CPM

পাশে দরকার পিকের মতো কাউকে, আওয়াজ উঠছে সিপিএমে, সংগঠনের দুই রোগ নিয়ে জোর আলোচনা

নির্বাচনের আগে থেকেই বাম-কংগ্রেস নেতারা বলছিলেন, এ বারের ভোট হবে ত্রিমুখী। কিন্তু বাস্তবে দেখা গিয়েছে বাংলায় তৃণমূল-বিজেপি দ্বিমুখী লড়াই হয়েছে।

Advertisement

শোভন চক্রবর্তী

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৭ জুন ২০২৪ ১১:১৯
Share:

গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

লেনিনীয় সাংগঠনিক কাঠামো দিয়ে ভোটে জেতা যাবে না। প্রয়োজন বিকল্পের। পাশে দরকার পেশাদার সংস্থাকে। বড় ভোটে শূন্যের হ্যাটট্রিক হওয়ার পর এই আওয়াজ উঠতে শুরু করেছে সিপিএমে। ঘরোয়া আলোচনায় একাধিক নেতা মেনেও নিচ্ছেন, সংগঠনের দৈন্যদশা যে ভাবে আরও এক বার বেআব্রু হয়ে গেল, তাতে ‘বিকল্প’ ভাবনার প্রয়োজন রয়েছে। সূত্রের খবর, নানা দিক থেকে ওঠা সেই আওয়াজ পৌঁছে গিয়েছে ৩১ নম্বর আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের দোতলার অলিন্দেও।

Advertisement

বিকল্প কী?

সিপিএমের এক প্রথম সারির নেতার কথায়, “তৃণমূলের সাফল্যের নেপথ্যে রয়েছে পেশাদার সংস্থা আইপ্যাক। ২০২১ সালে ছিলেন প্রশান্ত কিশোর। তিনি নিজে এখন না-থাকলেও সেই সংস্থা রয়েছে। রাহুল গান্ধীর কংগ্রেসের পাশে রয়েছে সুনীল কানুগলুর মতো মস্তিষ্ক। উত্তরপ্রদেশে সমাজবাদী পার্টির সাফল্যের নেপথ্যেও কাজ করেছে পেশাদার সংস্থা। বিহারে তেজস্বী যাদবও এজেন্সির সাহায্য নিয়েছেন। সময়ের বাস্তবতাকে অস্বীকার করলে চলবে না।” কিন্তু সিপিএম কি পারবে পেশাদার সংস্থা নিয়োগ করতে? সিপিএম রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিমের জবাব, “আমরা পেশাদার সংস্থা নিয়োগ করার খরচ বহন করতে পারব না। তবে অবশ্যই পেশাদারিত্ব বৃদ্ধি করতে হবে।”

Advertisement

লোকসভা ভোটে কংগ্রেসের সঙ্গে সমঝোতা করে সিপিএম ভেবেছিল তাদের ভোট শতাংশ বৃদ্ধি পাবে। নির্বাচনের আগে থেকেই বাম-কংগ্রেস নেতারা বলছিলেন, এ বারের ভোট হবে ত্রিমুখী। কিন্তু বাস্তবে দেখা গিয়েছে বাংলায় তৃণমূল-বিজেপি দ্বিমুখী লড়াই হয়েছে। সেই মেরুকরণে সিপিএম আসন তো পায়নি বটেই। উল্টে বহরমপুরের পাঁচ বারের সাংসদ অধীর চৌধুরী হেরে গিয়েছেন। ২৩ জন সিপিএম প্রার্থীর মধ্যে মাত্র দু’জন তাঁদের জামানত রাখতে পেরেছেন। এক, মুর্শিদাবাদে সেলিম নিজে এবং দ্বিতীয়, দমদমে আর এক ‘প্রবীণ’ সুজন চক্রবর্তী।

সিপিএম সূত্রের খবর, সংগঠনে ‘মিথ্যা এবং নিষ্ক্রিয়তা’র সংক্রমণ ঠেকানো যাচ্ছে না। কেমন মিথ্যা? উদাহরণ দিয়ে বুথ স্তরের কর্মীরা বলছেন, এরিয়া বা শাখা স্তরের নেতারা প্রাথমিক ভাবে হয়তো জেলা স্তরে রিপোর্ট দিচ্ছেন, সব বুথে এজেন্ট বসানোর শক্তি রয়েছে। ভোটের দিন বেলা বাড়তে রিপোর্ট গিয়েছে, ১০টা বুথে এজেন্ট বসেনি। তার পরে যখন পূর্ণাঙ্গ তথ্য দলের কাছে যাচ্ছে, তখন দেখা যাচ্ছে সংখ্যাটা আর ১০ নেই, ৭০ হয়ে গিয়েছে। সেই সূত্রেই সিপিএমে এই আলোচনা শুরু হয়েছে যে, নেতাদেরও ‘জবাবদিহি’ করার বন্দোবস্ত রাখতে হবে। ধ্রুপদী সাংগঠনিক কাঠামো দিয়ে যা সম্ভব নয়। কিন্তু বামপন্থী দলে বা কমিউনিস্ট পার্টিতে কি তা সম্ভব? সিপিএমের এক নেতার কথায়, “ভোটে এখন যে ভাবে প্রচার হয়, প্রার্থীদের ছবি ব্যবহার করা হয়, ১৫ বছর আগে সেটাও হত না। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সেই ভাবনাও তো পাল্টেছে!” তাঁর কথায়, “পার্টিকে আগে বিলম্বিত বোধোদয়ের রোগ সারাতে হবে।”

