(বাঁ দিকে) নবান্ন সভাঘরে আন্দোলনকারী জুনিয়র ডাক্তারেরা, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় (ডান দিকে)। ছবি: ফেসবুক।
বিকেল ৪টে ১৮ মিনিট। ধর্মতলার অনশনমঞ্চের কাছ থেকে রওনা দিল জুনিয়র ডাক্তারদের বাস।
বিকেল ৪টে ২৯। নবান্নে পৌঁছল জুনিয়র ডাক্তারদের প্রতিনিধিদল। কথা ছিল, সাড়ে ৪টের মধ্যে পৌঁছতে হবে।
বিকেল ৪টে ৫৯। নবান্ন সভাঘরে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে বৈঠক শুরু। কথা ছিল, ৫টায় শুরু হবে বৈঠক।
এবং, বৈঠকের শুরুতেই চমক! ‘লাইভ স্ট্রিমিং’। সরাসরি সম্প্রচার। যা নিয়ে দর কষাকষিতেই কার্যত তিন-তিনটে মিটিং ভেস্তে গিয়েছিল।
এবং, এই প্রথম নির্ধারিত সময়ে (বরং একটু আগেই) শুরু হল বৈঠক।
শুরুতেই বোঝা গিয়েছিল জেদাজেদি নয়, সরকার এবং জুনিয়র ডাক্তার— উভয় পক্ষই অচলাবস্থা কাটানোর ব্যাপারে আন্তরিক এবং উদ্যোগী। বৈঠকে তর্ক-বিতর্কও হয়েছে কিছু বিষয়ে, কিন্তু বিরোধের পরিবেশ দেখা দেয়নি কখনও। মুখ্যমন্ত্রীর ‘শোনো বাবা’র মতো স্নেহস্পর্শ থেকে শুরু করে ডাক্তারদের ‘রাগ করবেন না ম্যাডাম’-এর মতো টুকরো টুকরো ধ্বনি পারস্পরিক সম্মান আর মর্যাদার ছবিই তুলে ধরেছে গোটা বৈঠক জুড়ে। দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল, জেতা-হারার লড়াই নয়, আলোচনা করে পরস্পরকে বোঝার চেষ্টা করা, সমস্যা মেটানোর দিকে আগ্রহ দেখাচ্ছেন দু’পক্ষই।
গত শনিবারই মোটামুটি স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল, স্বাস্থ্যসচিব নারায়ণস্বরূপ নিগমকে অপসারিত করার দাবি ছাড়া জুনিয়র ডাক্তারদের সব দাবিই কমবেশি মেনে নিতে চলেছে নবান্ন। সে দিন মমতার সঙ্গে আন্দোলনকারীদের টেলিফোনে কথোপকথনের আনুষ্ঠানিক রূপরেখা তৈরি হয়ে যাওয়ার কথা ছিল সোমবার। বৈঠকের শুরুতেই জুনিয়র ডাক্তারদের বলতে দেন মুখ্যমন্ত্রী। পর পর নিজেদের দাবি তুলে ধরেন আন্দোলনকারীরা। ধৈর্য ধরে প্রত্যেকের বক্তব্য মমতা শুনেছেন। তার পর নিজে না-বলে মুখ্যসচিব মনোজ পন্থকে বলেন ডাক্তারদের দাবি নিয়ে সরকারি অবস্থান স্পষ্ট করতে। মমতা নিজে বলতে গিয়ে বেশ কয়েক বারই জুনিয়র ডাক্তারদের বিভিন্ন বক্তব্যকে সরাসরি সমর্থন করেছেন। কোনও কোনও অধ্যক্ষ যে সঙ্কীর্ণ দলীয় রাজনীতির সঙ্গে জড়িত, মমতা তা প্রকাশ্যেই স্বীকার করেন।
