কী কারণে সদ্যোজাতের মৃত্যু হল, তা খতিয়ে দেখতে উচ্চপর্যায়ের কমিটি তদন্ত করবে বলে জানিয়েছে পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার স্বাস্থ্য দফতর। —নিজস্ব চিত্র।
হাসপাতালে ‘মৃত’ সদ্যোজাতকে কবর দিতে গিয়ে দেখা যায়, তার শ্বাস চলাচল করেছে। সঙ্গে সঙ্গে শিশুটিকে আবার হাসপাতালে নিয়ে গেলে সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু হয় তার। রবিবার এমনই দাবি করেছেন ওই শিশুটির পরিবারের সদস্যরা। একে নজিরবিহীন ঘটনা আখ্যা দিয়ে এ নিয়ে পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার ঘাটাল সুপার স্পেশালিটি হাসপাতালের বিরুদ্ধে চিকিৎসার গাফিলতির অভিযোগ তুলে তদন্তের দাবিও করেছেন তাঁরা। কী ভাবে এবং কখন সদ্যোজাতের মৃত্যু হল, তা খতিয়ে দেখতে দু’টি উচ্চপর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন জেলার স্বাস্থ্য দফতর।
শনিবার ভোরে প্রসবযন্ত্রণা শুরু হওয়ায় দুপুর ১২টা নাগাদ ঘাটাল হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছিল রসকুন্ডু এলাকার এক বধূকে। দুপুর ২টো নাগাদ পুত্রসন্তানের জন্ম দেন তিনি। যদিও শিশুটি নির্দিষ্ট সময়ের অনেক আগেই জন্মেছে বলে দাবি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের। বিকেল ৫টা নাগাদ শিশুটির পরিবারকে জানানো হয়, জন্মের মিনিট কুড়ির মধ্যেই মারা গিয়েছে সে। শনিবার রাতে তার মৃত্যুর শংসাপত্রও লিখে দেন হাসপাতালের এক চিকিৎসক। রাত ৯টা নাগাদ ওই সদ্যোজাতকে ‘দেহ’ হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দেওয়া হয়। এর পর রাত সাড়ে ১০টা নাগাদ সেই ‘দেহ’ নিয়ে বাড়ি ফিরে আসেন পরিবারের সদস্যেরা।
পরিবারের দাবি, শনিবার রাতে হাসপাতাল থেকে ফিরে ‘মৃত’ শিশুটিকে কবর দিতে গিয়ে চমকে উঠেছিলেন তাঁর মা-বাবা, আত্মীয়স্বজনেরা। শিশুটির শরীরে তখনও প্রাণ রয়েছে! জীবিত সদ্যোজাতকে মৃত ঘোষণা করে পরিবারের হাতে তুলে দিয়েছেন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। রাতেই হাসপাতালে ওই শিশুটিকে নিয়ে যান তাঁরা। মৃত্যুর শংসাপত্র দেওয়া জীবিত শিশুটিকে পুনরায় ভর্তি করানোর পর আইসিইউতে রাখা হয়েছিল তাকে। সেখানেই তার চিকিৎসা চলছিল। খবর পেয়ে রাতেই ঘটনাস্থলে যায় ঘাটাল থানার পুলিশ। ঘটনাস্থলে পৌঁছন বিজেপি বিধায়ক শীতল কপাট। সকালে ওই শিশুটির মৃত্যু হয়।
গোটা ঘটনাকে ‘নজিরবিহীন’ বলে দাবি করে হাসপাতালের চিকিৎসকের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে সরব হয়েছে শিশুটির পরিবারের সদস্যেরা। তাঁদের দাবি, এমন ঘটনা এ রাজ্যে কার্যত নজিরবিহীন। এই ঘটনায় সরকারি চিকিৎসার গাফিলতির অভিযোগে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী তথা স্বাস্থ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চায় ওই পরিবার।
পরিবারের আরও দাবি, হাসপাতাল থেকে দ্বিতীয় বার মৃত্যুর শংসাপত্র দেওয়া হয়নি। সদ্যোজাতের জেঠু বকুল খান বলেন, ‘‘৮ ঘণ্টা বিনা চিকিৎসায় পড়েছিল শিশুটি। শিশুটির মৃত্যুতে এই হাসপাতালের চিকিৎসক দায়ী। তাঁর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই। স্বাস্থ্য দফতর যেন এ বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে দেখেন, সেই আবেদন জানাব। এই ঘটনার নিরপেক্ষ তদন্তের দাবি জানাচ্ছি। ভবিষ্যতে যাতে অন্য কোনও রোগীর সঙ্গে এ রকম না হয়, তা হাসপাতালের সুপারের কাছে দরখাস্ত করব। এ নিয়ে থানায়ও যাব আমরা।’’
রবিবার সকাল থেকেই হাসপাতালে সুপারের সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য গেলে তিনি সেখানে হাজির হননি বলে দাবি শিশুর বাবা আলি আহমেদ খানের। তাঁর কথায়, ‘‘আজ (রবিবার) সকাল ৭টা থেকে হাসপাতালের সুপারের জন্য অপেক্ষা করছি। কিন্তু সকাল ১১টা বেজে গেলেও তিনি হাসপাতালে আসেননি। এমনকি, আমাদের সঙ্গে দেখাও করেননি। আমাদের বাচ্চা বিনা চিকিৎসায় মারা গেল। এর সুবিচার চাই। যে সমস্ত স্টাফের গাফিলতিতে এমন একটা নজিরবিহীন ঘটনা হল, তাঁদের সকলকে পদত্যাগ করতে হবে।’’ কী ভাবে সদ্যোজাতের মৃত্যু হল, জানা না গেলে তার দেহ বা মৃত্যুর শংসাপত্র নিতে অস্বীকার করেছে শিশুটির পরিবার।
এই ঘটনায় রবিবার দুপুরে মৃতের পরিবারের সঙ্গে বৈঠক করেন হাসপাতালের সুপার সুব্রত দে এবং জেলার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক সৌম্যশঙ্কর ষড়ঙ্গী। বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন বিজেপি বিধায়ক শীতল কপাটও। তাঁর দাবি, ‘‘হাসপাতালে শিশুটির কী ভাবে চিকিৎসা করেছে জানি না। ৪ ঘণ্টা পর বলেছে, শিশুটি মারা গিয়েছে। আবার ৭ ঘণ্টা পর বলেছে, জীবিত। চিকিৎসার গাফিলতি জেরেই এই ঘটনা। এর জন্য প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে ঘাটালের এসডিও সুমন বিশ্বাস দায়ী। হাসপাতালে রোগীকল্যাণ কমিটি গড়েননি তিনি। হাসপাতালে সকলেই যাতে ঠিক ভাবে পরিষেবা পান, তা-ই চাই আমরা।’’
বৈঠক শুরুর আগে হাসপাতালের সুপার সুব্রত দে বলেন, ‘‘ঘটনাটা খুবই দুঃখজনক। জেলা থেকে উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি আসছে। তারা বলতে পারবেন, কী হয়েছে। এই ঘটনায় চিকিৎসার গাফিলতি পাওয়া গেলে ব্যবস্থা নেবেন তারা।’’
রবিবার বৈঠক শেষে মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক সৌম্যশঙ্কর বলেন, ‘‘শনিবার রাতে পৌনে ১২টা নাগাদ শিশুটিকে আবার হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়েছিল। শিশুটির ‘সাসপেন্ডেড অ্যানিমেশন’-এর সমস্যা থাকতে পারে। অর্থাৎ প্রি-ম্যাচিওরড শিশুদের শ্বাসের সমস্যা থাকতে পারে ওই সদ্যোজাতের। তাকে নিওনাটাল ইন্টেনসিভ কেয়ার ইউনিটে ভর্তি করানো হয়েছিল। এই ঘটনায় দু’টি কমিটি গঠন করা হয়েছে। মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজের শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ মৌসুমি নন্দীর নেতৃত্বে একটি দল এ নিয়ে তদন্ত করবে। অন্যটিতে ঘাটালের এক চিকিৎসক দল বিষয়টি খতিয়ে দেখবে।’’