২০১৯ সালের লোকসভা ভোটে বিপর্যয়ের পর প্রশান্ত কিশোর এবং তাঁর সংস্থাকে নিয়োগ করেছিল তৃণমূল। আরও ভাল করে বললে, নিয়োগ করেছিলেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। প্রশান্তের সংস্থা প্রথম যে কাজ করেছিল, তা হল নিচুতলার নেতাদের কাজ দেওয়া এবং তা কতটা হল সেটা কড়ায়-গণ্ডায় বুঝে নেওয়া। তাঁরা কী কাজ করছেন, কেমন ভাবে কাজ করছেন, তা-ও পেশাদার আতশকাচের নীচে ছিল। তা নিয়ে তৃণমূলে ক্ষোভ-বিক্ষোভ ছিল না যে তা নয়, কিন্তু দলের তরফে স্পষ্ট বলে দেওয়া হয়েছিল, না পোষালে রাস্তা দেখে নিতে হবে। দেখা গেল ২০২১-এর বিধানসভা, ২০২২-এর পুরসভা, ২০২৩-এর পঞ্চায়েত এবং ২০২৪-এর লোকসভা— টানা সাফল্য পাচ্ছে বাংলার শাসকদল। তৃণমূলের অন্দরে যাঁরা একটা সময়ে সংগঠনে পেশাদার সংস্থার ‘হস্তক্ষেপ’ নিয়ে রণংদেহি ছিলেন, তাঁরাও ‘বাস্তবতা’ মেনে নিয়েছেন।

২০১৮ সালের পঞ্চায়েত ভোটে জঙ্গলমহল এবং উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জায়গায় ধাক্কা খাওয়ার পর তৃণমূলের পর্যালোচনাতেও উঠে এসেছিল যে, স্থানীয় স্তরের নেতারা দলীয় কাজ সঠিক ভাবে বাস্তবায়িত করছেন না। ২০১৯ সালের লোকসভায় সেটাই বড় করে ধরা পড়ে। বিজেপি ১৮টি আসন জেতে বাংলায়। কালক্ষেপ না করে পেশাদার সংস্থা নিয়োগ করে জোড়াফুল শিবির। তার ফলও পাচ্ছে তারা। প্রচারের আখ্যান নির্মাণ, স্লোগান তৈরি— সবেতেই থাকছে পেশাদার সংস্থার ভূমিকা। সমাজমাধ্যম ব্যবহারেও ‘বাঁধুনি’ রয়েছে। সিপিএমে অবশ্য সমাজমাধ্যম ব্যবহার নিয়ে বিস্তর আলোচনা রয়েছে। দলের যে কর্মী ভোটগণনার দিন সাতসকালে হয়তো পোস্ট করেছিলেন, ‘লাল আবির মেখে ফিরব’। জামানত খোয়ানোর পর তিনিই পোস্ট করেছেন, ‘লক্ষ্মীর ভান্ডারের হাজার টাকায় বাংলা বিকিয়ে গেল। বাঙালি ভিখারি হল।’ সিপিএমের এক নেতার কথায়, “দলের কর্মীদের একটা বড় অংশ এটাই বুঝতে পারছেন না, সামাজিক প্রকল্প কখনও ভিক্ষা হতে পারে না। এই শিশুসুলভ চপলতাগুলোই আমাদের সর্বনাশ করে দিচ্ছে।”

ভোট বিপর্যয়ের পর শনিবার প্রথম বৈঠকে বসতে চলেছে সিপিএমের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলী। তার পরে দিল্লিতে পলিটব্যুরোর বৈঠক রয়েছে। জুনের তৃতীয় সপ্তাহে দু’দিনের রাজ্য কমিটির বৈঠক করবে সিপিএম। জুনের ২৮-৩০ তারিখ তিন দিনের কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠক বসবে। সেই বৈঠকের পরে শাখা স্তর থেকে পর্যালোচনা প্রক্রিয়া শুরু হবে। তাতে কি পেশাদার সংস্থা নিয়োগ করার প্রস্তাব আসবে?

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement