কৃষ্ণনগরে... ক্যাথলিক চার্চ। —ফাইল চিত্র।
কাজী নজরুলের ভাষায় ‘পুতুল খেলার কৃষ্ণনগর’।
দীনবন্ধু মিত্রের ‘সুরধুনী’ কাব্যের বর্ণনায় ‘...নগর এক নদী-কিনারায় /কৃষ্ণচন্দ্র নরপতি বিখ্যাত ভুবনে /সেই নগরেতে তাঁর শুভ রাজধানী /অদ্যাপী বিরাজে যথা সুখে বীণাপাণি।’
আর আমজনতা ‘কৃষ্ণনগর’ বললেই মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের নাম এক নিশ্বাসে উচ্চারণ করেন। অনেকেরই ভুল ধারণা, কৃষ্ণচন্দ্রের নামে কৃষ্ণনগর। বাস্তবে কৃষ্ণচন্দ্রের পূবর্পুরুষ রাজা রুদ্র রায় জলঙ্গি আর অঞ্জনা নদী ঘেরা ‘রেউই’ জনপদের নাম পাল্টে রাখেন কৃষ্ণনগর। নদিয়ার রাজধানীর কৃষ্ণভক্ত গোপদের সম্মান জানিয়ে তাঁর এই নামপরিবর্তন।
৮৪ পরগনার অধীশ্বর সামাজিক সাংস্কৃতিক জগতের প্রভাবশালী ছিলেন মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়। স্বাভাবিক কারণেই কৃষ্ণচন্দ্র ও কৃষ্ণনগর নাম লতার মতো জড়িয়ে রয়েছে। কৃষ্ণচন্দ্রের রাজত্বকালেই (১৭২৮-১৭৮২ খ্রিস্টাব্দে) ইতিহাসের বাঁকে এসে দাঁড়াই আমরা। পলাশির যুদ্ধ, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাত থেকে মহারানির ক্ষমতা গ্রহণ, ১৭৭২ সালে বাংলার মধ্যে প্রথম নদিয়া কালেক্টরেট জেলা গঠন, কৃষ্ণনগরে দেওয়ানি আদালত স্থাপন, নীলচাষের জন্য নীলকর সাহেবদের আগমন। একই নগরে নদিয়ারাজ আর বৃটিশরাজের সহাবস্থান। রাজাদের হাত ধরে পেশাভিত্তিক পাড়া নিয়ে রাজধানী কৃষ্ণনগর পল্লবিত হয়ে উঠেছিল। এ বার সেখানে জেলা সদর শহর কৃষ্ণনগরে বিদেশি সাহেবদের সংখ্যা বাড়তে লাগল। ধীরে ধীরে চুপিসারে সমান্তরাল প্রশাসনের ফাঁস চেপে বসতে লাগল।
কলকাতা (১৮৪১-১৮৪৭ খ্রিস্টাব্দ), মাদ্রাজ (১৮৪১) এবং বোম্বাই (১৮৪৫) শহরের জন্য বৃটিশ পৌর আইন চালুর পর ১৮৫০ সালে নদিয়ায় পুরসভা গঠনের জন্য আইন প্রণয়ন করে। প্রাথমিক পযার্য়ে এর পিছনে ইংরেজদের কিছু স্বার্থ ছিল। এ দেশীয়দের করের টাকায় পরবাসী সাহেবদের নিজেদের সুখ-স্বাচ্ছন্দকে বহাল রাখা, বৃটিশ বিরোধী শক্তিকে চিহ্নিত করে প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণকে মজবুত করার চিন্তাভাবনা কাজ করেছিল। অনেক ক্ষেত্রেই স্থানীয় অর্থশালী ও প্রভাবশালী ব্যক্তিদের তাঁরা পাশে পেয়েছিলেন।
১৮৬৪ সালের ১ নভেম্বর মিস্টার এফ জে আর্লের বাংলোর একটি ঘরে কৃষ্ণনগর পুরসভার গঠনের জন্য প্রথম বৈঠক হয়। জেলাশাসক মিস্টার ই.গ্রে চেয়ারম্যান, মিস্টার আর্লেকে ভাইস চেয়ারম্যান করে সরকার মনোনীত ১৫ জন কমিশনার নিয়ে পুরসভা গঠিত হয়। বর্ষশেষের আগেই অ্যাসেসমেন্ট কাজ শেষ করতে অ্যাডভোকেট জেনারেলের নির্দেশ থাকায় কমিশনারদের প্রথম সভা বসে ২৬ নভেম্বর ১৮৬৪। সেই সভায় চারটি বিষয়ের উপর জোর দিয়ে সাব-কমিটি তৈরি করে দেওয়া হয়।
