কাটোয়া রেল স্টেশন। —নিজস্ব চিত্র।
মহানগর কলকাতার জন্মের বহু বহু আগেই কাটোয়া এক সমৃদ্ধ জনপদ। ভাগীরথী নৌকাপথে যেতে যেতে কাটোয়া শহরের রূপদর্শনে আপ্লুত কবি বিজয়রাম ‘তীর্থমঙ্গল’ কাব্যে লিখেছেন :
‘অপূর্ব্ব শহর খান কতেক বাজারে।
ইহার সমান স্থান নাহি একাধারে।’
সেটা সপ্তদশ শতাব্দীর দ্বিতীয় ভাগ। আরও অনেক আগে, চৈতন্যের জীবনীকার জয়ানন্দ ‘চৈতন্যমঙ্গল’-এ (১৫৪৮-১৫৬০ খ্রিস্টাব্দে) বলেছেন: ‘‘কাটোয়া নগরী যেন সুরপুরী সর্বসুখ প্রমোদে।’’ মধ্যযুগের নানা রাষ্ট্রনৈতিক ঘাত প্রতিঘাতের আলো-অন্ধকার গায়ে মেখে, এ শহর পুরসভা হিসেবে স্বীকৃতির ১৫০ বছর পরে, এক বাণিজ্য সফল আলোঝলমলে জনপদ। বীরভূম, বর্ধমান, নদিয়া, মুর্শিদাবাদে চার জেলার সেতুবন্ধ হিসেবে রাঢ়বঙ্গের ঐশ্বর্যকেন্দ্র। জমির অর্থমূল্যের বিচারে, কলকাতা ও শহরতলি বাদে, গোটা বাংলায় সে সর্বোচ্চ শিখরে। আধুনিক পরিষেবার বহু অপ্রতুলতা, তবু পূর্ব ও পশ্চিম বর্ধমানের সব শহরের চেয়ে তার জনঘনত্ব বেশি। এ এক অদ্ভুত ‘প্যারাডক্স’।
অতীত বাদ দিয়ে বর্তমান অসম্পূর্ণ। একটু পিছনে চোখ রাখলেই দুলে দুলে ওঠে ইতিহাসের পর্দা। কাটাদুপা, কাটাদ্বিপা, কাঁটাদ্বীপ, কণ্টকনগর, কাটো, কাটুয়া— এ সব নাম ছুঁয়ে-থাকা এ অঞ্চলের উল্লেখ গ্রিক লেখকের রচনদতত্ত। কবি বিপ্রদাস পিপিলাই, বৃন্দাবন দাস, কৃষ্ণদাস কবিরাজদের লেখায় কাটোয়া এসেছে ঘুরে-ফিরে। কেশবভারতীর কাছে চৈতন্যের দীক্ষাগ্রহণ (১৫১০ খ্রিস্টাব্দে) এ শহরকে জাতে তুলেছে অনেকখানি। অজয় আর ভাগীরথীর সংযোগস্থল এ শহরকে প্রথম সুগঠিত রূপ দিয়েছেন নবাব মুর্শিদকুলি খাঁ; যে কারণে এর আর এক নাম ‘গঞ্জ মুর্শিদপুর’। প্রকৃত প্রস্তাবে সামরিক ও বাণিজ্যিক নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করে, থানা ও চৌকি বসিয়ে তিনি অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথম দিকে কাটোয়ার ভবিষ্যৎ উন্নতির রাস্তা প্রশস্ত করেছেন। নবাব আলিবর্দীর সঙ্গে মরাঠা দস্যুদের সংঘাত, ইংরেজদের সঙ্গে সিরাজদৌল্লার যুদ্ধ ইত্যাদি ঘটনা জড়িয়ে রয়েছে এ শহরের শ্বাসপ্রশ্বাসের সঙ্গে। ইংরেজ আমলেও যে তার গুরুত্ব এতটুকু কমেনি, তার বড় প্রমাণ, ১৮৪৭ সালে মহকুমা হিসেবে স্বীকৃতি। আর ১৮৬১ সালে পুরসভার শিরোপা এ শহরের কপালে এঁকে দিল আধুনিকতার চন্দনতিলক। ওই বছরের ১ এপ্রিল তার আনুষ্ঠানিক যাত্রাপথের নান্দীমুখ। তখন আয়তন ১ বর্গমাইল। এখন যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৩ বর্গমাইল।
কাটোয়া শহরের সবথেকে বড় আকর্ষণ গৌরাঙ্গ মন্দির। —নিজস্ব চিত্র।
