অনশন প্রত্যাহার হবে কি না, সে নিয়ে শুরু হয়েছে বৈঠক। নিজস্ব চিত্র।
অনশনকারী স্পন্দন চৌধুরী বলেন, ‘‘কোনও ছাত্র শিক্ষকের অপমান সহ্য করতে পারে না। আজ সেটা বৈঠকে আপনারা দেখলেন।’’
অনিকেত মাহাতো বলেন, ‘‘অভয়ার জন্য আমাদের লড়াই চলবে। আমাদের আন্দোলন দীর্ঘস্থায়ী হবে। শনিবার আরজি করে গণ কনভেনশন থেকে সিদ্ধান্ত জানানো হবে।’’
অনশন প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত জানানোর পর পরিচয় পণ্ডা বলেন, ‘‘আমি বাংলার মানুষের কাছে বলতে চাই, যাঁদের সিবিআই বার বার ডেকে পাঠায়, আর্থিক তছরুপের অভিযোগ ওঠে, তাঁদের সাসপেনশনের জন্য পদক্ষেপ করতে গিয়েও থ্রেট কালচার দেখেছি।’’
‘‘আমরণ অনশন প্রত্যাহার করে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার কথা বলেছেন কাকু-কাকিমা (নির্যাতিতার মা-বাবা)। তাই অনশন প্রত্যাহার সিদ্ধান্ত নিয়েছি আলোচনার পর। কিন্তু অভয়ার বিচারের জন্য রাস্তায় থাকব। সরকার বা সর্বোচ্চ প্রশাসনের কথায় নয়, অনশন প্রত্যাহার করছি শুধুমাত্র কাকু-কাকিমা এবং সাধারণ মানুষের কথা ভেবে। যেন ভাবা-না হয় আপস করা হল। বিচারের দাবি আরও জোরালো হবে। এই অকর্মণ্য প্রশাসনকে হুঁশিয়ারি দিরে রাখলাম— সাবধান।’’
‘‘আমরা অনশনমঞ্চে বসে দেখলাম, অধ্যক্ষদের বলে দেওয়া হল কার্যত তোমাদের কোনও ক্ষমতা নেই। যে অ্যকাডেমিক কাউন্সিল পড়াশোনার ভার নেয়, তাদের বলা হল তোমাদের ক্ষমতা নেই। উনি সবাইকে অপমান করলেন। বোঝালেন এ রাজ্যে ক্ষমতা কেবল তাঁদেরই। আর কারও ক্ষমতা নেই। আমরা যে যুক্তিতে দাবি জানালাম, উনি চারটে অধ্যক্ষককে তুলে জিজ্ঞেস করেছেন। এতে কিছু বোঝা যায় না। সরকারি হাসপাতালগুলোতে যান। দেখুন, কোথায় ডাক্তার নেই, কোথায় টেকনিশিয়ান নেই। সেখানে ডাক্তারেরা বাধ্য হন রোগীকে কলকাতার হাসপাতালে রেফার করতে। উনি বললেন, কেন্দ্রের কাছে লজ্জায় পড়তে হচ্ছে। কিন্তু যে ৩৫টি হাসপাতালের কথা বললেন, তাদের বেহাল দশার কথা জানেন চিকিৎসকেরা, রোগীরা এবং তাঁদের পরিজনেরা। ওখানে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার বেহাল দশা ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা হল ভূরি ভূরি সাজানো কথা বলে।’’
মাইক হাতে নিয়ে রুমেলিকা কুমার বলেন, ‘‘ন্যায় বিচারের দাবিতে লড়াইয়ের ৭৩ দিন পূর্ণ হবে। ১৭ দিন অনশনের। শুধুমাত্র জল খেয়ে জীবন বাজি রেখে কয়েক জন লড়াই করছিলেন। কোথাও গিয়ে লজ্জা লাগে, হতাশ লাগে, যখন দেখি রাজ্যের সর্বাধিক স্তরে যিনি আছেন, তিনি জানান, ১০ দফা দাবি নিয়ে তাঁর কাছে স্পষ্ট তথ্য নেই। লজ্জা লাগে, ভয় হয় যখন দেখি, আমাদের অনশনমঞ্চের পাশ দিয়ে পুজোর কার্নিভাল যাচ্ছে। ডান্ডিয়া নৃত্য হচ্ছে। তবুও আশায় থাকি। কাকুতি-মিনতি করি, ম্যাডাম এক বার আসুন। তার পর দু’দিন না-খেয়ে থাকি। যে লাইভ স্ট্রিমিংয়েরদাবি ছিল, সেটা আজ গিয়ে দেখি করা হল। আমরা শিরদাঁড়া সোজা রেখেছি। কিন্তু গিয়ে জানলাম, আমরা শুনতে গিয়েছি! বলতে নয়!’’
