ছবি: সংগৃহীত
চুপ-দুপুরের চড়ুই পাখি ডেকে ওঠার মতো কিঁইচ, একটা ছোট্ট শব্দ করে দরজাটা বন্ধ হয়ে গেল।
মাথার উপরে এক ফালি ভুয়ো-সিলিংয়ের গায়ে আঁটোসাঁটো খান পাঁচেক ফিনকি দেওয়া আলো, চাদরের মতো চার পাশে জড়িয়ে থাকা আয়না, বাকিটা ঘুটঘুটে স্তব্ধতা। ডাইনে-বাঁয়ে, সামনে-পিছনে— চার বাই চার চৌখুপ্পিতে বোঁচন এখন নিঝুম একা।
পুজোর মুখে থই থই করছে শপিং প্লাজা। জরি-রাংতার মতো ঝলমলে একটা দুপুরে এমন রং-বাহারি কাপড় জামার ভিড়ে তার রুখু বাবাকেও কেমন অচেনা মনে হচ্ছে তার— ‘যা নিজের মতো বেছে নে দেখি!’ বাবার মতিগতি কেমন ঠাওর হয় না তার।
একটা লম্বা ঝুলের কামিজ নিয়ে ট্রায়াল রুমে ঢুকে বোঁচন একটু স্বস্তি খোঁজে। আলো-আয়না-আলস্য নিয়ে এমন খোলাখুলি নিজের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তার মনে হয়, এত কাছ থেকে কবে যে নিজেকে শেষ দেখেছে, মনেই পড়ে না।
রংচটা ফ্রকটা সন্তর্পণে খুলতে গিয়েই বোঝে পিঠের হুকটা ছিঁড়ে গেল। যাক, এমন উদার আয়নার সামনে স্থির হয়ে আজ নিজেকে দেখে বোঁচন, পিছন থেকে অন্য একটা বোঁচন তাকে জরিপ করে, পাশ থেকে আরেকটা, যেন ফিসফিস করে বলে— কত্ত বড় হয়ে গেলি রে! দেড় বছর আগে, মা চলে যাওয়ার পরে, তার লাউ ডগার মতো এমন তর তর করে বেড়ে ওঠা কে আর খেয়াল করেছে!
অনেক দিন পর নিজেকে খুব নিবিড় ভাবে খুঁটিয়ে দেখতে থাকে বোঁচন। তাদের দেড় কামরার বাড়িতে, বাথরুমের শ্যাওলা ধরা দেওয়ালে হাত দেড়েক লম্বা কানা ভাঙা একটা আয়না আছে বটে, তবে মুখের ব্রণগুলোই তাতে স্পষ্ট হয় না! অলস দু’টো হাতে ধরে থাকা ঝলমলে তুঁতে রঙের কামিজটা তার হাত থেকে কখন যে ঝুপ করে খসে পড়ে ঝকঝকে মেঝেতে, বোঁচন খেয়াল করে না। মনে হয়, তার রঙ-হারা ফ্রকের মতো চুপচাপ খসে পড়েছে সময়, ঝিম ধরা দুপুরে ফেরিওয়ালার হাঁকের মতো পায়ে পায়ে পিছন দিকে হেঁটে যাচ্ছে ছেঁড়া ছেঁড়া দিন। আজ, অনেক দিন পরে, তার কাঁধের কালশিটে, কব্জির আঁচড়, হাঁটুর ক্ষত— সব যেন চুপি চুপি এসে জড়ো হয়েছে এই নিঝুম চৌখুপ্পি ঘরে।
চিল ওড়া অলস দুপুরের মতো তার সামনে একে একে এসে ভিড় করে— ভূগোল পড়ার ছলে বড়দের পুজো সংখ্যাটা বেরিয়ে পড়ায় হ্যাঙারের শাসন, স্কুল ফেরত ভেজা জুতোর জন্য পিঠের উপর ঘন থাপ্পড়, ছাদের টব ভাঙার খেসারত, চুলের মুঠি ধরে দেওয়ালে মাথা ঠোকা সন্ধে। আর সেই রাতটা— দু’চোখে ঘুম নিয়ে, বাবার পাকা চুল বেছে দিতে রাজি না হওয়ায় দেওয়াল থেকে লিকলিকে সাপের মতো নেমে আসা সঘন বেল্ট...
চার পাশে আবৃত আয়নায় নিজেকে আর খুঁজে পায় না বোঁচন। পাহাড়ি ঝোরার মতো শব্দহীন কান্না নিয়ে অভিমানে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। তার পর, ঝাপসা চোখে হাতড়ে হাতড়ে তুলে নেয় রংচটা ফ্রকটা।
—কী রে হল কী, এতক্ষণ লাগছে কেন!
নতুন কামিজটা কুড়িয়ে নিয়ে, চার বাই চারের সেই আপন ঘেরাটোপ থেকে ছিটকে বেরিয়ে আসে বোঁচন। তার পর, বাবার হাতে সেই নতুন কামিজটা গুঁজে দিয়ে বোবা ঘুঘুর মতো কেঁদে ওঠে— কিচ্ছু না, কিচ্ছু চাই না আমার...আমি মায়ের কাছে যাব!
পঞ্চমীর দুপুর, দেড় বছর আগের বিসর্জনের কান্নায় নিশ্চুপে ভিজতে থাকে!