শান্তনু বন্দ্যোপাধ্যায়। ফাইল চিত্র।
বছর পনেরো আগে তিনি যখন রাজ্য বিদ্যুৎ বণ্টন সংস্থায় চাকরি পান, শুরুতে নাকি মই কাঁধে ঘুরতেন! রাস্তাঘাটে সংস্থার প্রযুক্তিগত কাজে দক্ষ কর্মীদের সহযোগিতা করতেন। যুব নেতা হওয়ার পরে ধীরে ধীরে তাঁর রূপ বদলায়। হুগলির বলাগড়ের সোমরাবাজারে তাঁর অফিসপাড়ায় শান্তনু বন্দ্যোপাধ্যায় ক্রমশই হয়ে ওঠেন ‘লাটসাহেব’!
কী ভাবে?
ওই অফিসপাড়ার লোকজন জানিয়েছেন, বেশ কয়েক বছর ধরেই শান্তনু মাসে এক বার অফিসে আসতেন কালো এসইউভি-তে। সঙ্গে দু’জন দেহরক্ষী থাকতেন। দু’-এক জন চেলাও থাকত। স্থানীয় এক জন বলেন, “ওঁকে লাটসাহেব বলব না তো, কী বলব! দেহরক্ষী, চেলা নিয়ে যখন আসতেন, ভাবভঙ্গিই আলাদা। মাসে তো এক বার আসতেন। ওই দুপুরের দিকে।”
ওই অফিসের মই কাঁধে নিয়ে কর্মজীবন শুরু করা শান্তনু কালক্রমে কী করে নিয়োগ দুর্নীতি চক্রের ‘নিয়ন্ত্রক’ হয়ে উঠলেন, সেই তদন্ত চালাচ্ছে ইডি। অনিয়মিত হাজিরা, হাজিরা-খাতায় ইচ্ছেমতো উপস্থিতির সই করা, বেআইনি ভাবে বিপুল সম্পত্তির মালিক হওয়া— বিস্তর অভিযোগ বণ্টন সংস্থার ওই কর্মীর বিরুদ্ধে। শান্তনু যে নিয়মিত কর্মস্থলে যেতেন না, মানছেন তৃণমূলের স্থানীয় নেতারাও। যদিও শান্তনু বার বারই দাবি করেছেন, তিনি নির্দোষ।
শান্তনুর বাবা ছিলেন রাজ্য বিদ্যুৎ বণ্টন সংস্থার সোমরাবাজার গ্রাহক পরিষেবা কেন্দ্রের ‘হেড ক্লার্ক’।
বাবার মৃত্যুর পরে ২০০৮ সালে সেখানে চাকরি পান শান্তনু। স্নাতক স্তরে উত্তীর্ণ না হওয়ায় বাবার চেয়ে নীচের পদে কাজ পান। কাজ শুরু করেছিলেন সংস্থার খানাকুলের অফিসে। কিছু দিনের মধ্যে চলে আসেন সোমরাবাজারে। বর্তমানে তিনি ‘সিনিয়র টেকনিক্যাল সাপোর্ট হ্যান্ড’ বা প্রযুক্তিগত কাজের সহযোগী।
কী কাজ করতে হয় ওই সহযোগীদের? বিদ্যুৎ বণ্টন সংস্থা সূত্রে জানা গিয়েছে, ট্রান্সফর্মার বা মিটারে গোলমাল-সহ নানা ধরনের অভিযোগে পরিদর্শনে যেতে হয় সংস্থার প্রযুক্তিকর্মীদের। সঙ্গে থাকেন সহযোগীরা। কখনও তাঁরা কর্মীদের হাতে সরঞ্জাম এগিয়ে ধরেন, কখনও ওই কর্মীরা উঁচুতে উঠে কাজ করলে মই ধরেন। সোমবারই বেলা আড়াইটে নাগাদ ওই কেন্দ্রে দাঁড়ানো এমনই একটি মোবাইল ভ্যানের পরিদর্শনকারীরা জানালেন, ফিউজ় উড়ে যাওয়ার খবর পেয়ে সেখানে যাচ্ছেন। প্রযুক্তিকর্মীদের পাশাপাশি সহযোগীরাও ছিলেন সেই ভ্যানে।
প্রদেশ কংগ্রেস সদস্য তথা দলের হুগলি জেলা সহ-সভাপতি প্রতুলচন্দ্র সাহা বলাগড়েরই বাসিন্দা। শান্তনুকে চেনেন দীর্ঘদিন। তিনি বলেন, ‘‘প্রথম প্রথম শান্তনুকে ঘাড়ে মই নিয়ে ঘুরতে হয়েছে। নেতা হওয়ার পরে কাজ করতে হত না। কেউ কিছু বলতে পারতেন না বদলির ভয়ে। শাসক দলের বড় নেতার ক্ষমতার আস্ফালন আর কী!’’
