গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ
ইউটিউবে ভিডিয়ো দেখে স্বামীকে ইলেকট্রিক শক দিয়ে খুনের ছক করেছিলেন স্ত্রী। প্রেমিকের পরামর্শ মতো বার বার ‘মহড়া’ দেন। পুলিশি জেরায় স্বীকারোক্তি স্বামী খুনের অভিযোগে ধৃত নদিয়ার করিমপুরের সেই মহিলার। গত সপ্তাহে খুনের তদন্ত নেমে একের পর এক বিস্ফোরক তথ্য পেলেন তদন্তকারীরা।
ধৃত সুমনা মণ্ডল পুলিশি জেরায় জানিয়েছেন, স্বামী অনুপ মণ্ডলের কাছে গচ্ছিত ২৫ লক্ষ টাকা নিয়ে প্রেমিকের সঙ্গে ঘর বাঁধার পরিকল্পনা করেছিলেন তিনি। বিভিন্ন পরিকল্পনার পর স্বামীকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। এক লপ্তে মোটা অঙ্কের নগদ অর্থ এবং প্রেমিকের সঙ্গে থাকার হাতছানি— এই দুই প্রলোভনে প্রেমিকের দেওয়া ইলেকট্রিকের তার ব্যবহার করে স্বামীকে খুন করেছেন সুমনা। পুলিশি হেফাজতে রয়েছেন অভিযুক্ত ‘প্রেমিক’ও। দু’জনকে দফায় দফায় জিজ্ঞাসাবাদ করে করিমপুরকাণ্ডে চাঞ্চল্যকর সব তথ্য পেলেন তদন্তকারীরা।
করিমপুর থানা এলাকার বাসিন্দা ছিলেন অনুপ। বছর ১৩ আগে প্রথম বিয়ে হয় তাঁর। কিন্তু বছর দুয়েক আগে অস্বাভাবিক ভাবে মৃত্যু হয় প্রথম স্ত্রীর। এর পর এক বছর আগে মুরুটিয়ার রাখালগাছি গ্রামের সুমনাকে বিয়ে করেন অনুপ। সুমনারও আগে একটি বিয়ে ছিল। পাশাপাশি বাপের বাড়ির কাছে এক ব্যবসায়ীর সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল সুমনার। ওই যুবকের নাম বিজন। এক আত্মীয়ের বিয়েতে দু’জনের প্রথম আলাপ। সেখানেই দু’জন দু’জনের ফোন নম্বর নেন। দিন কয়েক ফোনে কথা বলার পর প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন দু’জনে। স্বামীকে অন্তরালে রেখে প্রেমিকের সঙ্গে কথা বলতে নতুন একটি মোবাইল কেনেন সুমনা। সিম কার্ডও ছিল নতুন। এমনকি, অনুপের অনুপস্থিতিতে মাঝরাতেও সুমনার শ্বশুরবাড়িতে আসা-যাওয়া ছিল বিজনের। প্রেমিকের সঙ্গে তাঁর বেশ কয়েক বার শারীরিক সম্পর্ক হয় বলে পুলিশকে জানিয়েছেন সুমনা।
এর মধ্যে মাথার উপরে পাকা ছাদ তৈরি করার জন্য পৈতৃক সম্পত্তি বিক্রি করে নগদ ২৫ লক্ষ টাকা সুমনার কাছে গচ্ছিত রেখেছিলেন অনুপ। সেই খবর পান বিজনও। শুরু হয় অনুপকে খুনের পরিকল্পনা। ইউটিউব ভিডিয়ো দেখে স্বামীকে ইলেকট্রিক শক দিয়ে খুনের পরিকল্পনা করেন সুমনা। তার পর বিজনের দেওয়া মোটা ইলেকট্রিক তার নিয়ে কী ভাবে খুন করবেন, তিনি তার ‘ডেমো’ করতেন বলে পুলিশ সূত্রে খবর।
পুলিশ সূত্রে খবর, স্বামীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার সময় খুনসুটি করে ইলেকট্রিকের তার দিয়ে তাঁর হাত-পা বেঁধে ফেলতেন স্ত্রী। এই ভাবে এক দিন প্রেমিকের দেওয়া মোটা তামার তার দিয়ে স্বামীর হাত বেঁধে তাতে বিদ্যুৎ সংযোগ ঘটিয়ে দেন সুমনা। স্বামী যখন অর্ধমৃত, সেই সময় ভিডিয়ো কল করে গোটা ঘটনা প্রেমিককে দেখান সুমনা। কিছু ক্ষণের মধ্যেই অনুপের বাড়িতে এসে উপস্থিত হন বিজন। তার পর দু’জনে মিলে অনুপের মৃত্যু নিশ্চিত করতে গলায় ফাঁস দিয়ে কিছু ক্ষণ ঝুলিয়ে রাখেন। মৃত্যু নিশ্চিত হতেই দু’জনে মিলে অনুপের দেহ বাড়ির পিছনের বাঁশবাগানে ফেলে দিয়ে আসেন। শুধু তাই নয়, অনুপকে খুনের জন্য কিছু কিছু সময় প্রাক্তন স্বামীরও সাহায্য নিয়েছিলেন সুমনা।
ইলেকট্রিক শক খেয়ে অনুপের গোঙানির শব্দ পেয়ে পাশের ঘর থেকে বাবা-মা এক বার উঠে এসেছিলেন। কিন্তু তাঁদের ঘরের দরজা থেকেই ফিরিয়ে দেন সুমনা। শ্বশুর-শাশুড়িকে আশ্বস্ত করে বলেন, “সব ঠিক আছে।”
বস্তুত, অনুপের হাতে পোড়া দাগ দেখে প্রথম সন্দেহ হয় তদন্তকারীদের। সুমনাকে এ নিয়ে প্রশ্ন করলে নানা সময়ে তিনি ভিন্ন উত্তর দিতেন। সন্দেহ গাঢ় হয়। এর পর অনুপের পরিবারের বাকি সদস্য এবং প্রতিবেশীদের বয়ান নেওয়া হয়। গ্রেফতার করা হয় সুমনার ‘প্রেমিক’ বিজনকেও। পুলিশি জেরায় ভেঙে পড়ে সুমনা তাঁর গোটা পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন।
এই খুনের ঘটনা নিয়ে তেহট্টের মহকুমার পুলিশ আধিকারিক শুভতোষ সরকার বলেন, ‘‘তদন্তের শুরুতে অভিযুক্ত মহিলার কথাবার্তায় বেশ কিছু অসঙ্গতি পাই আমরা। দফায় দফায় তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। তার পর দু’জনকেই গ্রেফতার করা হয়েছে। আদালতের নির্দেশে হেফাজতে নেওয়া হয়েছে দু’জনকে। এখনও তদন্ত চলছে।’’