অতীতে সব মিটিংয়েই জনা তিরিশেক প্রতিনিধি নিয়ে গিয়েছেন জুনিয়র ডাক্তারেরা। এ দিন তাঁরা সংখ্যাটা ১৭য় নামিয়ে আনেন। আবার নবান্ন বলেছিল ১০ জনের প্রতিনিধি দলকে যেতে। শেষ পর্যন্ত ‘সংখ্যা’ কোনও সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়নি বৈঠক শুরু করার ক্ষেত্রে। যেমন সমস্যা দেখা দেয়নি নবান্নের ‘শর্ত’ মেনে অনশন না-তুলেই আন্দোলনকারীদের বৈঠকে চলে যাওয়া নিয়েও।
সমস্যা হয়নি বৈঠকের সময়সীমা নিয়ে। ৪৫ মিনিটের বৈঠক স্থির ছিল। বৈঠকের পর এক কন্যাহারা পরিবারের সঙ্গে তিনি দেখা করবেন বলে গোড়াতেই জানিয়ে রেখেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। কিন্তু নবান্নের আলোচনা গড়িয়ে যায় ২ ঘণ্টা ৮ মিনিট পর্যন্ত। মুখ্যমন্ত্রী শেষ দিকে একটু তাড়া দিলেও বৈঠক ছেড়ে বেরিয়ে যাননি।
সব মিলিয়ে এক দিকে যেমন ‘দাবিদাওয়া চাহিদায়’ টানটান ছিল বৈঠক, পাশাপাশি, কাঠখোট্টা আনুষ্ঠানিকতার বাইরে গিয়ে সৌহার্দ্যের ছবিও দেখাল নবান্নের ‘লাইভ স্ট্রিমিং’।
এই বৈঠকের পর আরজি করের নির্যাতিতার মা এবং বাবার অনুরোধে অনশন আন্দোলন প্রত্যাহার করা হল। আন্দোলনকারীদের অন্যতম মুখ দেবাশিস হালদার এই সিদ্ধান্ত ঘোষণা করার আগে জানান, অনেক দাবি মেনে নিলেও, বৈঠকে সরকারের 'শরীরী ভাষা' তাঁদের ভাল লাগেনি। যে যে বিষয়ে জুনিয়র ডাক্তারেরা লিখিত নির্দেশিকা চেয়েছেন, তা মঙ্গলবার দুপুর ৩টের মধ্যে ইমেল করে পাঠিয়ে দিতে মুখ্যসচিবকে বলেছেন মুখ্যমন্ত্রী। সে দিকেও তাকিয়ে আন্দোলনকারীরা।
সেই সময় অনশনমঞ্চ ঘিরে উপস্থিত জনতার মধ্যে প্রতিক্রিয়া ছিল নানা ধরনের। কেউ চাইছিলেন অনশন চালিয়ে যাওয়া হোক। কারও মতে তখনই অনশন তোলা উচিত। নবান্নের বৈঠক শেষ হওয়ার পর কিছু টুকরো টুকরো মন্তব্য:
* সরকার ১০ দফা দাবির সবটা তো মানেনি। ছাড়া উচিত নয়।
* সরকার অধিকাংশ দাবি মেনেছে। অনশনকারীদের বলি দেবেন না।
* অত ম্যাডাম ম্যাডাম করার কী দরকার ছিল?
* উনি এই মিটিংয়ে থাকলে কী সম্বোধন করতেন?
* আন্দোলনটা শেষ হয়ে গেল।
* যাঁরা বলছেন শেষ, তাঁরা এ বার অনশনে বসুন না।
* জুনিয়র ডাক্তারেরা বিপ্লব করতে নামেননি। যা করেছেন, সেটা সময় মনে রাখবে।
* প্রশাসনের এ কী ভূমিকা? খুব হতাশ লাগছে। অনশন তুলে নতুন করে আন্দোলনের পথ বার করতে হবে।
এমন আরও বহু মতামত, বহু ধরনের মতামত অনশনমঞ্চ ঘিরে ছিল। তবে আন্দোলনকারীরা অনশন তোলায় স্বস্তি পাওয়া সমর্থকের সংখ্যাই বেশি।