নাগরিকদের সক্রিয় অংশগ্রহণ যে কোনও স্বায়ত্বশাসন সংস্থার সার্বিক বিকাশের প্রথম পাঠ। ইংরেজ শাসকবর্গ যে সে অংশগ্রহণের পথ রুদ্ধ করেনি তা ইতিহাস-সত্য। ১৮৮৪ সালের বঙ্গীয় মিউনিসিপ্যাল আইন মোতাবেক ১৮৮৫-তে প্রথম পুর নির্বাচনে মহিলাদের ভোটাধিকার ছিল না। প্রধানত করদাতা ও শিক্ষিতরাই ভোটাধিকার প্রাপ্ত ছিলেন। ফলে ৬ হাজার ৮২০ জন বাসিন্দার মধ্যে নির্বাচক ছিলেন মাত্র ৩৬০ জন। ভোট দিয়েছিলেন ৫১ জন। অর্থাৎ ২০ শতাংশের কম। ওয়ার্ড সংখ্যা ছিল ৩টি। তখন শহরের অবস্থান ভাগীরথীর তীর বরাবর, সরকারি প্রতিনিধি সমেত ৮ জনের পুরবোর্ড। জেসিকে পিটারসন লিখিত বেঙ্গল ডিস্ট্রিক্ট গেজেটিয়ার্স (১৯১০ খ্রিস্টাব্দ) থেকে জানা যাচ্ছে, ১৯০৭ সালে পুরসভার বার্ষিক আয় ও ব্যয় যথাক্রমে ১০,২২০ টাকা এবং ১০,৮০০ টাকা। পরের বছর আয় বেড়ে দাঁড়ায় ১২,৫০০ টাকা। আয়ের প্রধান উৎস কর আদায়। অধিকাংশ রাস্তাই ছিল সংকীর্ণ এবং কাঁচা মাটির। যানবাহন বলতে গরুর গাড়ি এবং ঘোড়ার গাড়ি। নাগরিকদের স্বাস্থ্যরক্ষার জন্য ছিল চারটি ‘চ্যারিটেবল ডিসপেনসারি’। তখন পুরবোর্ডের মোট সদস্য ছিলেন ১৩ জন। তার মধ্যে ৪ জন সরকারি প্রতিনিধি। কাটোয়ার প্রাচীনতম সংবাদপত্র ‘প্রসূন’ (সম্পাদক: মন্মথনাথ চট্টোপাধ্যায়) জানাচ্ছে, ১৯১২ সালের মার্চ মাসের পুরনির্বাচনে ৩টি ওয়ার্ডে মোট প্রার্থীর সংখ্যা ছিল ২২জন। সে তালিকায় ‘বাবু’দেরই প্রাধান্য।
স্বাধীনতা প্রাপ্তির পরবর্তী কালেও নাগরিক পরিষেবার ক্ষেত্রে কাটোয়া পুরসভার ভূমিকা প্রশংসাবাচক নয়। তার প্রধান কারণ অর্থাভাব। সেই খাটা পায়খানার দুর্গন্ধ, সেই গরুর গাড়ির ক্যাঁচর-ক্যাঁচর ইত্যাদি। পুর কর্মচারীদের মাস মাইনেটুকু জোগাতেই তখন হিমশিম অবস্থা। কেবল জনসংখ্যাবৃদ্ধির কারণে ওয়ার্ড বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৪। রূপান্তরের জন্যে শহরবাসীকে অপেক্ষা করতে হয়েছে ১৯৭৮ পর্যন্ত। বিধায়ক ডাঃ হরমোহন সিংহের পরিকল্পনায় নতুন নতুন রাস্তা তৈরি, জনবসতি স্থাপন, সরকারি আবাসন ও বাজার প্রতিষ্ঠা, আধুনিক ব্যাসস্ট্যান্ড ও স্টেডিয়াম নির্মাণ ইত্যাদির প্রসঙ্গসূত্রে তখন তার ভরা যৌবন। কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের আর্থিক অনুদানে তার ভাঁড়ার কানায় কানায় পূর্ণ। এখন ২০টি ওয়ার্ডের জনসংখ্যা ১ লক্ষ ছুঁই ছুঁই। রাজনৈতিক বৈরিতা কখনওই উন্নয়নের পথে গড়ে তোলেনি বাধার পাঁচিল। ‘গঙ্গা অ্যাকশন প্ল্যান’-এর অধীনে পরিস্রুত পানীয় জল, বৈদ্যুতিক চুল্লি, হাইমাস্ট আলো, পৌর উদ্যান, এ সব হরেক রঙের বাহারি আলপনা। প্রাচীন ইন্দ্রাণী পরগনার এ শহর উন্নয়নের অভিমুখে... স্বপ্নসন্ধানী।