রসগোল্লার উদ্ভাবক কে? বিরোধ শুধু বাংলা-ওড়িশায় নয়, বিরোধ বাংলার মধ্যেও। বাগবাজারের নবীনচন্দ্র দাসকেই রসগোল্লার উদ্ভাবক বলে ধরা হয়। ১৮৬৮ সালে নবীনচন্দ্র রসগোল্লা তৈরি করেন। কিন্তু অনেকের মতে, রসগোল্লার আসল উদ্ভাবকের নাম হারাধন মণ্ডল।
রানাঘাট স্টেশন। —নিজস্ব চিত্র।
রানাঘাটের প্রাচীন নাম ব্রহ্মডাঙা। তার পর রানা ডাকাতের নামে এই পল্লির নাম হয় রানাঘাট। তবে কারও কারও মতে— আকবরের আদেশে রানা টোডরমল এই অঞ্চলে জমি জরিপ করতে আসেন। তাঁর নাম অনুযায়ীই এই অঞ্চলের নাম হয় রানাঘাট। আবার অনেক গবেষকের মতে— রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের দ্বিতীয় স্ত্রীর নাম অনুযায়ী এই স্থানের নাম হয় ‘রানিঘাট’। ‘রানিঘাট’ থেকেই আজকের রানাঘাট। ইতিহাসবিদ প্রিঙ্গিলের দাবি, অষ্টাদশ শতাব্দীতে রানা নামে এক দুর্দান্ত ডাকাত রানাঘাটকে তাঁর ঘাঁটিতে পরিণত করেন। সেই ডাকাত রানার নামেই রানাঘাট।
প্রিঙ্গিলের মতে, চূর্ণী নদীর তীরে অবস্থিত রানাঘাট একেবারেই কোনও নতুন শহর নয়। রেনেলের মানচিত্রে রানাঘাটের উল্লেখ রয়েছে। ১৮৬৩ খ্রিস্টাব্দ থেকে এটি রানাঘাট মহকুমা সদর হিসাবে পরিচিত হয়। নদিয়া জেলার সব নদীগুলিকেই প্রকৃতপক্ষে পদ্মার শাখা বলা যায়। রানাঘাট মহকুমায় মাথাভাঙা, ভাগীরথী এবং চূর্ণী— এই তিনটি নদী প্রবাহিত হয়ে, রানাঘাট শহরের সীমানা স্পর্শ করে, শান্তিপুর ও চাকদহের মাঝখানে গৌরনগরের কাছে হুগলি নদীতে মিশেছে। ভাগীরথী নদীর সঙ্গে মাথাভাঙ্গার সংযোগ করতে খননকার্যের ফলে চূর্ণী নদীর উৎপত্তি সংক্রান্ত কিংবদন্তী যদি সত্য হয়, তা হলে বলতে হয় যে, এই খননকার্য ১৯৫ খ্রিস্টাব্দের পূর্বে ঘটেছিল।
রানাঘাট পুরসভার অতীত-বর্তমান
১৮৬৪ খ্রিস্টাব্দের ২১ সেপ্টেম্বর রানাঘাট পুরসভার প্রতিষ্ঠা হয়। শুরুতে ১৪ জন কমিশনার ছিলেন। তাঁদের মধ্যে ৯ জনই মনোনীত। পদাধিকার বলে ৫ জন পুরসভার কার্যনির্বাহক সমিতির সদস্য হন। পুরসভার গৃহীত উপবিধি অনুমোদন করতেন লেফটেন্যান্ট গভর্নর। বর্তমানে রানাঘাট পুরসভার ওয়ার্ড সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ২০।
২০১১-র জনগণনা অনুযায়ী রানাঘাট শহরের জনসংখ্যা ৭৫,৩৬৫। পুরুষের হার ৫১% এবং মহিলার হার ৪৯%। শিক্ষিতের হার ৮৪%, যেটি জাতীয় হার (৫৯.৫%)-এর থেকে অনেকটাই বেশি। পুরুষ শিক্ষিতের হার ৮০%। ২০১১ সালে শহরের জনসংখ্যার ৮ শতাংশ ছিল ৬ বছরের কম বয়সী। রানাঘাট ছাড়াও নদিয়ার রানাঘাট মহকুমায় আছে শান্তিপুর পুরসভা, বীরনগর পুরসভা এবং চারটি সমষ্টি উন্নয়ন ব্লক। এই উন্নয়ন ব্লকগুলি আবার গ্রামীণ এলাকা এবং আদম সুমারীয় শহরে বিভক্ত। রানাঘাট শহরের স্তর হল— রানাঘাট, আইনতলা, সাটিগাছা, লাঁসড়া এবং কুপার্স ক্যাম্প। রানাঘাট মহকুমার মধ্যে, শান্তিপুর পুরসভা রানাঘাটের থেকেও পুরনো। জেলার প্রথম পুরসভা শান্তিপুর ১৯৫৩ সালে তৈরি হয়। এর ১১ বছর পর রানাঘাট পুরসভার প্রতিষ্ঠা।
রানাঘাটের রেল ইতিহাস
রানাঘাটের রেলপথের দীর্ঘ ইতিহাস আছে। সিপাহি বিদ্রোহের পাঁচ বছর পর শিয়ালদহ-রানাঘাট রেলপথের সৃষ্টি। ১৮৬২ খ্রীষ্টাব্দে এই রেলপথটির উদ্বোধন হয়। রানাঘাট-কল্যাণী এবং রানাঘাট-শান্তিপুর শাখার বৈদ্যুতিকরণ হয় ১৯৬৩-৬৪ আর্থিক বছরে। স্বাধীন ভারতে, কেন্দ্রীয় সরকার রানাঘাট স্টেশনকে বিশেষ মর্যাদা দান করেছে।
রানাঘাট একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যবসায়ী কেন্দ্র। ছোটখাটো ব্যবসাদাররা, সে কাছাকাছি শহরেই হোক বা গ্রামেরই হোক রানাঘাট থেকে মাল সংগ্রহ করেন। খুচরো এবং পাইকারি ব্যবসার এখানে অত্যন্ত উন্নতি ঘটেছে। রানাঘাট শহরে হস্তশিল্প, বুটিক এবং নানা প্রকারের কাপড়ের ফুল তৈরিতে কয়েক সহস্র মানুষ জড়িত। রানাঘাট শহরে শরত্পল্লি, মদনমোহন কলোনি প্রভৃতি অঞ্চলে কয়েক হাজার মহিলা এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত। চিন থেকে আমদানীরত কৃত্রিম ফুলের সঙ্গে এই অঞ্চলের নির্মাতারা রীতিমতো পাল্লা দিচ্ছেন।
রানাঘাটের রসগোল্লা
রসগোল্লার উদ্ভাবক কে? বিরোধ শুধু বাংলা-ওড়িশায় নয়, বিরোধ বাংলার মধ্যেও। বাগবাজারের নবীনচন্দ্র দাসকেই রসগোল্লার উদ্ভাবক বলে ধরা হয়। ১৮৬৮ সালে নবীনচন্দ্র রসগোল্লা তৈরি করেন। কিন্তু অনেকের মতে, রসগোল্লার আসল উদ্ভাবকের নাম হারাধন মণ্ডল। হারাধন মণ্ডল শান্তিপুরের ফুলিয়ার মানুষ। রানাঘাটের পালচৌধুরীদের হালুইকর ছিলেন। তিনিই রসের মধ্যে ছানার ডেলা ফেলে একটি অভিনব মিষ্টান্ন প্রস্তুত করেন। পালচৌধুরীরা তার নাম দেয় রসগোল্লা। রসগোল্লা ছাড়া, রানাঘাটে অনেক কাল ধরে চলে আসা মিষ্টান্ন দ্রব্যের মধ্যে রয়েছে পান্তুয়া, গজা, অমৃতি প্রভৃতি। মহাদেব ঘোষ এবং জগুময়রার দোকান প্রায় শতাধিক বছরের পুরাতন।
রানাঘাটের সংস্কৃতি
রানাঘাট শহরে এক সময় প্রতিটি বাড়িতে সন্ধ্যাপ্রদীপ প্রজ্বলনের মতো সঙ্গীতের রেওয়াজ হত। মার্গ সঙ্গীতের পীঠস্থান ছিল রানাঘাট। মূলত পালচৌধুরী পরিবারের পৃষ্ঠপোষকতায় এবং পালচৌধুরীদের সভাগায়ক নগেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যের কৃতবিদ্যতায় পালচৌধুরীদের ‘মাইফেল’ দেশ-বিদেশের উচ্চাঙ্গ শিল্পীদের মিলনমেলায় পরিণত হত। শ্রীজান বাঈ, দিলজান, ইমন বাঈ, লালাকুন্দ। আহম্মদ খাঁ সাহেবের মতো উত্তর ভারতের সেরা গায়কেরা এই আসরে নিয়মিত আসতেন। এই ভাবেই নগেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য তাঁর দুই প্রখ্যাত শিষ্য নগেন্দ্রনাথ দত্ত ও নির্মল কুমার চট্টোপাধ্যায়কে নিয়ে রানাঘাট ঘরানার জন্ম দেন। নিধুবাবু প্রবর্তিত বাংলা টপ্পা ধারার সঙ্গে লখনউ ঘরানার মিলনে এক বিশেষ টপ্পা ধারার সৃষ্টি হয়। এই ঘরানার পরবর্তী বিখ্যাত শিল্পী ছিলেন শিবকুমার চট্টোপাধ্যায় এবং ডাঃ অঞ্জলি মুখোপাধ্যায়। নগেন্দ্রনাথ দত্তের শিষ্য ছিলেন ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়, বিজন বসু, পূরবী দত্ত, অরুণ দত্ত, শিবকুমার চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ। বর্তমানে এই শহরে সঙ্গীতচর্চা প্রকৃতপক্ষে ম্রিয়মান।
