লটারি খেলার নেপথ্যে কালো টাকা সাদা করার খেলা চলে বলে উঠছে অভিযোগ। —ফাইল চিত্র।
লটারির টিকিটে কোটি টাকা জেতা নিয়ে সম্প্রতি বিতর্ক তৈরি হয়েছে রাজ্য রাজনীতিতে। সেই আবহেই পূর্ব মেদিনীপুর জেলায় অভিযোগ উঠল, লটারির টিকিটের ব্যবসার সঙ্গে জুড়ে রয়েছে একটি চক্র। যে চক্র কালো টাকা সাদা করার ‘যন্ত্র’ হিসাবে কাজ করে। লটারির টিকিট কাটেননি, এমন ব্যক্তিও প্রথম পুরস্কার জেতা ওই টিকিটে কোটিপতি হয়ে যেতে পারেন! হচ্ছেনও। সেখানেই ওই চক্রের ‘হাতযশ’।
এমনটা যে ঘটে, তা মেনে নিয়েছেন জেলার পুলিশ সুপার অমরনাথ কে-ও। তাঁর কথায়, ‘‘এমন চক্রের বিষয়ে আমাদের কাছেও খবর রয়েছে। বিভিন্ন এলাকায় নজরদারি রয়েছে। আমরা নজরদারি চালাচ্ছি। প্রমাণ পেলেই কড়া এবং আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’’ লটারির ব্যবসার সঙ্গে যাঁরা ওতপ্রোত ভাবে জড়িত, তাঁরাও জানেন, এই জগতে একটি চক্র রয়েছে। জেলার লটারি-বাজার ঘুরেও বোঝা গেল সেই ধারণার সারবত্তা।
জেলার বিভিন্ন এলাকায় ঢুঁ মেরে দেখা গেল, ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠেছে লটারির দোকান। স্রেফ একটি চেয়ার-টেবিল সম্বল করেই চলছে কোটি কোটি টাকার লেনদেন। ভাগ্যের সন্ধানে এই ব্যবসায় নাম লিখিয়েছেন অনেকে। আবার রাতারাতি কোটিপতি হওয়ার নেশায় ঝাঁকে ঝাঁকে মানুষ আসছেন লটারির টিকিট কাটতে। দৈনন্দিন ‘ভাগ্যপরীক্ষা’য় অনেকে সর্বস্বান্ত হয়েছেন বলে স্থানীয়দের দাবি। কেউ কেউ সেই দেনার দায়ে আত্মঘাতী হয়েছেন বলেও অভিযোগ। আবার এই লটারিই রাতারাতি পাল্টে দিয়েছে অনেকের ভাগ্য।
কিন্তু এই লটারি ব্যবসার অন্দরেই লুকিয়ে আছে এক ঘূর্ণি। সেই ঘুরপাকেই টিকিট হস্তান্তরিত হয়ে যাচ্ছে বিপুল টাকার বিনিময়ে। লটারি ব্যবসায়ীদের একাংশের দাবি, অনেকেই কালো টাকা সাদা করতে বেছে নিয়েছেন এই ব্যবসাকে। বিষয়টি বোঝালেন নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক কাঁথির এক লটারি ব্যবসায়ী। আনন্দবাজার অনলাইনকে তিনি বলেছেন, ‘‘এই ব্যবসায় একটা চক্র কাজ করে। যখনই জানা যায়, কেউ লটারিতে ১ কোটি টাকা জিতেছেন, তাঁর কাছে দ্রুত পৌঁছে যান ওই চক্রের সদস্যেরা। ১ কোটি টাকা জিতলে আয়কর দিয়ে প্রায় সাড়ে ৭২ লাখ টাকা হাতে পান বিজেতারা। সেখানে ৮০ লাখ বা কখনও ১ কোটি টাকা নগদ দিয়েই ওই টিকিট কিনে নেওয়া হয় বিজেতার থেকে। এর পর সেই টিকিট বিক্রি হয় তাঁদের কাছে, যাঁরা কালো টাকা সাদা করতে চান। এই ক্ষেত্রে ওই টিকিট দেখিয়ে লটারি আয়োজকদের কাছ থেকে ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে নেওয়া হয় টাকা।’’
বিষয়টি আরও বিশদে ব্যাখ্যা করেছেন মহিষাদলের এক লটারি ব্যবসায়ী। তাঁর কথায়, ‘‘দিনে তিন বার লটারি খেলা হয়। প্রতিটি টিকিট বিক্রি করে কমিশন পাওয়া যায় ৫০ পয়সা। এক জন ব্যবসায়ী লটারির টিকিট বিক্রি করে মাসে ৬ থেকে ৭ হাজার টাকা রোজগার করেন। এর বাইরেও দোকান থেকে বিক্রি হওয়া টিকিটে পুরস্কার জিতলে মেলে বাড়তি কমিশন। কেউ ১ কোটি টাকা জিতলে বিক্রেতা কমিশন হিসাবে পান ১ লাখ টাকা। তবে বড় অঙ্কের পুরস্কার পাওয়া গেলে বিজেতার কাছ থেকেও অতিরিক্ত কিছু টাকা পাওয়া যায়। কিন্তু যাঁরা জয়ী টিকিট হাতবদল করে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ করে দেন, তাঁদের এক লপ্তে রোজগার হয় ৫ থেকে ১০ লাখ টাকা। কখনও কখনও তারও বেশি। আসলে টিকিট বিক্রির সময় ক্রেতার কোনও পরিচয়পত্র নথিভুক্তি করার নিয়ম এখনও পর্যন্ত নেই। সেই সুযোগকে কাজে লাগিয়েই কালো টাকা সাদা করে নেওয়া সম্ভব হয়।’’
লটারিতে কারা প্রথম পুরস্কার পাচ্ছেন সে দিকে নজরদারি রয়েছে চক্রের মাথাদের। — ফাইল চিত্র
মহিষাদলের ওই ব্যবসায়ী জানালেন আরও একটি তথ্য। চলতি বছরের ২ জুন মহিষাদলে ‘ডিয়ার লটারি’তে কোটি টাকা জেতেন এক যুবক। পেশায় তিনি শ্রমিক। চক্রের পাণ্ডারা ওই যুবকের কাছ থেকে ৮০ লাখ টাকার বিনিময়ে টিকিটটি কিনে নেন। এর পর ওই যুবক স্থানীয় একটি বেসরকারি ব্যাঙ্কের শাখায় টাকা জমা করতে গেলে বাধে বিপত্তি। এত পরিমাণ নগদ টাকা কোন পথে তিনি রোজগার করেছেন, তার উত্তর দিতে জেরবার হন তিনি। মহিষাদলের ওই ব্যবসায়ীর কথায়, ‘‘এক শ্রেণির লটারি ব্যবসায়ীর সঙ্গে যোগসাজশ রয়েছে ওই চক্রের। সেই সব ব্যবসায়ীদের কাছেই তারা নিয়মিত খোঁজ নেয়, কারা লটারিতে মোটা টাকার পুরস্কার জিতছেন। কোথায় তাঁদের বাড়ি। খবর নিয়েই বাঁকা পথে কালো টাকা সাদা করতে ময়দানে নামেন চক্রের পাণ্ডারা।’’
লটারি ব্যবসায়ীদের একাংশের দাবি, অনেকে আবার নিজেদের টিকিট বেশি দামে ওই চক্রের কাছে বিক্রি করে টাকাটা ব্যাঙ্কে রাখেন না। অন্য কোনও কাজে লাগিয়ে ফেলেন। তাতে সরাসরি প্রমাণও থাকে না টাকার উৎসের। তমলুকের এক লটারি ব্যবসায়ীর কাছে এমন চক্রের কথা জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, ‘‘চক্র তো আছেই। আপনার আশেপাশেই ওই চক্রের লোকজন ঘোরাফেরা করছে। আপনাকে খুঁজে নিতে হবে না। আপনি লটারিতে টাকা পেলেই ওঁরা আপনার কাছে পৌঁছে যাবে।’’
লটারি জিতে কোটি টাকা পুরস্কার পাওয়া নিয়ে সম্প্রতি প্রশ্ন তুলেছেন বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী। এর আগেও তিনি সরব হয়েছিলেন এ বিষয়ে। তবে শুভেন্দুর অভিযোগটি মূলত ‘রাজনৈতিক’। সম্প্রতি লটারিতে ১ কোটি টাকা পুরস্কার জিতেছিলেন জোড়াসাঁকোর তৃণমূল বিধায়ক বিবেক গুপ্তের স্ত্রী রুচিকা। তার পরেই শুভেন্দু টুইট করে অভিযোগ তোলেন, ‘‘এটা টাকা পাচারের সহজ উপায়।’’ বিধায়ক বিবেক যদিও জানিয়েছিলেন, যে লটারির টিকিট কেটে এক কোটি পুরস্কার জিতেছেন তাঁর স্ত্রী, সেটি নাগাল্যান্ড সরকারের। তাঁর পাল্টা প্রশ্ন ছিল, ‘‘লটারি জিতে এক কোটি টাকা পাওয়াটা কি অন্যায়? না কি টিকিট কাটা?’’
শুভেন্দু এর আগে অভিযোগ তুলেছিলেন বীরভূমের জেলা তৃণমূল সভাপতি অনুব্রত মণ্ডলের বিরুদ্ধেও। তিনিও নাকি ১ কোটি টাকা পেয়েছিলেন। যদিও অনুব্রত তা নিয়ে কোনও মন্তব্য করেননি। সম্প্রতি লটারিতে ১ কোটি টাকা জিতেছেন বীরভূমের নলহাটির তৃণমূল বিধায়ক রাজেন্দ্রপ্রসাদ সিংহের ভ্রাতৃবধূ। লটারি খেলার আয়োজকদের ওয়েবসাইটে সে তথ্য রয়েছে। নেটমাধ্যমে সে ছবিও ভাইরাল। যদিও এ নিয়ে নীরব ছিলেন ওই তৃণমূল বিধায়ক।
পূর্ব মেদিনীপুরের পুলিশ সুপার অমরনাথ কে-র বক্তব্য, ওই চক্রের কথা তাঁর গোচরে রয়েছে। তিনি বলেন, ‘‘এমন চক্রের বিষয়ে আমাদের কাছেও খবর রয়েছে। বিভিন্ন এলাকায় নজরদারি রয়েছে। কাঁথি থানার একটি মামলার ভিত্তিতে রাখাল বেরা নামের এক জনকে কলকাতা থেকে গ্রেফতার করা হয়। চাকরি দেওয়ার নামে প্রতারণার অভিযোগে তাঁকে গ্রেফতার করা হয় গত বছর। পরে আয়করের ফাইলে দেখা যায়, লটারি থেকে পুরস্কারের টাকা ঢুকেছে ওই ব্যক্তির অ্যাকাউন্টে। আমরা এমন ঘটনার উপর নজরদারি চালাচ্ছি। প্রমাণ পেলেই কড়া এবং আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’’