বণ্টন সংস্থা সূত্রের খবর, বিদ্যুৎ ভবনের সদর দফতর থেকে জেলার দায়িত্বে থাকা শাখার কাছ থেকে শান্তনুর গ্রেফতারি, ওই কেন্দ্রে তাঁর হাজিরা সংক্রান্ত সব তথ্যের রিপোর্ট চাওয়া হয়েছে। তাদের নিয়মে কোনও কর্মীর ৪৮ ঘণ্টা যে কোনও ধরনের হেফাজত (কাস্টডি) হলে তাঁকে সাসপেন্ড করা হয়। রিপোর্ট পাওয়ার পরে সেই অনুযায়ী পবরর্তী পদক্ষেপ করা হবে।
প্রযুক্তিকর্মীদের সহযোগী পর্যায়ের কর্মীদের বছরে বেতনক্রম ২-৬ লক্ষ টাকা। প্রাথমিক ভাবে জানা যাচ্ছে, শান্তনুর বেতন মাসিক ৩৫ হাজার টাকার মতো ছিল। গত ফেব্রুয়ারি থেকে তাঁর বেতন বন্ধ করে বণ্টন সংস্থা। নিয়োগ দুর্নীতি মামলায় তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদের জেরেই এই সিদ্ধান্ত কি না, তা অবশ্য স্পষ্ট নয়।
শান্তনুর বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ থাকলেও তাঁর বিরুদ্ধে অফিসে কেউ মুখ খুলতেন না। সোমবারেও ওই কেন্দ্রে খোলাখুলি ভাবে কেউ কথা বলেননি। স্টেশন ম্যানেজারের দেখা মেলেনি। তবে, হাজিরা নিয়ে অনিয়মের অভিযোগের প্রেক্ষিতে গত বছরে বণ্টন সংস্থা কিছুটা নড়েচড়ে বসেছিল বলে খবর। সব গ্রাহক পরিষেবা কেন্দ্রে সিসি ক্যামেরা না থাকলেও প্রায় ন’মাস আগে ওই কেন্দ্রে তা বসানো হয়। সিসি ক্যামেরা চালুর পরেও শান্তনুর হাজিরা অনিয়মিত ছিল কি না, জানা যায়নি।
বণ্টন সংস্থা সূত্রের খবর, কেউ ভোটে দাঁড়ালে তাঁকে সংস্থার থেকে ‘নো অবজেকশন’ শংসাপত্র নিতে হয়। সংস্থার প্রত্যেক কর্মীকে প্রতি বছর মার্চ-এপ্রিল নাগাদ মুখবন্ধ খামে জানাতে হয়, সেই বছরের পয়লা জানুয়ারি পর্যন্ত তাঁর এবং তাঁর পরিবারের সম্পত্তির পরিমাণ কত। সেটি যায় সংস্থারই ‘কর্পোরেট ভিজিল্যান্স সেল’-এ। পরে কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলে তখন তা খুলে দেখাই নিয়ম। তথ্যে অসঙ্গতি থাকলে তাঁর বিরুদ্ধে বিভাগীয় তদন্ত শুরু হয়। সংস্থায় চালু কথায় বলে ‘অ্যাসেট’ খোলা। এখন শান্তনুর ক্ষেত্রে কী হয়, সেটাই দেখার।