অনশনকারী জুনিয়র ডাক্তার অর্ণব আরও বলেন, ‘‘যদি দরকার পড়ে আবার যদি আমরণ অনশনে বসতে হয়, বসব। অভয়ার ন্যায়বিচারের জন্য আবার অনশনে বসতে হলে বসব। ওঁর বাবা-মায়ের অনুরোধে অনসন প্রত্যাহার করছি। গণ কনভেনশনের যে আহ্বান আমরা করেছি, তাতে সবাইকে যোগ দেওয়ার আহ্বান জানাচ্ছি। আমাদের প্রধান লক্ষ্য অভয়ার ন্যায়বিচার। সেই লড়াই জারি থাকবে। উই ওয়ান্ট জাস্টিস।’’
‘‘সুপারের অফিসই প্রথমই খুঁজে বেড়ান কেউ। কিন্তু আজ বৈঠকের পরে যে বার্তা গেল তাতে রোগী পরিজনেরা কি সুপারের কাছে না গিয়ে টাস্ক ফোর্সের জন্য অপেক্ষা করবেন। আগে আরজি কর নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন দুর্নীতির কথা উনি জানতেন না।’’
অনশনকারী জুনিয়র ডাক্তারদের মধ্যে অর্ণব বলেন, ‘‘আমি একটা কথা বলতে চাই, স্বাধীনতার পরে গণতন্ত্র বলতে যা বুঝি... সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে একটা দুঃখজনক জিনিস দেখতে পেলাম। বৈঠকে মেডিক্যাল প্রতিষ্ঠানদের প্রতিনিধিদের চুপ করিয়ে দেওয়া হল। সায়ত্ত্বশাসনের অধিকার কী ভাবে খর্ব করা হল তা দেখতে পেলাম। আমরা ডাক্তারি ছাত্র। প্রতিষ্ঠান, কর্মক্ষেত্রের প্রতি আমাদের ভালবাসা। কিন্তু প্রতিষ্ঠানের প্রতি অপমান আমাকে কষ্ট দিয়েছে। পরে যদি এক জন মহিলা সহকর্মীর সঙ্গে একটা ঘটনা ঘটে, তিনি কি পিছিয়ে যাবেন এটা ভেবে যে গ্রিভান্স সেলের তো অধিকার নেই।’’
অনশনকারী জুনিয়র ডাক্তারদের মধ্যে অর্ণব মুখোপাধ্যায় মাইক হাতে নেন। তাঁর আগে নির্যাতিতার বাবা বলেন, ‘‘এঁদের জন্য এক দিন না এক দিন আমার মেয়ের জন্য ন্যায়বিচার ঠিক ছিনিয়ে আনব।’’
‘‘সরকার হয়তো ভাববে আমরা সাধারণ মানুষের কথা ভেবেই আমরা আন্দোলন করছি। সাধারণ মানুষের কথা আমরাই ভাবছি। আমরাই ভাবব। তাই এই অনশন প্রত্যাহার করলাম। আগামিদিনের কর্মসূচি হিসাবে ঘোষণা করছি, আগামী শনিবার মহাসমাবেশ ডাকছি। আরজি কর মেডিক্যাল কলেজে সেটা হবে।’’
‘‘আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, আন্দোলন চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার। আমাদের লড়াইকে আরও সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার অঙ্গীকার নিয়ে অনশন তুলছি।’’
