—প্রতীকী চিত্র।
পরচুলা ব্যবসায় ‘হাওয়ালা’ যোগ সামনে এসেছে পুলিশের তদন্তে। শুল্ক ফাঁকি দিয়ে একাংশ কারবারির এই ব্যবসার সামগ্রী বিদেশে পাঠাচ্ছেন, এমন তথ্যও হাতে আসেছে তাদের। আর ব্যবসায় বেআইনি যোগসাজেশের ফলে অপরাধমূলক কাজকর্মের আশঙ্কা উড়িয়ে দিচ্ছেন না সৎ ভাবে কারবারে জড়িতব্যবসায়ীরা। অনেকে এ-ও জানাচ্ছেন, বেআইনি কাজে জড়িত কারবারিরা অনেকে সময় ক্ষতি এবং বিপদের সম্মুখীনও হন।
পূর্ব মেদিনীপুরের ভগবানপুর, চণ্ডীপুর, চৌখালি এবং পটাশপুরের একাংশ এলাকায় পরচুলা কারবার চলে। ফেলে দেওয়া বা ঝরে পড়া চুল থেকে প্রসেসিংয়ের মাধ্যমে ‘ফ্রেশ’ পরচুল তৈরি করা হয়। সঙ্গত কারণে রাজ্য সরকারের তরফে এই কারবারের উপরে কোনও কর ধার্য করা হয়নি। স্থানীয় ব্যবসায়ীদের একাংশ আকাশ পথে পরচুলা চিনে রফতানি করেন। সে ক্ষেত্রে বিমানবন্দরে শুল্ক দফতরকে নির্দিষ্ট কর দিয়ে তাঁদের ব্যবসা করতে হয়। তবে অনেকেই অতিরিক্ত মুনাফার লোভে চোরাপথে বাংলাদেশ এবং মায়ানমারে পরচুলা রফতানি করেন। সেখানে কর ফাঁকি দেওয়া হয় বলে অভিযোগ। আর বেআইনি ভাবে কাজ করতে গিয়েই অনেক সময় ব্যবসায়ীরা অপরাধমূলক কারবারে জড়াচ্ছেন বলে অভিযোগ। যেমন, সম্প্রতি পরচুলা বিক্রি বাবদ বকেয়া টাকা না মেলায় বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের এক পড়ুয়াকে অপহরণ করার অভিযোগ উঠেছে ভগবানপুরের এক তৃণমূল নেতার বিরুদ্ধে। তাঁকে গ্রেফতারও করেছে বীরভূম জেলা পুলিশ।
ওই ঘটনার পরে 'চুলের খনি' বলে পরিচিত পূর্ব মেদিনীপুরের ভগবানপুরের পরচুলা কারবারের তদন্তে উঠে এসেছে চাঞ্চল্যকর তথ্য। স্থানীয় ব্যবসায়ীরা জানাচ্ছেন, ‘রিটার্ন মার্চেন্ডাইজ অথারাইজেশন’ (আরএমএ) পদ্ধতি মেনে হাতেগোনা কয়েকজন বিদেশে পরচুলা রফতানি করেন। তবে একটা বড় অংশের ব্যবসায়ী ‘হাওয়ালা’র মারফত চুলের বিনিময়ে নগদে অর্থ আদানপ্রদান করেন। এর ফলে অনেকাংশেই তাঁরা প্রতারণার ফাঁদেও পড়ছেন। স্থানীয় ব্যবসায়ীদের কেউ কেউ জানাচ্ছেন, সম্পূর্ণ প্রসেসিং হয়ে যাওয়ার পর পরচুলা রফতানি হওয়ার পথে চুরি হয়ে যাচ্ছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন পরচুলা কারবারি বলছেন, ‘‘কবে কার পরচুলা কোন গাড়িতে পাঠানো হচ্ছে, তা একেবারেই নিজেদের লোক ছাড়া জানা সম্ভব নয়। রাজ্য সরকার কোনওরকম কর নেয় না। তাই সরকার সে রকম নজরদারি চালায় না। সেই সুযোগ গাড়ি চুরি হচ্ছে।’’ জেলায় গত কয়েক বছরে এ ধরনের ঘটনা একাধিক ঘটেছে। স্থানীয় ব্যবসায়ীদের থানায় ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করে সেই সব চুরির কিনারাও করেছে পুলিশ। পরচুলা ব্যবসায়ী সংগঠনের এক শীর্ষ কর্মকর্তা শেখ হাসিফুর রহমান বলছেন, ‘‘এলাকার প্রায় সকলেই বৈধ উপায়ে ব্যবসা করেন। তবে যাঁরা শুল্ক দফতরকে এড়িয়ে ব্যবসা করেন, সেখানে অপরাধ ঘটার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।’’
এই ব্যবসার উপরে কি প্রশাসনের কোনও নজরদারি নেই?
পূর্ব মেদিনীপুরের পুলিশ সুপার সৌম্যদীপ ভট্টাচার্যের দাবি, ‘‘পরচুলা কারবারে কোনও রকম অপরাধের আশঙ্কা থাকলে পুলিশ তার দ্রুত তদন্ত করে পদক্ষেপ করে।’’ ভগবানপুর এবং চণ্ডীপুরের স্থানীয় ব্যবসায়ীদের একাংশ জানাচ্ছেন, বাম আমল থেকেই পরচুলা কারবারের সঙ্গে যাঁরা যুক্ত, তাঁরা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন শাসক দলের ঘনিষ্ঠ থাকেন। কিন্তু হাওলাদারের মাধ্যমে আর্থিক লেনদেন তৃণমূলের আমলে শুরু হয়েছে বলে অভিযোগ। এ প্রসঙ্গে বিজেপির কাঁথি সাংগঠনিক জেলা সভাপতি তথা বিধায়ক অরূপ দাস বলছেন, "তৃণমূলের আমলে সব সম্ভব। যাঁরা আইন মানেন না, তাঁরা সকলেই এখানে শাসকদলের ছত্রছায়ায় থাকেন।’’
বিজেপির কাঁথি সাংগঠনিক জেলার নেতা স্বপন রায় বলছেন, ‘‘রাজ্য সরকার পরচুলাকে বর্জ্য পদার্থ হিসেবে মনে করে। এই কারবারের উপরে কোনও রকম নিয়ন্ত্রণ নেই সরকারের। সেই কারণে যে যেমন সুযোগ পাচ্ছে, তেমন ভাবে আখের গুছিয়ে নিচ্ছেন। আর নজর না থাকায় পরচুলা নিয়ে চুরি, ছিনতাই আর প্রতারণার ঘটনা বাড়ছে।’’ বেআইনি কাজে তৃণমূলের মদতের অভিযোগ অস্বীকার করে তৃণমূলের কাঁথি সাংগঠনিক জেলা সভাপতি তরুণ মাইতি বলছেন, ‘‘পুলিশ আইন মেনে তদন্ত করছে। কেউ অপকর্মের সঙ্গে যুক্ত হলে কোনওভাবেই দল তাকে সমর্থন করবে না।’’ (শেষ)