১.বাড়ি ও জমির ট্যাক্স নির্ধারণ, ২.স্বাস্থ্য উন্নয়ন, ৩.রাস্তা এবং ৪.আইনের ধারা উপধারার বিধি সমূহ বলবতের জন্য খসড়া প্রণয়ন। এই উপ-সমিতিগুলিতে রায়বাহাদুর যদুনাথ রায়, দ্বারকানাথ দে, তারিণীপ্রসাদ ঘোষ, কালিচরণ লাহিড়ী, উমেশচন্দ্র দত্ত, ব্রজনাথ মুখোপাধ্যায় প্রমুখ ব্যক্তিদের সংযুক্ত করা হয়। এর তিন মাসের মধ্যে রাস্তার নামকরণ, পাবলিক ল্যাট্রিন স্থাপন, মুসলমানদের কবরের স্থান সুনির্দিষ্ট করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। রেভারেন্ট ব্লুম হার্ভে এবং কালিচরণ লাহিড়ি জরিপের দায়িত্ব নিয়ে ১৮৬৬ তে পুরসভার সীমানা নির্ধারণের কাজ শেষ করেন। পরের বছর শহরে নর্দমার কাজ শুরু হয়। ট্যাক্সের টাকায় ঝড়ের গতিতে কাজ ভালই হচ্ছিল, ১৮৬৮ সালে ঝড়ঝঞ্ঝায় নগরজীবন তছনছ করে দিল। চেয়ারম্যান এইচ বেল করদাতাদের কর মুকুব করে দিলেন।
কৃষ্ণনগর রাজবাড়ি। —নিজস্ব চিত্র।
সৃষ্টির পর থেকে পুর এলাকার সীমানা তেমন পরিবর্তন হয়নি বললেই চলে। ইংরেজদের বিশেষ করে নীলকরদের ঘোড়দৌড়ের রেসকোর্স কোম্পানিবাগান এখন পুর এলাকার বাইরে চলে গিয়েছে। পাশাপাশি দোগাছি ইউনিয়ন বোর্ড এলাকার কালীনগর গভর্নমেন্ট কলোনি এলাকা পুরসভায় যুক্ত হয়েছে। সীমানার হেরফের না হলেও রাস্তার সংখ্যা আর নাম অর্ধ-সহস্র ছুঁই ছুঁই। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবদ্দশাতেই তাঁর নামে কৃষ্ণনগর গোবিন্দ সড়কের নামকরণ করা হয়। নীল-সাদা বোর্ডে ডাঃ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রোড লিখে পথের পাশে বাড়ির দেওয়ালে লাগিয়ে দেওয়া হয় (তখন বাংলায় ডক্টরেট অর্থে ড. নয় ডাঃ লেখা হত)। কৃষ্ণনগরের মাটিতে বেনীমাধব দাস ও হেমন্তকুমার সরকারের সংস্পর্শে আসা নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর রাজনৈতিক জীবনের টার্নিং পয়েন্ট। এখানে তিনি শ্রমজীবী বিদ্যালয়ে পড়ানো থেকে শুরু করে নানা কাজে যুক্ত ছিলেন। কৃষ্ণনগর পুরসভা কলকাতার মেয়র সুভাষচন্দ্রকে সংবর্ধনাও দিয়েছেন। কিন্তু এই পুরসভায় নেতাজির নামে কোন রাজপথ নেই। যদিও এখানে নেতাজির আজাদহিন্দ ফৌজের স্মরণে রয়েছে আজাদহিন্দ সড়ক।
‘কু ঝিক ঝিক’ রেলইঞ্জিনের মতো কৃষ্ণনগর পুরসভার রাস্তার কাজে স্টিমইঞ্জিনের রোডরোলার ব্যবহার করা হত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সেই রোডরোলারটি বৃটিশ সেনাদের রাস্তা তৈরির প্রয়োজনে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু ফেরত আসে না। স্বাধীনতার পর তার হদিস মেলে উত্তর পূবার্ঞ্চলের জঙ্গলে। আজাদহিন্দ ফৌজের প্রথম আক্রমণে বৃটিশ সেনারা রণাঙ্গন ছেড়ে পালিয়ে আসার সময় সেটিকে বনের মধ্যে ফেলে এসেছিল। পরে সরকারের সহযোগিতায় তা কৃষ্ণনগরে ফেরত আনা হয়।
