শেষযাত্রা: বাড়ির পথে ঋষভের দেহ। ছবি: দীপঙ্কর দে
মেয়ের বায়না শোনেননি ভবেশ দাস। শনিবার টিভিই চালাননি।
টিভি চালালেই তো ঋষভের মৃত্যুর খবর। তাঁর একরত্তি মেয়েটা বন্ধুর মৃত্যুর কথা কী ভাবে নেবে ভেবে পাচ্ছিলেন ভবেশ। দিনভর একই রকম উদ্বেগে কাটালেন তাঁর মতো আরও অনেকে।
আট দিন আগে ওঁদের সন্তানেরাও ঋষভ সিংহের সঙ্গে একই পুলকারে চেপে স্কুলে যাচ্ছিল। শনিবার ঋষভের মৃত্যুর খবর শুনে সকলেই শোকস্তব্ধ। এই পরিস্থিতির জন্য তাঁরা কাঠগড়ায় তুলছেন বেপরোয়া পুলকারকেই। আপাতত তাঁরা পুলকারে সন্তানদের পাঠানোর কথা ভাবছেন না। তাঁরা চাইছেন, পুলকারে স্কুলে পৌঁছে দেওয়া বা বাড়ি ফেরানোর নামে শিশুদের জীবন নিয়ে ‘ছিনিমিনি’ খেলা এ বার বন্ধ হোক।
ঋষভের সহপাঠী সুপ্রভা দাস দুর্ঘটনাগ্রস্ত পুলকারেই ছিল। শেওড়াফুলির সোনালি পার্কের ওই বালিকার বাবা ভবেশ বলেন, ‘‘মেয়ে পুলকারে যেতে চাইছে না। আমরাও পাঠাতে চাইছি না। ট্রেনে করে নিয়ে যাচ্ছি। স্কুলবাসের জন্য স্কুল কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করব। ওই দুর্ঘটনা এমনিতেই আতঙ্কিত করে রেখেছিল। ঋষভের চলে যাওয়ায় সেটা বাড়ল। ঋষভের মৃত্যুর কথা জানলে মেয়ের কী প্রতিক্রিয়া হবে জানি না।’’
শ্রীরামপুরের রামসীতা লেনের বাসিন্দা ঐশানী পালের মা ডলিরও একই চিন্তা। তিনি বলেন, ‘‘মেয়ে মাঝেমধ্যেই ঋষভের কথা জিজ্ঞাসা করছে। কালকেই (শুক্রবার) বলল, ও নাকি স্বপ্ন দেখেছে, ঋষভ ভাল হয়ে গিয়েছে। স্কুলে এসেছে। মেয়েটাকে সত্যি কথাটা বলতে পারিনি। বৈদ্যবাটীতে বাপের বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছি। কিন্তু স্কুলে গিয়ে তো মেয়ে জানবেই। সেটাই চিন্তা।’’ ডলি জানান, আপাতত তিনিও পুলকারে মেয়েকে পাঠানোর কথা ভাবছেন না।
ঋষভের সহপাঠী শেওড়াফুলির বাসিন্দা পদ্মনাভ ভট্টাচার্যের ছেলে সূর্যাভ। পদ্মনাভ জানান, ছেলে মাঝেমধ্যেই ঋষভের কথা জানতে চাইছে। ঋষভকে ও ‘মিস’ করছে। পদ্মনাভর কথায়, ‘‘বাড়িতে টিভি চালাচ্ছি না, ফোনেও সাবধানে কথা বলছি। পাছে ছেলে ঋষভের মৃত্যুর কথা জেনে যায়। ওইটুকু ছেলেকে বন্ধুর মৃত্যুর খবর কী করে দেব!’’ সূর্যাভর বাবা-মা ঠিক করেছেন, পুলকারে ছেলেকে পাঠাবেন না। নিজেরাই স্কুলে দিয়ে আসবেন। পদ্মনাভ বলেন, ‘‘শীঘ্রই যাতে পুলকারের হাল ফেরে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ সেই ব্যবস্থা করুন। সবচেয়ে ভাল হয় স্কুলের তরফে বাসের ব্যবস্থা হলে।’’
ওই দুর্ঘটনায় জখম হয়ে শেওড়াফুলির বাসিন্দা দিব্যাংশু ভগত এখনও এসএসকেএম হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। তার দাদু শ্যামসুন্দর ভগত এ দিন হাসপাতালে এসেছিলেন। তিনি বলেন, ‘‘ঋষভের মৃত্যুটা মেনে নিতে পারছি না। আমরা নাতিটা যাতে দ্রুত সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরে ঈশ্বরের কাছে এটাই প্রার্থনা।’’
এ দিন দুপুরে ঋষভদের ফ্ল্যাটের কাছেই দাঁড়িয়েছিলেন জনৈক সুরজিৎ দাস। শ্রীরামপুরের মল্লিকপাড়ার বাসিন্দা সুরজিতের ছেলে সৃজন ঋষভের ক্লাসেই পড়ে। সে অবশ্য অন্য গাড়িতে যায়। সুরজিৎ বলেন, ‘‘ছেলে কোনও ভাবে ঋষভের খবরটি জেনে গিয়েছে। মনমরা হয়ে পড়েছে। যা ঘটল প্রশাসন তার দায় এড়াতে পারে না। পুলকারকে এখনই নিয়মে বাঁধা দরকার।’’
ঋষভদের পড়শি দশরথ রাউত, মিনতি কর্মকার, তৃপ্তি কর্মকারেরাও একই দাবি জানালেন। একই কথা শোনা গেল ঋষভের বাবা সন্তোষ সিংহের মুখেও। তিনি বলেন, ‘‘দুর্ঘটনা ঘটতেই পারে। কিন্তু ছেলেকে যে মাঝপথে অন্য গাড়িতে চাপানো হত, সেটাই জানতাম না। এটাই সবচেয়ে কষ্টের ব্যাপার। পুলকার ছাড়া চলবে না। এত বাচ্চা স্কুলে যাবে কী করে? বাচ্চাদের নিয়ে এই গাড়ি চালাতে দায়িত্বজ্ঞান দরকার। গাড়ির সবকিছু ঠিকঠাক থাকা দরকার।’’
সদ্য সন্তানহারা বাবার আর্তি, ‘‘আর কোনও ঋষভ যেন না হারায়!’’