Tapas Mandal

নিয়োগ দুর্নীতি: মামলার জালে কী ভাবে জড়িয়ে পড়লেন মানিকের দীর্ঘ দিনের ঘনিষ্ঠ তাপস?

নিয়োগে দুর্নীতিতে গ্রেফতার করা হল তাপস মণ্ডলকে। রবিবার মানিক ভট্টাচার্যের ‘ঘনিষ্ঠ’কে গ্রেফতার করেছে সিবিআই। গ্রেফতারের আগে একাধিক বার তাপসকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন তদন্তকারীরা।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

কলকাতা শেষ আপডেট: ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ১৯:১১
Share:

মানিক ভট্টাচার্যের সঙ্গে এক ফ্রেমে তাপস মণ্ডল। নিজস্ব চিত্র।

১১ অক্টোবর ২০২২। প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতিকাণ্ডে গ্রেফতার হন মানিক ভট্টাচার্য। এর ৪ দিন পরই, অর্থাৎ, ১৫ অক্টোবর সল্টলেকের মহিষবাথানে একটি অফিসে তল্লাশি চালিয়েছিল এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি)। উদ্ধার করা হয় বেশ কিছু নথি। ওই অফিসে তল্লাশির পরই খবরের শিরোনামে উঠে আসেন মানিক-‘ঘনিষ্ঠ’। যাঁর নাম তাপস মণ্ডল। রবিবার এই দুর্নীতিকাণ্ডে সেই তাপসকে গ্রেফতার করল সিবিআই।

Advertisement

পলাশিপাড়ার তৃণমূল বিধায়কের গ্রেফতারের পর থেকেই আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে উঠে আসেন তাপস। নিয়োগে দুর্নীতিতে কী ভাবে টাকার লেনদেন হত, সে নিয়ে একাধিক বার মুখ খুলে শোরগোল ফেলেছেন তিনি। এত দিন ইডি এবং সিবিআই— একাধিক বার দুই কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার জিজ্ঞাসাবাদের মুখোমুখি হয়েছেন। টাকা নেওয়ার কথা স্বীকারও করেছেন। আবার টাকা লেনদেনে মানিকের বিরুদ্ধেও মুখ খুলেছেন তাপস।

দুর্নীতিতে কী ভাবে যুক্ত হলেন তাপস? বেসরকারি কলেজ সংগঠনের ‘মাথা’ তাপস। ইডির আইনজীবী আদালতে দাবি করেছেন, ‘‘তাপস না থাকলে মানিক হত না, মানিক না থাকলে দুর্নীতি হত না।’’ শোনা যায়, রাজ্যের প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গেও নাকি একদা ‘সুসম্পর্ক’ ছিল তাপসের। মানিকের ‘ঘনিষ্ঠ’ বলেই পরিচিত তিনি। চাকরির জন্য অনেকেই তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করতেন বলে নিজেই দাবি করেছেন তাপস।

Advertisement

উত্তর ২৪ পরগনার বারাসতের বাসিন্দা তাপসের আদি বাড়ি পূর্ব মেদিনীপুরের পাঁশকুড়ায়। স্থানীয়দের দাবি, এক সময় সিপিআই কর্মী ছিলেন তিনি। আশির দশকে যোগ দেন মার্ক্সসিস্ট ফরওয়ার্ড ব্লকে। পরবর্তী সময়ে মানিক-পার্থের সঙ্গে ‘ঘনিষ্ঠতা’ বাড়ে তাপসের। বর্তমানে ট্রাস্ট চালান। সেই ট্রাস্টের অধীনে রয়েছে একাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে ‘মিনার্ভা এডুকেশনাল ওয়েলফেয়ার সোসাইটি’র অফিস রয়েছে মহিষবাথানে। সেখানেই তল্লাশি চালিয়েছিল ইডি। তাপসের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সূত্রেই মানিকের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ তৈরি হয়। তাপসের বারাসতের বাড়িতেও তল্লাশি চালানো হয়েছিল। সেখান থেকেই ডায়েরি উদ্ধার করা হয়েছিল। ‘মিনার্ভা’ সংস্থার নামে কলেজ স্ট্রিটের ঠিকানায় হানা দিয়েছিলেন তদন্তকারীরা। কিন্তু সেখানে কোনও এই নামে অফিস নেই বলে জানান তাঁরা। রাজ্য ডিএলএড কলেজ ইউনিয়নের সভাপতি ছিলেন তাপস। এ ছাড়া, ‘অল বেঙ্গল টিচার্স ট্রেনিং অ্যাচিভার্স অ্যাসোসিয়েশন’-এরও সভাপতি ছিলেন। ইডির অভিযোগ, চাকরি দেওয়ার নামে অনেক চাকরিপ্রার্থীর কাছে টাকা নিয়েছেন তাপস। এমনকি, উচ্চপ্রাথমিকে চাকরি দেবেন বলেও অনেকের কাছ থেকে ‘অগ্রিম’ টাকা নিয়েছেন। কিন্তু সেই প্যানেল তৈরি না হওয়ার কারণে চাকরি দিতে পারেননি বলে অভিযোগ।