রানাঘাটের সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে যাঁরা আলোকিত করেছেন তাঁরা হলেন রবীন্দ্র জীবনীকার প্রভাত কুমার মুখোপাধ্যায়, অমিয় বন্দ্যোপাধ্যায়, নাট্য নির্দেশক দেবনারায়ণ গুপ্ত, কবি গোবিন্দ চক্রবর্তী, কবি নিজন দে চৌধুরী, কবি তীর্থ মোদক, পঞ্চানন বন্দ্যোপাধ্যায়।
রানাঘাটের পত্র-পত্রিকা
বর্তমানে যে পত্রিকাগুলি প্রকাশিত হচ্ছে— ‘বার্তাবহ’ শতাধিক বছর পূর্বে গিরিজা নাথ মুখোপাধ্যায়ের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়। পরবর্তীতে সম্পাদনা করেন রমণী ভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়। বর্তমানে সম্পাদক নেপালদেব বন্দ্যোপাধ্যায়।
জ্যোতিপ্রকাশ ঘোষের সম্পাদনায় ‘সংবাদ প্রদীপ’, তাপস মোদক সম্পাদিত ‘নির্ভীক সংবাদ’, দেবব্রত গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘রানাঘাট নিউজ’, সুজিত মণ্ডল সম্পাদিত ‘চূর্ণী’, পুলক বসু সম্পাদিত ‘নদিয়া সংবাদ’, রীণা পালের ‘নদিয়ার কথা’ এবং চন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়ের ‘রাজচক্র’।
দ্রষ্টব্য স্থান
রানাঘাটের দ্রষ্টব্য স্থানগুলি হল— পালচৌধুরীদের পূর্বতন ভদ্রাসনের প্রাচীরের মধ্যে একই ভিতের উপর প্রতিষ্টিত জোড়া শিব মন্দির। মন্দিরে টেরাকোটার কাজ আছে। চূর্ণী নদীর তীরে বড়বাজারে জগন্নাথ-সুভদ্রা-বলরামের মন্দির। জমিদার রতন পালচৌধুরীর বিধবা পত্নী উজ্জ্বলমণি দাসীর প্রচেষ্টায় ৯৫ হাজার টাকা ব্যয়ে নির্মিত নিস্তারিণী মন্দির, রানা ডাকাতের প্রতিষ্ঠিত সিদ্ধেশ্বরী কালী মন্দির, রানাঘাট শহরের স্কুল মোড়ে প্রতিষ্টিত চিন্ময়ী ও মৃন্ময়ী মন্দির, ব্রজবল্লভ মন্দির জহুরা কালীবাড়ি এবং ছোটবাজারের বাধাবল্লভ মন্দির প্রভৃতি।
—নিজস্ব চিত্র।
আবহাওয়া: যে হেতু নদিয়া জেলার উপর দিয়ে কর্কটক্রান্তি রেখা গিয়েছে তাই এখানে সব সময়েই চরম ভাবাপন্ন আবহাওয়া বিরাজ করে অর্থাত্ গ্রীষ্মকালে এই শহরে গুমোট গরম এবং শীতকোলে তীব্র শীত অনুভূত হয়।
রানাঘাটের যানবাহন
বাস পরিবহণ: রানাঘাট কলেজের বিপরীতে রথতলায় এবং জিএলপিসি রোডের বিপরীতে রানাঘাটে তিনটি বাসস্ট্যান্ড আছে। জাতীয় সড়কের পাশের বাসস্ট্যান্ডে সিএসটিসি-র কলকাতা-শিলিগুড়িগামী বাস থাকে।
রানাঘাট থেকে কৃষ্ণনগর, হাঁসখালি, আইসমালি, পলাশী, বেথুয়া এবং জেলার অন্যান্য জায়গায় বাস চলাচল করে।
রানাঘাটে বর্তমানে ‘টুকটুকি’, ‘টুনটুনি’ রিক্সা ভ্যান— যাত্রী যাতায়াত করে।
রানা ঘাটের শিক্ষা ব্যবস্থা
রানাঘাট শহরে অনেকগুলি প্রাথমিক বিদ্যালয়, উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয় এবং উচ্চ শিক্ষার জন্য মহাবিদ্যালয় আছে।
উচ্চতর মাধ্যমিক বিদ্যালয় সমূহ— পালচৌধুরী উচ্চতর মাধ্যমিক বিদ্যালয় (১৮৫৩), পালচৌধুরী বালিকা বিদ্যালয়, লাল গোপাল উচ্চতর মাধ্যমিক বিদ্যালয়, লালগোপাল উচ্চতর মাধ্যমিক বিদ্যালয়, ব্রজবালা উচ্চতর বালিকা বিদ্যালয়, নাষড়া উচ্চতর বালিকা বিদ্যালয়, দেবনাথ ইন্সটিটিউসন, দেবনাথ ইনস্টিটিউসন ফর গার্লস, ভারতী উচ্চ বিদ্যালয়, রথতলা কলোনি এইচএস স্কুল প্রভৃতি। রানাঘাট ঙরে অনেকগুলি প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে।
উচ্চ শিক্ষার জন্য আছে রানাঘাট কলেজ (১৯৫০)।