‘‘আমরা জানি না, ভুলিয়ে দেওয়ার জন্য কথা বলা হল কিনা! তবে ম্যান পাওয়ার যদি না আসে, সার্বিক প্রশাসনিক সিস্টেম যদি ঠিক-না হয় তাহলে কিছু হবে না। আরজি-কর কাণ্ডে নির্যাতিতার বাবা-মা এসেছেন। তাঁরা রিকোয়েস্ট করছেন। তাঁরা জানাচ্ছেন, তাঁরা এক সন্তান হারিয়েছেন। সরকারের কথা সদ্র্থক যে লেগেছে তা নয়। কিন্তু অনশনরতদের কারও কিছু যেন না-হয়। তাঁরা এক সন্তান হারিয়েছেন। যাঁদের জন্য অনশন করছেন।’’
‘‘বৈঠকে প্রশাসনের শরীরী ভাষা পছন্দ হয়নি। পরীক্ষার খাতা দেখা হবে বলে থ্রেট দেওয়া হয়েছে। ওঁদের ভূমিকা ইতিবাচক ছিল না।’’
জুনিয়র ডাক্তার এবং মুখ্যমন্ত্রীর বৈঠক প্রসঙ্গে অনশনমঞ্চ থেকে দেবাশিস বলেন, ‘‘আমরা চেয়েছিলাম, যত বেশি কেন্দ্রীভূত করা যায় একটা সিস্টেমকে। কিন্তু স্বাস্থ্যসচিবকে নিয়ে আমাদের কথা শোনা হয়নি।’’
দেবাশিস হালদার আরও বলেন, ‘‘যাঁরা সেখানে ছিলেন, এমনকি, আরজি করের অধ্যক্ষকে চুপ করিয়ে দেওয়া হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, তিনি কেন জানতে পারেননি ৪৭ জনের শাস্তির বিষয়ে। থ্রেট কালচার নিয়ে কথা বলায় মুখ্যমন্ত্রী রীতিমতো ধমক দিয়ে চুপ করিয়ে দিয়েছেন।’’ বৈঠক প্রসঙ্গে তিনি এ-ও বলেন, আন্দোলনের মাধ্যমে নির্বাচনের দাবি ছিনিয়ে এনেছি।’’
জুনিয়র ডাক্তার দেবাশিস হালদার বলেন, ‘‘অভয়ার ন্যায় বিচারের জন্য আন্দোলন চলছে। সেখানে এত কমিটি নিয়ে কেন কথা হল, প্রশ্ন উঠেছে। আমাদের স্পষ্ট করে দেওয়া প্রয়োজন যে আর একটা আরজি-কর কাণ্ড যাতে না-হয় সে জন্য উদ্যোগ নিয়েছি। আমরা সে জন্য লড়াই করছি। সে জন্যই নির্বাচনের কথা বলেছি, অভিযোগ জানানোর ব্যবস্থা করার কথা বলেছি।’’
অনশন উঠবে কি? সাংবাদিকদের মুখোমুখি ডাক্তারেরা। বলতে শুরু করলেন জুনিয়র ডাক্তার দেবাশিস হালদার। তিনি জানান, না চাইতেও লাইভ স্ট্রিমিং করা হয়েছে। তা ভাল সিদ্ধান্ত।
১০ দফা দাবি নিয়ে সোমবার নবান্নে গিয়েছিল জুনিয়র ডাক্তারদের একটি প্রতিনিধি দল। ১৭ জন জুনিয়র ডাক্তারের সঙ্গে বৈঠক করেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ছিলেন রাজ্য সরকারের পদস্থ আধিকারিকেরা। তার পরে অনশনমঞ্চে ফিরে এসেছেন ডুনিয়র ডাক্তারেরা।