পথিকের তৃষ্ণা মেটাতে ১৮৭০ সাল নাগাদ পুরসভা পথের পাশে কুয়ো খনন করে। গোপালভাঁড়ের শহর কৃষ্ণনগরে একটা রসিকতা চালু আছে-‘কৃষ্ণনগরের ঘোড়াধোয়া জল পেটে পড়েছে।’ চালু ‘হ্যাকনি ক্যারেজ অ্যাক্ট’এর অধীনে ১৮৮০ সালে শহরে ঘোড়ায় টানা এক্কা গাড়ি রাজপথে চলতে শুরু করে। পুরসভা ঘোড়ার তৃষ্ণা মেটানর জন্য রাস্তার ধারে লোহার বাথটবের মতো জলাধার তৈরি দেয়। কৃষ্ণনগরে বহিরাগত কোনও অকালপক্ক ব্যক্তির মদ্যপানে রসাসিক্ত হয়ে রাস্তায় গড়াগড়ি খেতে খেতে বাথটবের জলে মুখ দেওয়াকে কেন্দ্র করে চালু হয় এই রসিকতা।
ফুটবলে সাহেবদের হারিয়ে ১৯১১ সালে মোহনবাগানের শিল্ড জয়ের কথা আমরা সবাই জানি। কিন্তু তার আগে অন্য এক খেলায় চ্যাম্পিয়ন কৃষ্ণনগর। মোহনবাগানের শিল্ড জয়ের ২৬ বছর আগে ১৮৮৫ সালের ২৮ জানুয়ারি পুরসভার চেয়ারম্যান নিবার্চনে সরাসরি ইংরেজ সাহেব প্রার্থীকে হারিয়ে জয়ী হন প্রথম ভারতীয় রায়বাহাদুর যদুনাথ রায়। প্রস্তাবক বাবু রামচন্দ্র মুখোপাধ্যায় এবং বাবু প্রসন্নকুমার বসুর সমর্থনে চেয়ারম্যান পদে সাহেব প্রার্থী ছিলেন জেলাশাসক মিস্টার লারমিনি। বিপক্ষে বাবু অভয়কুমার মুখোপাধ্যায়ের প্রস্তাবে এবং বাবু তারাপদ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সমর্থনে প্রার্থী হন রায়বাহাদুর যদুনাথ রায়। সংখ্যাগরিষ্ঠের ভোটে রায়বাহাদুর যদুনাথ রায় নিবার্চিত হন। এর আগে অবশ্য ১৮৭৬ সালে মিস্টার ডি বি অ্যালেন ছুটিতে গেলে সরকারের অনুমোদন সাপেক্ষে বাবু প্রসন্নকুমার বসু ভাইস চেয়ারম্যান নিবার্চিত হয়েছিলেন। সেটা ছিল সেমিফাইনাল।
বৃটিশরা পুরসভার সদস্যদের মধ্যে দুই-তৃতীয়াংশ সদস্য নিবার্চনের গণতান্ত্রিক অধিকার দেয় ১৮৮৩ সালে। পুরুষদের পাশাপাশি বেশি কর প্রদানকারী মহিলাদের ভোটাধিকার দেওয়া হয়। যদিও সরাসরি নয়, মহিলারা ভোট দিতে পারতেন তাঁদের প্রতিনিধির মাধ্যমে। সদস্যদের মধ্যে জমিদার, উকিল, ব্যবসাদার, ধর্মীয় সম্প্রদায় ইত্যাদির প্রতিনিধি নিবার্চিত হতেন। গ্যারেটের গেজেটিয়ার থেকে জানা যায় ১৯১০ সালে ২১ জন কমিশনারের মধ্যে নিবার্চিত ছিলেন ১৪, মনোনীত ৩ এবং পদাধিকার বলে ৪ জন। গত সার্ধ-শতাব্দীতে ওয়ার্ড বা কমিশনারের সংখ্যা পরিবর্তিত হয়ে কখনও ২৪, ২৫ বা ২৯ ছিল। দেশভাগের ১২ বছর আগে সম্প্রদায়ভিত্তিক প্রতিনিধিত্ব ব্যবস্থা বাতিল হয়। আর স্বাধীনতার ৩১ বছর পর প্রথম এখানে ভোটাধিকারের বয়স ১৮ করা হয়। জমিদারি প্রথা উঠে গেছে। নদিয়ারাজ পরিবারের উত্তর-পুরুষরাও এখন অন্যদের মতো সাধারণ ভোটার মাত্র। কৃষ্ণনগরের ভাগ্যনিয়ন্ত্রক কৃষ্ণনাগরিকরাই। কৃষ্ণনগর পুরসভা এখন আমজনতার, সাধারণ কৃষ্ণনাগরিকের।