেটি। হামলার সময়ে আলাদা হয়ে যায় এর ওয়ারহেড। প্রতিটা ওয়ারহেড স্বাধীন ভাবে আলাদা আলাদা করে নির্দিষ্ট লক্ষ্যে আছড়ে পড়ে।
বিশেষজ্ঞেরা জানিয়েছে, রুশ আইআরবিএমের ওয়ারহেডগুলির রয়েছে নিজস্ব প্রপালশন সিস্টেম। সাধারণত অন্তর্মহাদেশীয় ব্যালেস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের পাল্লা তিন থেকে পাঁচ হাজার কিলোমিটার হয়ে থাকে। তবে মস্কোর হাতে ১১ হাজার কিলোমিটার দূরত্বের আইসিবিএমও রয়েছে। ‘ওরেশনিক’ মাঝারি পাল্লার হওয়ায় তা অনায়াসেই হাজার থেকে সাড়ে পাঁচ হাজার কিলোমিটার দূরত্বে আঘাত হানতে সক্ষম বলে জানা গিয়েছে।