দুর্নীতির কারবারে তাঁর নাম উঠে আসার পর থেকেই একাধিক বার সংবাদমাধ্যমে মুখ খুলেছেন তাপস। মানিকের বিরুদ্ধেও মুখ খুলেছেন তিনি। দাবি করেছেন, ‘‘লোক পাঠিয়ে টাকা সংগ্রহ করতেন মানিক ভট্টাচার্য।’’ ইডি সূত্রে খবর, ২০১৮ সাল থেকে ২০২২ পর্যন্ত তিনটি শিক্ষাবর্ষে টেটের জন্য ডিএলএড প্রশিক্ষণ নিতে ইচ্ছুক ছাত্রছাত্রীদের থেকে নিয়মিত ভাবে টাকা নেওয়া হয়েছে। মূলত ডিএলএড প্রশিক্ষণের যে ৬০০টি কলেজ রয়েছে, সেখানে অফলাইনে ভর্তির জন্যই নেওয়া হত ওই অর্থ। ইডি জানিয়েছিল, প্রশিক্ষণ নিতে ইচ্ছুক যে শিক্ষার্থীরা অনলাইনে রেজিস্ট্রেশনের জন্য নির্ধারিত তারিখে রেজিস্ট্রেশন করাতে পারতেন না, তাঁদের নামই অফলাইনে নথিভুক্ত করার ব্যবস্থা করে দিতেন মানিক। বিনিময়ে মাথাপিছু নেওয়া হত ৫ হাজার টাকা। ইডির দাবি, এ ভাবে আনুমানিক ২০ কোটি টাকা তোলা হয়েছে বলে জানান তাপস। অফলাইন রেজিস্ট্রেশনের জন্য টাকা নেওয়া হত। সেই লেনদেন হত মহিষবাথানে তাপসেরই একটি অফিসে। তবে ওই টাকা মানিকের কাছ থেকে কোথায় যেত, তা তাঁর জানা নেই।অনলাইন ক্লাস নিয়ে টাকা গরমিলের সন্দেহের ভিত্তিতেও তাপসকে তলব করা হয়েছিল। এবিটিটিএএ-এর আওতায় অনেক কলেজ রয়েছে যে কলেজগুলিতে ডিএলএড-এর কোর্স করানো হয়। করোনার সময় স্কুল-কলেজ বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর এবিটিটিএএ-র পক্ষ থেকে ডিএলএড-এর ৪০ হাজার পড়ুয়ার জন্য মাথা পিছু ৫০০ টাকার বিনিময়ে অনলাইন ক্লাসের ব্যবস্থা করা হয়। সেই অনলাইন ক্লাসগুলির পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয় টালিগঞ্জের এক সংস্থাকে। প্রায় ২কোটি টাকায় এই চুক্তি হয় বলেও ইডি সূত্রে জানা গিয়েছিল।

নিয়োগে দুর্নীতিতে টাকা লেনদেনে মানিক-ঘনিষ্ঠের এ হেন ভূমিকা যখন খতিয়ে দেখছেন তদন্তকারীরা, ঠিক সেই সময় এক বার সিবিআই দফতর থেকে বেরিয়ে তাপস দাবি করেছিলেন যে, হুগলির বলাগড়ের যুব তৃণমূল নেতা কুন্তল ঘোষকে ১৯ কোটি টাকা দিয়েছিলেন। এর পরই উঠে আসে কুন্তলের নাম। গত ২১ জানুয়ারি কুন্তলের গ্রেফতারের পর আবার শিরোনামে উঠে আসেন তাপস। গ্রেফতারের পরই সংবাদমাধ্যমে কুন্তল অভিযোগ করেন, ‘‘তাপস মণ্ডল আমার কাছে ৫০ লক্ষ টাকা ঘুষ চেয়েছিলেন। ঘুষ না দেওয়ার কারণেই আমার এই হাল।’’ যদিও কুন্তলের এই অভিযোগ উড়িয়ে তাপস দাবি করেছিলেন, ‘‘আমি কেন ঘুষ নিতে যাব! যে টাকা নিয়েছে (কুন্তল), সে টাকা ফেরত চাইব না?’’ বস্তুত, নিয়োগ দুর্নীতিতে কুন্তলের ‘যোগসাজশ’-এর কথা বেসরকারি কলেজ সংগঠনের নেতা তাপসই জানান বলে দাবি করেছেন তদন্তকারীরা। কুন্তল এবং তাপসের অভিযোগ পাল্টা অভিযোগের মধ্যে উঠে এসেছে গোপাল দলপতি নামে এক ব্যক্তির নাম। গোপাল তাঁর পরিচিত বলে দাবি করেছেন তাপস। কুন্তল বর্তমানে জেলবন্দি। তদন্তকারীদের জিজ্ঞাসাবাদের মুখোমুখি হয়েছেন গোপালও। এই আবহে এ বার হাতকড়া পরানো হল তাপসকে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement